ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

আকিল জামান ইনু

নরেন্দ্র মোদি ॥ কালো টাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও প্রতিক্রিয়া

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২৭ নভেম্বর ২০১৬

নরেন্দ্র মোদি ॥ কালো টাকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও প্রতিক্রিয়া

নরেন্দ্র মোদি। নিজের রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে মডেল হিসেবে উপস্থাপন করে সর্বভারতীয় ভোটযুদ্ধে কেড়ে নিয়েছেন আম জনতার হৃদয়। ফলাফল তিনি আজ ভারতের প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে আমরা যেমন তাকে ক্লিন ইন্ডিয়ার নামে ঝাড়ু হাতে পথে দেখেছি তেমনি দেখেছি জাতপাত নিয়ে বিব্রত নানা সময়ে। তবে সব আলোচনা সমালোচনা আর ধারণার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে সাম্প্রতিক নেয়া ৫০০ ও ১০০০ রুপী বাতিলের নাটকীয় সিদ্ধান্তটি। নোট বাতিল বা পরিবর্তন অর্থনীতিতে নতুন কোন ঘটনা নয়, কিন্তু নরেন্দ্র মোদি যে পদ্ধতিতে এটি করলেন তাকে নাটকীয় বললেও কম বলা হয়। কোন আলোচনা, পূর্বাভাস ছাড়াই এমনকি নিজের কেবিনেট সহকর্মীদেরও অন্ধকারে রেখে রাতে সিদ্ধান্ত ও সকাল থেকে কার্যকর! যা কেবল ভারত নয় বিশ্ব অর্থনীতি বোদ্ধাদের হতবাক করে দিয়েছে। কিন্তু কেন এই সিদ্ধান্ত? এ ধরনের সিদ্ধান্তের ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়া কতটুকু বিবেচনায় ছিল নরেন্দ্র মোদির? দেশে ও দেশের বাইরে এর প্রভাব কতটা বিবেচনায় নিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি ও তার উপদেষ্টারা। এই সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে মোদি প্রথমে সামনে এনেছিলেন পাকিস্তান ও আইএসআই কর্তৃক সরবরাহকৃত জাল টাকা প্রতিরোধ। সম্ভবত ক্ষমতাবান কালো টাকার মালিক যাদের উদ্দেশ্যে এই পদক্ষেপ তাদের মুখোমুখি হতে কিছুটা সময় প্রয়োজন ছিল তার। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার মূল উদ্দেশ্যটি সামনে চলে এসেছে সেটি হলো তার এই সিদ্ধান্ত কালো টাকার বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ। আর যুদ্ধের কেন্দ্রে যখন অর্থ তখন তা নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা ও বিতর্কের ঝড় উঠবে সেটাই স্বাভাবিক । উঠেছেও তাই। ব্যাংক আর এটিএম বুথে দীর্ঘলাইনে দাঁড়ানো জনতার তীর্যক মন্তব্য। চায়ের দোকান থেকে ফেসবুকে আলোচনার ঝড়। আত্মহত্যা, টাকা ভাঙানোর লাইনে দাঁড়িয়ে মৃত্যু। বস্তা ভরা পরিত্যক্ত কালো টাকার সন্ধান। মোদির বৃদ্ধ মায়ের রুপী বদলাতে লাইনে দাঁড়ানোর চিত্র, বিয়ে করতে যেয়েও টাকার অভাবে ভুগছে পাত্রপাত্রী, টাকা ভাঙানোর সময় অমোচনীয় কালির ব্যবহার বির্তক, মমতার মোদিকে ধুয়ে দেয়া থেকে আদালতের আদেশ, এ সবই ঘটছে ভারতজুড়ে।বিষয়টি কেবল অর্থনীতি আর রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নেই। গড়িয়েছে আদালতে। কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ সরকারের সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপে অস্বীকৃতি জানালেও দিয়েছে কিছু পর্যবেক্ষণ। তাদের মতে, ‘টাকা বাতিলের মতো এত বড় একটা সিদ্ধান্তের আগে আম জনতার ভোগান্তি কমানোর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি সেভাবে। সিদ্ধান্ত পরবর্তী বাস্তব পরিস্থিতি কেন্দ্রের আরও ভালভাবে বিবেচনায় নেয়া উচিত ছিল। প্রতিদিন নতুন নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ প্রমাণ করে এ ব্যাপারে সরকারের আগাম কোন পরিকল্পনা ছিল না।’ আর সুপ্রীমকোর্ট অনেক বেশি খড়গহস্ত এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে। সরকারের অর্থনৈতিক নীতিতে হস্তক্ষেপে অস্বীকৃতি জানিয়ে, প্রধান বিচারপতি টিএস ঠাকুর সরকারকে ভর্ৎসনা করেছেন নোট বদলের উর্ধসীমা ২ হাজার করা নিয়ে। আদালত সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর আদেশ দেন এ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতাগির একটি আবেদনে। মুকুল নোট বাতিল সংক্রান্ত মামলা অন্য কোন আদালতে গৃহীত হবে না বলে নির্দেশ প্রার্থনা করেন। বিচারপতির পরিষ্কার জবাব ছিল, “এটা রীতিমতো গুরুতর বিষয়। কিছু ব্যবস্থা নেয়া দরকার। দেখুন, লোকের কি ধরনের সমস্যা হচ্ছে। মানুষকে হাইকোর্টে যেতে না দিলে আমরা সমস্যাটা বুঝব কি করে? লোকে যে আদালতের শরণাপন্ন হচ্ছে এ থেকে বোঝা যায় সমস্যার গভীরতা। তাই তাদের কাছে হাইকোর্টের দরজা বন্ধ করে দিতে পারি না।” এনিয়ে প্রকাশ্য আদালতে তর্কে জড়ান এ্যাটর্নি জেনারেল ও কংগ্রেস নেতা আইনজীবী কাপিল সিবাল । সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি পরিষ্কার মোদির মূল যুদ্ধটি কালো টাকা তথা প্রভাবশালী কালো টাকার মালিকদের বিরুদ্ধে। খাপখোলা তলোয়ার হাতে তিনি নেমেছেন এই যুদ্ধে। কন্যা কুমারী থেকে হিমালয় পর্যন্ত ভোগান্তির শিকার আম জনতা, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সব মেনে নিলেও মোদির মূল উদ্দেশ্য কতটুকু সফল হবে প্রশ্ন সেটিই । বিশ্বব্যাংকের ৮ বছর আগের হিসাব বলছে ভারতে কালো টাকার পরিমাণ জিডিপির ২৩.২%। বর্তমানে এই পরিমাণ প্রায় ২৫%। ২০১৬ তে ভারতের জিডিপি প্রায় ১৫০ লাখ কোটি টাকা। সেই অর্থে কালো টাকার অর্থনীতি ৩৭.৫ লাখ কোটি। সমস্যা হলো এই টাকার ৯০% দেশের বাইরে। এ ছাড়া স্থাবর সম্পদের বাইরে দেশে নগদ রয়েছে মাত্র ৩%। যার পরিমাণ সর্বোচ্চ ২ লাখ কোটি টাকা। পর্যবেক্ষণ বলছে নগদ কালো টাকার মালিকরা শাস্তি ও হাজারো আমলাতান্ত্রিকতার আশঙ্কায় এই টাকা কতটা প্রকাশ্যে আনবেন তা প্রশ্নসাপেক্ষ। আর এখন পর্যন্ত এই টাকা প্রকাশ্যে আনলে তারা কতটুকু আইনগত মার্জনা পাবেন তাও অজানা। এ কথা সত্যি কালো টাকা সাধারণত বড় নোটে নগদ সংরক্ষণ করা হয় যার বিপুল পরিমাণ সংরক্ষণ কেবল ক্ষমতাবান বা ধনীদের পক্ষেই সম্ভব। অনেকেই আশঙ্কা করছেন এই টাকা স্রেফ মুছে যাবে অর্থনীতি থেকে। নোট বাতিলের কারণে পরবর্তী ছয় মাস প্রবৃদ্ধি ৫.৮% নেমে আসার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। এই সিদ্ধান্তে মূল ভোগান্তির শিকার হয়েছে সাধারণ জনতা। সাধারণ ব্যবসায়ী যাদের কারবার নগদে। পেশাজীবীদের নগদ আয়ও ধাক্কা খেয়েছে। তবে কার্ড হোল্ডার বা চাকরিজীবীদের ভোগান্তি কিছুটা কম। এই বিচ্ছিন্ন সাধারণ জনতার ধাক্কা যে সংগঠিত শিল্পের গায়ে আছড়ে পরবে সে ইঙ্গিতও স্পষ্ট। সারাদেশে কাঁচামালের দাম কমেছে এতে ক্রেতারা লাভবান হলেও প্রান্তিক চাষীরা তাদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠবেন কি করে তাও প্রশ্ন। ভারত এখনও কৃষিনির্ভর যেখানে কারবার নগদ টাকার। রুপীর পরিবর্তন ধাক্কা দিয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতিকে। সঞ্চয় থেকে আবাসন, চাকরিবাজার সব কিছুতেই প্রভাব ফেলেছে রুপীর এই পরিবর্তন। মোদির এই সিদ্ধান্ত প্রভাব ফেলেছে প্রতিবেশী দেশগুলোতেও। সুপ্রীমকোর্টের প্রধান বিচারপতি বলছেন দাঙ্গা বেঁধে যেতে পারে মোদির এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে। বিবেচ্য হলো এই সিদ্ধান্ত কতটা কার্যকর হবে কালো অর্থনীতিকে রুখতে? বিশ্ব অর্থনীতি যখন গভীর সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তখন এ ধরনের সিদ্ধান্ত কতটা সুফল বয়ে আনবে তা নিয়ে সন্দিহান ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও অর্থনীতিবিদ-মনমোহন সিং। কিন্তু সবকিছুর পরেও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আপামর জনসাধারণ এই সাময়িক ভোগান্তি মেনে নেবেন বলেই ধারণা। আর কালো টাকা উদ্ধারে নরেন্দ্র মোদি কতটুকু সফল হবেন সে প্রশ্নে না যেয়েও বলা যায়। কালো টাকার বিরুদ্ধে তার এই সিদ্ধান্তটি একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত বলেই বিবেচিত হবে। কালো টাকাধারী ক্ষমতাবানদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নরেন্দ্র মোদির সাফল্য অর্থনীতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করবে তেমনি কালো অর্থনীতিতে আক্রান্ত দুর্নীতির উদাহরণ হয়ে থাকা দেশগুলোর জন্য তার এই সিদ্ধান্ত হতে পারে অনুসরণীয়। আর কালো টাকাধারীদের মোদির এ সিদ্ধান্ত যে বিপাকে ফেলেছে আপাত দৃষ্টিতে সেটিও কম সাফল্য নয়।
×