ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

আজ শুভ বড়দিন ॥ উদযাপনের ব্যাপক প্রস্তুতি

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৬

আজ শুভ বড়দিন ॥ উদযাপনের ব্যাপক  প্রস্তুতি

নিখিল মানখিন ॥ আজ ২৫ ডিসেম্বর শুভ বড়দিন (ক্রিসমাস)। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। আজ থেকে ২ হাজারের বেশি বছর আগে এই শুভদিনে পৃথিবীকে আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক যিশুখ্রিস্ট। বেথেলহেমের এক গোয়ালঘরে কুমারী মাতা মেরীর কোলে জন্ম হয়েছিল যিশুর। খ্রিস্ট ধর্মানুসারীরা বিশ্বাস করেন, কোন পুরুষের সহবাস ছাড়াই যিশুখ্রিস্টের জন্ম। সেই অর্থে তিনি ঈশ্বরের পুত্র। সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় সেখান হতেই বিকশিত হয় মুক্তির এই আলোর দিশারী। যার স্পর্শে পাপের আবর্তে নিমজ্জিত থাকা মানুষের অন্তরে এনে দেয় শান্তির পরশ। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের বড়দিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। রাষ্ট্রপতির বাণী ॥ রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বড়দিন উপলক্ষে শনিবার এক বাণীতে বলেন, মানবজাতির মুক্তির লক্ষ্যে এ পৃথিবীতে মহামতি যিশুখ্রিস্টের আবির্ভাব ছিল এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। তিনি ছিলেন মুক্তির দূত, আলোর দিশারী। পৃথিবীকে শান্তির আবাসভূমিতে পরিণত করতে বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা সহ্য করে যিশুখ্রিস্ট সৃষ্টিকর্তার মহিমা প্রচারসহ খ্রিস্টধর্মের সুমহান বাণী প্রচার করেন। রাষ্ট্রপতি বলেন, যিশুখ্রিস্ট পথভ্রষ্ট মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের পথে আহ্বান জানান। তার মতে মানুষের পরিত্রাণের উপায় হলো জগতের মাঝে ভালবাসা, সেবা, ক্ষমা, মমত্ববোধ, সহানুভূতি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠাসহ শান্তিপূর্ণ অবস্থান। পূর্ণ অন্তর, মন ও শক্তি দিয়ে তিনি ঈশ্বর ও সকল মানুষকে ভালবাসতে বলেছেন। তিনি বলেন, জাগতিক সুখের পরিবর্তে যিশুখ্রিস্ট ত্যাগ, সংযম ও দানের মাধ্যমে পরমার্থিক সুখ অর্জনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। জাতিতে জাতিতে সম্প্রীতি ও ঐক্য স্থাপনসহ সমস্যাসংকুল বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যিশুখ্রিস্টের শিক্ষা ও আদর্শ খুবই প্রাসঙ্গিক। রাষ্ট্রপতি বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ। এ সম্প্রীতি আমাদের আবহমানকাল ধরে। এখানে সব ধর্মের মানুষ পারস্পরিক ভালবাসা ও সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ। যারা হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে এই ঐতিহ্যকে বিনষ্ট করার অপচেষ্টায় লিপ্ত, তাদের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। শুভ ‘বড়দিন’ উপলক্ষে দেশের খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীসহ বিশ্ববাসীকে রাষ্ট্রপতি আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। প্রধানমন্ত্রীর বাণী ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বড়দিন উপলক্ষে দেয়া বাণীতে বলেছেন, আমাদের সংবিধানে সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষের সমানাধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে। এখানে রয়েছে সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের নিজস্ব ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা। প্রধানমন্ত্রী