ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

৩ রাজাকারের লাশ ফেলে পালায় পাক আর্মি ॥ জানালেন মুন্সীগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা ইকবাল

রামেরগাঁওর যুদ্ধে প্রথম গুলি করি আমি, যুদ্ধে মরল ৪ পাকসেনা

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬

রামেরগাঁওর যুদ্ধে প্রথম গুলি করি আমি, যুদ্ধে মরল ৪ পাকসেনা

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মুন্সীগঞ্জ ॥ ‘এলএমজির গুলি ছুড়তেই পাকবাহিনীর চারজন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ওদিক থেকে বৃষ্টির মতো গুলি আসছে। কোনক্রমেই কবর থেকে মাথা তোলা যাচ্ছে না। তখন পেছন থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যগ্রুপ গুলি ছোড়ে। বেকায়দায় পড়ে পাকবাহিনী। হঠাৎ আকাশে বিমান। আমাদের গুলিতে নিহত হয় অনেক পাকসেনা। এর মধ্যে ৫ লাশ নিয়ে পালিয়ে যায় পাকবাহিনী। কিন্তু ফেলে যায় ৩ রাজাকারের লাশ।’- কথাগুলো এভাবেই বলছিলেন মুন্সীগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা ইকবাল হোসেন। জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তুলে ধরেন একাত্তরের যুদ্ধদিনের স্মৃতি। জানালেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন হরগঙ্গা কলেজের স্নাতকের ছাত্র। সে কারণে তিনি ছিলেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সামরিক ট্রেনিংয়ে। যুদ্ধকালে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে আসার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। তবে কয়েকদিন পরেই নানা বুদ্ধি খাটিয়ে অংশ নেন যুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধা ইকবাল বলেন, মুন্সীগঞ্জ শহরতলীর রামেরগাঁওর যুদ্ধ। এই সম্মুখযুদ্ধে প্রথম গুলিটি করি আমি। টার্গেটও ঠিক ছিল। কবরস্থানে অবস্থান নিয়ে মুখোমুখি যুদ্ধে অংশ নিয়ে সফলতা অর্জন করি। ’৭১-এর ৪ ডিসেম্বরের এই যুদ্ধই ছিল মুন্সীগঞ্জের সর্বশেষ যুদ্ধ। এই যুদ্ধে পরাজিত হয়েই পাকবাহিনী মনোবল হারিয়ে ফেলে। এরপর হরগঙ্গা কলেজের প্রধান ক্যাম্প থেকে বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। নিহত পাক সেনাদের নামাজে জানাজা হয় পুরনো হাসপাতাল এলাকায়।’ ইকবাল হোসেনের ভাষ্যমতে, ১১ দফায় ছিল ছাত্রদের বাধ্যতামূলক সামরিক ট্রেনিং। তার অংশ হিসেবে ঢাকা ও লাহোরে প্রথমবারের মতো এই সামরিক ট্রেনিং শুরু হয়। ’৭০ সালে গঠিত ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টে এই ট্রেনিং শুরু হয়। এর আগে হরগঙ্গা কলেজের কয়েক শ’ শিক্ষার্থীর মধ্য থেকে ৮০ জনকে বাছাই করা হয়। তাদের মধ্যে আমি একজন। এই ট্রেনিং ছিল এক বছরের। বেসিক ট্রেনিং হয় আট সপ্তাহ। চায়নিজ রাইফেল, স্টেন গান ও এলএমজির ট্রেনিং ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে হয়। লং রেঞ্জের এলএমজি ফায়ারিং প্রতিযোগিতার জন্য চট্টগ্রামে নেয়ার কথা ছিল আমাদের। কিন্তু এর আগেই শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। তাই বাঙালীদের আর্মস ট্রেনিং বন্ধ করে দেয়া হয়। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের চিত্র ছিল একেবারেই ভিন্ন। বিভিন্ন সাঁজোয়া যান এবং ভারি ভারি সামরিক যানের আনাগোনা তাদের ভাবিয়ে তোলে। কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না কি হচ্ছে। রাত পৌনে এগারোটায় ফায়ারিংয়ের শব্দ পাওয়া যায়। বিভিন্ন স্থানে আগুনের লেলিহান শিখাও দেখা যায়। সবই দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু মূল ঘটনা বুঝতে পারছিলাম না। ব্যারাকে নির্ঘুম রাত কাটায় প্রায় এক হাজার কলেজ ছাত্র। মাইকের