ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

এরা অংশ নেয় বিভিন্ন অপারেশনে

দুই হাজার জঙ্গীর ডাটাবেজ- পাঁচ শতাধিক ভয়ঙ্কর

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৭ নভেম্বর ২০১৬

দুই হাজার জঙ্গীর ডাটাবেজ- পাঁচ শতাধিক ভয়ঙ্কর

গাফফার খান চৌধুরী ॥ শেষ হয়েছে জঙ্গীদের ডাটাবেজ তৈরির কাজ। তাতে স্থান পেয়েছে প্রায় দুই হাজার জঙ্গীর নাম। কয়েক দফায় যাচাই বাছাই শেষে ডাটাবেজটি তৈরি করা হয়েছে। তবে ডাটাবেজে নতুন নতুন জঙ্গীর নাম ও জঙ্গীবাদ সম্পর্কিত তথ্য যুক্ত হওয়া অব্যাহত আছে। ডাটাবেজে থাকা জঙ্গীদের মধ্যে পাঁচ শতাধিক জঙ্গীকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ও ভয়ঙ্কর হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। যারা বিভিন্ন অপারেশনাল কর্মকা-ে জড়িত। বাকি দেড় হাজারের মধ্যে এক হাজার জঙ্গী অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ। আর পাঁচ শতাধিক জঙ্গী বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের গোয়েন্দা কার্যক্রম, মনিটরিং, তথ্যপ্রযুক্তি শাখাসহ বিভিন্ন কাজে জড়িত। তারা কোন অপারেশনে অংশ নেয় না। তবে অপারেশনের জন্য তথ্য সরবরাহ করে থাকে। শনাক্ত হওয়া জঙ্গীদের গ্রেফতারে দেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহর ছাড়াও বাংলাদেশ-ভারত সংলগ্ন স্থল সীমান্ত জেলাগুলোতে কম্বিং অপারেশন চলছে। জঙ্গী মনিটরিংকারী গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, জঙ্গীবাদের মতো বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবেলায় পুলিশ সদর দফতরে একটি জঙ্গী মনিটরিং সেল খোলা হয়েছে। সেলটি সারাদেশে গ্রেফতার হওয়া এবং গ্রেফতারের বাইরে থাকা জঙ্গী এবং এ সংক্রান্ত মামলা সংক্রান্ত বিষয়াদি তদারকি করে থাকে। পাশাপাশি পুলিশ ও র‌্যাবের প্রতিটি ইউনিটে জঙ্গী মনিটরিংয়ের জন্য পৃথক সেল রয়েছে। তারাও জঙ্গী বিষয়ক সবকিছুই মনিটরিং করে থাকে। ২০১৩ সাল থেকে জঙ্গীদের হাতে নৃশংস হত্যাকা-ের পর থেকেই এমন তৎপরতা শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তৎপরতার অংশ হিসেবে অভিযানও চলছিল। অভিযানের মধ্যেই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ও গুলশানে জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর অভিযান আরও জোরদার করা হয়। পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের ১০ জুন থেকে দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গী নির্মূলে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। সেই সঙ্গে জঙ্গীদের আত্মসর্মপণের আহ্বান জানানো হয়। গত জুলাই পর্যন্ত দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান চলে। এরপর অভিযান সামান্য টিলে হলে এসেছিল। গুলশানে হামলার পর আবারও সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়। সে অভিযান অব্যাহত আছে। এ পর্যন্ত অভিযানে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জেএমবি, হিযবুত তাহরীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি), হরকাতুল জিহাদ (হুজি), আল্লাহর দলসহ নামে বেনামে জঙ্গী তৎপরতায় জড়িত থাকার অভিযোগে সারাদেশ থেকে প্রায় তিনশ’ জঙ্গী গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে দেড় শতাধিক জঙ্গীকে টিএফআই (টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন) সেলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। বাকিদের মধ্যে অনেকেই পুরনো মামলার পলাতক আসামি। তাদের মধ্যে অনেককে প্রয়োজন অনুযায়ী রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে পাঁচ শতাধিক জঙ্গী সম্পর্কে তথ্য বেরিয়ে আসে। জিজ্ঞাসাবাদে কোন নতুন জঙ্গী বা জঙ্গী সংগঠনের নাম আসার পর ওই জঙ্গীকে দফায় দফায় রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যেই অনেক জঙ্গীকে ঢাকায় পাঠিয়ে টিএফআই সেলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। নতুন করে প্রকাশ পাওয়া জঙ্গীদের অধিকাংশই ছদ্ম নামে পরিচিত। রিমান্ডে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে আগের তথ্যের সমন্বয় করা হয়। তাতে দেশে প্রকৃত জঙ্গীর একটি আনুমানিক চিত্র বেরিয়ে আসে। যার সংখ্যা দুই হাজারের বেশি। তাদের একটি তালিকা করা হয়েছে। পরবর্তীতে পুলিশ সদর দফতর তালিকাটি অভিযানের স্বার্থে এবং গ্রেফতারের সুবিধার্থে জেলাভিত্তিকভাবে তৈরি করে। জেলাভিত্তিক তালিকাটির অনুলিপি প্রতিটি জেলার পুলিশ সুপার বরাবর পাঠানো হয়েছে। সেই তালিকা ধরেই জেলা পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে অভিযান চালিয়ে আসছে। পুলিশ সদর দফতরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শনাক্ত হওয়া জঙ্গীদের বাইরে আরও কিছু জঙ্গী রয়েছে। তারা বেনামে থাকায় তাদের সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। তবে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করার প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে, রিমান্ডে