শুভ বড়দিনকে পুণ্যদিন হিসেবে উল্লেখ করেন এবং এ উপলক্ষে খ্রীস্টান সম্প্রদায়সহ জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে মানবতার মহান ব্রতে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের উন্নয়নে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী ‘বড়দিন’ উপলক্ষে খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের সকল সদস্যকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, ‘খ্রিস্টান ধর্মের প্রবর্তক যিশুখ্রিস্ট এদিনে বেথেলহেমে জন্মগ্রহণ করেন। শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য পৃথিবীতে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই ছিল যিশুখ্রিস্টের অন্যতম ব্রত। বিপন্ন ও অনাহারক্লিষ্ট মানুষের জন্য মহামতি যিশু নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর জীবনাচারণ ও দৃঢ় চারিত্রিক গুণাবলির জন্য মানব ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে আছেন।’ তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, বড়দিন দেশের খ্রীস্টান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যকার বিরাজমান সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতিকে আরও সুদৃঢ় করবে। প্রধানমন্ত্রী আনন্দময় ও উৎসবমুখর বড়দিনে খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী জনসাধারণের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করেন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও উৎসবমুখর পরিবেশে দিনটি উদযাপন করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে খ্রীস্টান সম্প্রদায়। ইতোমধ্যে বড়দিন পালনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। এ উপলক্ষে দেশের সব গীর্জা ও বড় হোটেল রঙিন বিজলিবাতি আর ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। খ্রীস্টান ধর্মে বিশ্বাসীদের অনেকের ঘরেই বসানো হয়েছে প্রতীকী গো-শালা। বেথেলহামের গরিব কাঠুরিয়ার গোয়ালঘরেই যিশু খ্রিস্টের জন্ম। সেই ঘটনা স্মরণ করে বাড়িতে ধর্মীয় আবহ সৃষ্টি করতেই এটি করেন যিশুর অনুসারীরা। বড়দিনের কেনাকাটা অনেক আগেই সম্পন্ন হয়েছে। শনিবার রাতে প্রার্থনাসভার মধ্য দিয়ে বড়দিন উদযাপনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। রাতে প্রার্থনার বিশেষ মাহাত্ম্য হচ্ছে, পৃথিবীতে যিশুর আগমন উপলব্ধি করা। রাজধানীর কাকরাইলের সেন্ট মেরিস ক্যাথেড্রালে রাতে প্রধান প্রার্থনাসভার আয়োজন করা হয়। বড়দিন উপলক্ষে আজ রবিবার বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে এবং বেসরকারী টিভি চ্যানেলসমূহে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করা হবে। দিনটি সরকারী ছুটির দিন। খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের অনুসারীরা আজ রবিবার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন। ডিসেম্বরের শুরু থেকেই রাজধানীসহ খ্রীস্টানঅধ্যুষিত এলাকাগুলোতে বড়দিনের আমেজ শুরু হয়। শনিবারই সম্পন্ন হয়েছে এদিন পালনের সব প্রস্তুতি। রাজধানীর বিভিন্ন খ্রীস্টানঅধ্যুষিত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গীর্জাসহ বাসাবাড়ি বিশেষভাবে সজ্জিত করা হয়েছে। ক্যাথলিক খ্রীস্টানরা তৈরি করেছেন যিশুর জন্মদিনের গোয়ালঘর। প্রটেস্ট্যান্টদের স্থাপনাগুলোতে শোভা পাচ্ছে যিশুর আগমনী তারকা। এসব এলাকায় শনিবার বিকেল থেকেই শুরু হয়েছে প্রার্থনা