সঙ্গে রেডিও লাগিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু তাও বন্ধ। এর আগে ৭ মার্চের ভাষণ শোনার জন্যও তারা অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু রেডিও সেদিন তা প্রচার করেনি। পরদিন অবশ্য রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছেন। সিগন্যালের কাছাকাছি আইয়ুব লেনের ব্যারাকে থাকতাম আমরা। লে. কর্নেল মহিউদ্দিন ছিলেন তাদের কমান্ডার। বাড়ি মানিকগঞ্জে। বাঙালী অফিসারদের মধ্যে ছিলেন মেজর ওয়াহিদ, ক্যাপ্টেন বোরহান আলী বেগ, ক্যাপ্টেন সৈয়দ তসলিম হোসেন। সকলেই ২৫ মার্চ থেকে ছিলেন একরকম অসহায়। ২৬ মার্চ অন্যদিনের মতো সকালে প্যারেডে এসে অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র দেয়া হলেও তা আবার ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করা হয়। বাঙালী অফিসারদের চোখেও ঘুম ছিল না। চোখ লাল। ব্যাজও ছিল না। বাঙালী কারও কাছেই অস্ত্র ছিল না। সেই বাঙালী অফিসারদের অনুরোধেই অস্ত্র ফেরত দিই আমরা। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে নানা রকম অবস্থা বিরাজ করছিল। তখন অস্ত্র ফেরত না দিয়েও উপায় ছিল না। ইকবাল হোসেন জানান, ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্ট উদ্বোধন করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সেনা প্রধান সাহেবজাদা ইয়াকুব আলী খান। এই অবাঙালী উদ্বোধনকালে বাংলায় কথা বলেন, এমনকি রবীন্দ্রনাথের কবিতাও পাঠ করেন। কিন্তু সেই পাকবাহিনীর নির্মতা বিস্মিত করছিল। যুদ্ধের আগে ’৭১-এর ১৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের তৎকালী সেনাপ্রধান ক্যান্টনমেন্টের সঙ্গে ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্ট পরিদর্শন করে গেছেন। তাদের যুদ্ধের পরিকল্পনা ছিল আগে থেকেই। মুক্তিযোদ্ধা ইকবাল হোসেন জানান, পরবর্তীতে বিশেষ অনুমতি নিয়ে তিনি ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলে এসে শহিদুল আলম সাঈদকে সঙ্গে নিয়ে ডাকসুতে আব্দুল কুদ্দুস মাখনের সঙ্গে এই ট্রেনিংসহ বিস্তারিত ঘটনা অবহিত করেন। সামরিক এই ট্রেনিংয়ে তার সহপাঠী অনেকেই ছিলেন। আব্দুল হক, আব্দুর রউফ, অলি, রহমতউল্লাহ ও নান্টু অন্যতম। অবশেষে ’৭১-এর ১০ এপ্রিল ছেড়ে দেয়া হয়। এখানেও ছিল ষড়যন্ত্র। বাড়ি ফেরার কোন ব্যবস্থা ছাড়াই মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ছেড়ে দেয়া হয়। পরে ট্রাকে করে ৭০ জনকে সাভারে নিয়ে হত্যা করা হয়। অন্যদেরও খোঁজা হচ্ছিল। নানাভাবে বিভক্ত অবস্থায় তাৎক্ষণিক ছড়িয়ে যাওয়া অনেকে রক্ষা পায়। ইস্ট পাকিস্তান সড়ক পরিবহনের গাড়িতে করে আমি প্রথম গুলিস্তান আসি। কিন্তু গুলিস্তান এসে আর গাড়ি মিলছিল না। পরে জনপ্রতি দেড় টাকার স্থলে কয়েকগুণ বেশি ভাড়ায় একটি ট্যাক্সি ভাড়া করে নারায়ণগঞ্জে আসি। তোলারাম কলেজের সামনে আর্মি ছিল। কিন্তু ট্যাক্সিতে থাকায় কোনরকম বাধা হয়নি। নারায়ণগঞ্জ লঞ্চঘাটে এলেও লঞ্চ ছিল না ঘাটে। পাশের বিউটি হোটেলে দেখা যায় মানুষের ভিড়। সেখানে গিয়ে এলাকার বড় ভাই কাজী আনোয়ার হোসেনকে পেয়ে যাই। আমাকে পেয়ে বুকে জাড়িয়ে ধরেন তিনি। পরে তার সঙ্গেই একটি নৌকায় করে মুন্সীগঞ্জে আসি। সঙ্গে ছিল নান্টু। পরিবারসহ সকলেরই ধারণা ছিল ট্রেনিংয়ে থাকা সকলকেই মেরে ফেলা হয়েছে। এর পরেই সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। এসএসসি পরীক্ষা চলে এলো। পরীক্ষা বন্ধের সিদ্ধান্ত হলো। অন্যেরা ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতে চলে গেলেন। মুন্সীগঞ্জে মিজান রশীদের নেতৃত্বে এই পরীক্ষা বন্ধে সব রকম অপারেশনে অংশ নিলেন ইকবাল