আসার পর জঙ্গীদের দেয়া তথ্য। জঙ্গীদের জবানবন্দীতে নতুন কোন জঙ্গী সংগঠন বা জঙ্গীর নাম এলে তার বিষয়ে গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নতুন তথ্য দেয়া জঙ্গীদের বার বার রিমান্ডের পাশাপাশি টিএফআই সেলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পুরো প্রক্রিয়াটি পুলিশ সদর দফতরের একটি বিশেষ সেল মনিটরিং করছে। মনিটরিং করা হচ্ছে, ডিজিটাল পদ্ধতিতে। জঙ্গীদের সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য কম্পিউটারে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে তালিকা করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেফতারকৃত, গ্রেফতারের বাইরে দেশে ও বিদেশে থাকা, জঙ্গী সংগঠন অনুযায়ী জঙ্গীদের তালিকা, অপারেশনাল কর্মকা-ে জড়িত জঙ্গীদের তালিকা, তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে জড়িত জঙ্গীদের তালিকা, সুইসাইডাল স্কোয়াডসহ নানা ভাগে ভাগ করে তালিকা করা হয়েছে। পাশাপাশি সন্দেহভাজন জঙ্গীদেরও একটি তালিকা করা হয়েছে। জঙ্গীদের অর্থায়নকারী দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি, এনজিও, রাজনৈতিক দল, দূতাবাসেরও একটি তালিকা করা হয়েছে। যেসব শিক্ষা, আর্থিক, বাণিজ্যিক, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন জঙ্গী তৎপরতায় জড়িত তাদেরও একটি পৃথক তালিকা করা হয়েছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির ওপর নজরদারি চলছে। বিশেষ নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে জঙ্গী অর্থায়নকারী ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে। বাংলাদেশে জঙ্গী অর্থায়ন ও মদদদানের জন্য তালিকাভুক্ত তিনটি দূতাবাস ও পাঁচটি ব্যাংক ছাড়াও কয়েকটি বীমা, লিজিং কোম্পানি ও কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিশেষ নজরদারিতে রয়েছে। জঙ্গীবাদের জন্য ব্যবহারের অভিযোগ থাকা দেশের পাঁচটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, দুইটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর কড়া নজরদারি চলছে। এছাড়া কারাগারে থাকা দেশী-বিদেশী জঙ্গীদের ওপরও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। তাদের জামিন থেকে শুরু করে আদালতে হাজির করা পর্যন্ত, প্রতিটি ঘটনাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে তাৎক্ষণিকভাবে জানানোর জন্য কারা অধিদফতরকে নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ডিসেম্বর থেকে আবার জোরালো অভিযান শুরু হচ্ছে। এবার বিশেষ অভিযান চলছে দেশের সব বিভাগীয় শহরে। বিভাগীয় শহরের মধ্যে থাকা বস্তিগুলো ছাড়াও গার্মেন্টস শিল্প এলাকা এবং এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের বসবাসকারী স্থানগুলোতে। এছাড়া বাংলাদেশ-ভারত স্থল সীমান্তের সিলেট, সাতক্ষীরা, যশোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, কুমিল্লাসহ প্রতিটি সীমান্ত জেলাগুলোতে বিশেষ অভিযান চলবে। এসব জেলায় অনেক জঙ্গী আত্মগোপনে রয়েছে। যারা সুযোগ বুঝে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। যাদের অধিকাংশই খুবই দুর্ধর্ষ। তাদের গ্রেফতার করতেই এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে গিয়ে আত্মগোপনে থাকা সম্ভাব্য জঙ্গীদের পৃথক তালিকা দেয়া হচ্ছে। আগে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে জঙ্গীদের একত্রে তালিকা করে দেয়া হতো। হালে সে প্রক্রিয়া থেকে সরে এসে শুধু জঙ্গীদের আলাদা তালিকা তৈরি করে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে দেয়া হচ্ছে। পেশাদার অপরাধীদের চেয়ে ভারত দুর্ধর্ষ জঙ্গীদের গ্রেফতারে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। এজন্য দেশটির তরফ থেকেও জঙ্গীদের আলাদা তালিকার কথা বলা হয়েছে। ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পেশাদার অপরাধীদের চেয়ে জঙ্গীরা দুই দেশের জন্যই বেশি ভয়ঙ্কর বলে মনে করে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের খাগড়াগড়ে জেএমবির বোমা তৈরির কারখানায় বিস্ফোরণের পর ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গীদের গ্রেফতারে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। সূত্রটি বলছে, গত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর লাপাত্তা হয়ে গেছে আট শতাধিক জঙ্গী। তাদের অনেকেই সাঁড়াশি অভিযানে গ্রেফতার হলেও, অধিকাংশই গ্রেফতারের বাইরে রয়েছে। আত্মগোপনে থাকা এসব জঙ্গীদের অনেকেই গত কয়েক বছরে ঘটে যাওয়া নৃশংস হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত। যাদের অনেকেই এখনও গ্রেফতারের বাইরে রয়েছে। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের গোপনীয় শাখার সহকারী উপমহাপরিদর্শক মনিরুজ্জামান জানিয়েছেন, জঙ্গীদের ডাটাবেজ তৈরির কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। জেলা পর্যায়েও এ সংক্রান্ত কাজ চলছে। সেই সঙ্গে চলছে অভিযান।
×