সঙ্গীত ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শনিবার রাতভর অনুষ্ঠান চলার পর আজ রবিবার সকালে প্রতিটি গীর্জায় অনুষ্ঠিত হবে এক থেকে দুটি বিশেষ খ্রিস্টযোগ। এ উপলক্ষে রমনার আর্চবিশপ হাউস সেন্ট মেরিস ক্যাথেড্রালকে বিশেষ সাজে সজ্জিত করা হয়েছে। এছাড়াও রমনা সেন্ট মেরিস ক্যাথেড্রাল, তেজগাঁও ক্যাথলিক গীর্জা, মিরপুর ব্যাপ্টিস্ট চার্চসহ রাজধানীর বিভিন্ন চার্চে বিশেষ খ্রিস্টযোগ অনুষ্ঠিত হবে। এ জন্য গীর্জার প্রবেশপথে সাজানো হয়েছে ক্রশ, শুভেচ্ছা কার্ডসহ উপহারসামগ্রী বিক্রির দোকান। বড়দিন উপলক্ষে বিভিন্ন হোটেলে বিশেষ আয়োজন বড়দিন উপলক্ষে রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও, দ্য ওয়েস্টিন ঢাকা, র‌্যাডিসন ওয়াটার গার্ডেনসহ অন্যান্য হোটেল বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। বড়দিনে এসব হোটেলে শিশুদের জন্য থাকবে ক্রিসমাস কিডস্ পার্টিসহ নানা ধরনের খেলার আয়োজন। প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেল সাজানো হয়েছে ক্রিসমাস ট্রি ও আলোকসজ্জায়। সেখানে শিশুদের জন্য বিভিন্ন খেলার প্রতিযোগিতা, ফ্যাশন শো, জাদু প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বড়দিন উপলক্ষে বিশেষ কেক ও কুকিজের ব্যবস্থা করেছে সোনারগাঁও হোটেল। র‌্যাডিসন ওয়াটার গার্ডেনের লবিতে স্থাপন করা হয়েছে বিশাল আকৃতির ক্রিসমাস ট্রি। হোটেলের চারটি রেস্তরাঁয় আয়োজন করা হয়েছে ক্রিসমাস স্পেশাল পুডিং, কেকসহ নানা মুখরোচক খাবার। সঙ্গে থাকবে সান্তা ক্লজ ও ফ্লেইকস। বড়দিন উপলক্ষে ওয়েস্টিন ঢাকা হোটেলকে আকর্ষণীয় রূপে সাজানো হয়েছে। শিশুদের জন্য তারা বিশেষ কিডস্ পার্টিসহ নানা ধরনের প্রতিযোগিতা ও খেলার আয়োজন করেছে। দেশবাসীকে বড়দিনের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়েছে বাংলাদেশ খ্রীস্টান এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও ও মহাসচিব নির্মল রোজারিও। রাজধানীর তেজগাঁও পবিত্র জপমালা রাণী চার্চের প্রধান ধর্মযাজক ফাদার কমল কোড়াইয়া জনকণ্ঠকে বলেন, গোটা বিশ্বের খ্রিস্ট বিশ্বাসীগণ দিবসটি মহাজাঁকজমকপূর্ণ প্রার্থনা ও নানা উৎসবের মধ্য দিয়ে উদ্যাপন করে থাকে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রায় ছয় লক্ষাধিক খ্রিস্ট বিশ্বাসী বর্তমানে বাংলাদেশে বসবাস করছে। সম্প্রীতির এ দেশে বড় দিনও সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। খ্রীস্টান-মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ সকলেই এ আনন্দ উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। সরকারী ছুটির দিন। বছরও শেষ। ছেলে-মেয়েদের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। ফলা-ফলও হাতে পেয়ে যায়। ঘরে আসে আমন ধান। শাকসবজি এ সময় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে সময়টি আনন্দ-উৎসবের উপযুক্ত সময়ই বটে। সুস্বাদু নানা খাবারের মধ্যে পিঠাই প্রাধান্য পায় বেশি। যেভাবেই বড়দিন উদযাপন করা হোক না কেন, বড়দিন সময়ে হিসেবে বড় নয়, বড় গুরুত্বের দিক দিয়ে। যিশুখ্রিস্টের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর মানুষ হলেন যাতে মানুষ পাপমুক্ত হয়ে ঈশ্বরের কাছে ফিরে যেতে পারেন। বিশ্বে যেন শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি নেমে আসুক; সুন্দর সাদা মনের সকল ধর্মের সকল মানুষ বিশ্বে শান্তি স্থাপনে সাধ্যমতো অবদান রাখুন-বড়দিনে এ প্রত্যাশা, এ প্রার্থনা করি।
×