হোসেন। পরে ট্রেনিং নিয়ে জুন-জুলাইয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে এলে যুদ্ধ এবং প্রতিরোধ ছড়িয়ে পড়ে। ইকবাল হোসেনদের সঙ্গের সামরিক ট্রেনিংপ্রাপ্তদের কয়েকজন ভারতের আগরতলা যান। যাওয়ার পর তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয় অস্ত্র দিয়ে। সামরিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত অন্যদের ভারতে না গিয়ে যুদ্ধে অবদান রাখার নির্দেশ আসে। পরে আমি শহিদুল আলম সাঈদের সঙ্গে রণাঙ্গনে ছিলাম। বীর মুক্তিযোদ্ধা ইকবাল হোসেন রামেরগাঁও যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, রামেরগাঁও যুদ্ধের ১০/১৫ দিন আগে দাস বাড়ি (সম্ভব জ্যোতি দাসের বাড়ি) পাকিস্তানীরা গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। এই সময় চারদিকে মুক্তিযোদ্ধারা ঘিরে ফিলে হানাদার বাহিনীকে। কেউ কারও খবর রাখত না। তাই রক্ষা পেয়ে যায়। কিন্তু চলে যাওয়ার পর দেখা যায় সেখানে ১১০ মুক্তিযোদ্ধা ছিল। একটি ফায়ার করলেই অন্যরাও এগিয়ে আসতে পারত। এরপরই সকলে মিলে সিদ্ধান্ত হয় পাহারা বসানো এবং প্রতিরোধের নানা কৌশল। সর্দারপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দোতলার মুক্তিযোদ্ধারা পাহারায় থাকত। আলাদা গ্রুপে এই পাহারা চলত। ৪ ডিসেম্বর সকালে পাহারা শেষে রতনপুর এসে মুড়ি ও মাঠা খাচ্ছিলেন তারা। তখন সকাল আটটা। খবর আসে আর্মি আসছে। শহর আওয়ামী লীগের নেতা মকবুল খবরটি জানান। শহিদুল আলম সাঈদ শিশুদের মাধ্যমে খরবটি নিশ্চিত করেন। এসএলআর নিয়ে ইকবাল হোসেন এবং রাইফেলসহ হুদা মতিন এক গ্রুপে। অপর গ্রুপে হাবলু ও বাদল। স্থানীয় আনোয়ার দেওয়ানের বাড়ির দিকে যাওয়া শুরু করল পাকবাহিনী। সমান্তরাল আরেক রাস্তা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যেতে থাকল। ইকবাল-মতিন গ্রুপ রামেরগাঁও কবরস্থানে অবস্থান পেয়ে যায়। তখন তাদের অবস্থান পাকবাহিনী থেকে মাত্র ৫০ বা ১শ’ গজ দূরে। ফায়ার শুরু হলো। পাল্টা ফায়ারে মসজিদের দেয়ালে বহু গুলি লাগছিল। তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো। পাক আর্মির পেছন দিয়ে হাবলু ও বাদল গুলি ছুড়লেই বেকায়দায় পড়ে পাক বাহিনী। শহিদুল আলম সাঈদ গ্রুপ সফলভাবে গুলি করার পর মুহূর্তেই কাজী আনোয়ার হোসেন এবং আনোয়ার হোসেন অনুর গ্রুপ, ওমর আলীর গ্রুপ, মোফাজ্জলের গ্রুপ গুলি ছোড়া শুরু করে। তখন সকল প্রায় নয়টা। টার্গেট করে ফায়ার করার পর পাক বাহিনীর চার জন মাটিয়ে লুটে পড়ে প্রথম। এরপর আরও কয়েক হানাদার বাহিনী গুলিবিদ্ধ হয়। এক থেকে দেড় ঘণ্টা গুলিবিনিময় চলে। হঠাৎ বিমানের শব্দ। আকাশে ধোঁয়ার কু-লী। মুক্তিযোদ্ধাদের ধারণা ছিল পাকবাহিনীকে রক্ষা করতে বিমান এসেছে। ঐদিনই প্রথম বিমান এখানকার আকাশে। এই সুযোগে পাকবাহিনী লাশ নিয়ে পালিয়ে যায়। তবে গুলির বাক্স নিয়ে সঙ্গে আসা কয়েক রাজাকার নিহত হয়। তারা তিন রাজাকারের লাশ ফেলে যায়। ইকবাল হোসেন দীর্ঘদিন দৈনিক ইত্তেফাকে সাংবাদিকতা করেছেন। মুন্সীগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি অগ্রণী ব্যাংকের অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সম্প্রতি সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে তিনি অবসর নিয়েছেন। মুন্সীগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাহী কমিটির কর্মকর্তা তিনি। পুত্র অনিন্দ্য এবং কন্যা অমিয় ঢাকায় স্নাতক পড়ছে। স্ত্রী সাদেকা খাতুন শেরপুর পিটিআইর সুপার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। সৎ জীবনযাপন এবং মুক্তিযুদ্ধে তার সাহসিকতা জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।
×