ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

অত্যাধুনিক এটিএম সিস্টেম নেই

বছরে হাজার কোটি টাকার ওভারফ্লাইং নেভিগেশন ফি হাতছাড়া

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১৮ নভেম্বর ২০১৬

বছরে হাজার কোটি টাকার ওভারফ্লাইং নেভিগেশন ফি হাতছাড়া

আজাদ সুলায়মান ॥ অত্যাধুনিক মানের এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট (এটিএম) সিস্টেম না থাকায়-নতুন সমুদ্রসীমা থেকে কোন নেভিগেশান চার্জ আদায় করতে পারছে না সিভিল এভিয়েশন। এ কারণে শুধু বিদেশী এয়ারলাইন্সের কাছ থেকেই বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ওভারফ্লাইং নেভিগেশন ফি আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। অচিরেই যাতে নতুন সমুদ্রসীমা থেকে বাড়তি রাজস্ব আদায় করা না যায় সেজন্য দেশী-বিদেশী একটি সিন্ডিকেটও সক্রিয় রয়েছে। এ সিন্ডিকেটের কারণেই নানা বাধার সম্মুখীন হচ্ছে সিভিল এভিয়েশন। পুরনো রাডার দিয়েই কাজ চালানোর জন্য সক্রিয় হয়ে উঠেছে এ চক্রটি। এটা আঁচ করতে পেরে সরকার দ্রুততম সময়ে পিপিপি-এর আওতায় এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট প্রকল্প হাতে নেয়। কিন্তু ওই কাজের দরপত্রে অংশ নিয়ে ব্যর্থ হয়ে এখন নতুন রাডার স্থাপন না করে পুরনো রাডার দিয়ে কাজ চালানোই এদের টার্গেট। এতে একদিকে যেমন পুরনো রাডার রক্ষণাবেক্ষণের নামে লুটপাট ও কমিশন বাণিজ্যের সুযোগ থাকছে-তেমনি বিদেশী এয়ারলাইন্সের কাছ থেকেও আর্থিক ফায়দা লোটার সুযোগ থাকছে। বিএনপি জামায়াতের চিহ্নিত এ চক্রটি একের পর এক মামলা করেও প্রকল্পটির ভবিষ্যত অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। জানা যায়- এ প্রকল্পের আওতায় অত্যাধুনিক এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট চালু করা গেলে সিভিল এভিয়েশনের আয় বাড়বে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ। কেননা নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক সালিশী আদালতের (পিসিএ) রায়ে বাংলাদেশ ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার সামুদ্রিক সীমা পেয়েছে। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ নতুন যে অংশ পেয়েছে ওই এলাকা দিয়েই বিশ্বের অধিকাংশ এয়ারলাইন্স ফ্লাইট পরিচালনা করছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সীমানার ওপর দিয়ে দিনে ৪শ’ বিদেশী ফ্লাইট আসা-যাওয়া করছে। ভারতের কাছ থেকে নতুন অংশ পাওয়ায় এ ফ্লাইট সংখ্যা দ্বিগুণের চেয়েও বেশি হবে। এতদিন ভারত ওইসব ফ্লাইটের কাছ থেকে ওভারফ্লাইয়িং ফি আদায় করেছে। বাংলাদেশ এতদিন ধরেই বঞ্চিত এ আয় থেকে। কেননা বর্তমান রাডার সিস্টেম বর্ধিত সমুদ্রসীমার ওপর দিয়ে যেসব এয়ারক্রাফট যাচ্ছে সেগুলো ধরতে পারছে না। এসব এয়ারক্রাফটের ওপর কোন চার্জও ধরা যাচ্ছে না। মান্ধাতা আমলের পুরনো রাডারের কারণে বাংলাদেশের আকাশসীমার মধ্যেও অনেক এয়ারক্রাফটের অবস্থানও ধরা যাচ্ছে না। সিভিল এভিয়েশন বর্তমানে শুধু ওভারফ্লাইং খাত থেকে বছরে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা আয় করছে। নতুন সমুদ্রসীমার ওপর এ্যারোনটিক্যাল চার্জ আদায় কার্যকর হলে শুধু এ খাতের আয় বেড়ে দাঁড়াবে কমপক্ষে দেড় হাজার কোটি টাকা। এ অবস্থায় দ্রুত দেশের বর্ধিত সমুদ্রসীমার ওপর দিয়ে যাওয়া বিদেশী উড়োজাহাজের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ জন্য বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে জরুরী ভিত্তিতে রাডার ও কন্ট্রোল টাওয়ার প্রতিস্থাপনসহ এ সংক্রান্ত যাবতীয় কাজের একটি ধারণাপত্র তৈরির নির্দেশনা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সম্প্রতি পাঠানো এ সংক্রান্ত একটি বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে এ তথ্য জানা গেছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পরিচালক (ফ্লাইট অপারেশন) উইং কমান্ডার চৌধুরী জিয়া উল কবীর বলেন, বর্তমান রাডার ও কন্ট্রোল টাওয়ার সিস্টেম দীর্ঘদিনের পুরনো হওয়ায় এটি দিয়ে সব এয়ারলাইন্সের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন সমুদ্রসীমায় কোন এয়ারক্রাফট এলেও এই রাডার সেটা ধরতে পারে না। এ কারণে জরুরী ভিত্তিতে এয়ার কন্ট্রোল ম্যানেজমেন্ট (এটিএম) এর আওতায় রাডার ও কন্ট্রোল টাওয়ার বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে সিভিল এভিয়েশন। ইতোমধ্যে পিপিপির (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ) আওতায় রাডার ও কন্ট্রোল টাওয়ার নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলেছে। এর আওতায় চট্টগ্রামে ভার্চুয়াল রাডার (এডিএসবি এক্সচেঞ্জ বা অটোমেটিক ডিপেন্ডেন্ট সারভাইলেন্স ব্রডকাস্ট) তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে। নতুন রাডার প্রতিস্থাপন সংক্রান্ত ফাইলটিও শীঘ্রই ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পাঠানো হবে। এটা হয়ে গেলে নতুন সমুদ্রসীমার ওপর দিয়ে যে কোন এয়ারক্রাফট প্রবেশ করলেই বাংলাদেশ তার ওপর চার্জ আরোপ করতে পারবে। এতে সিভিল এভিয়েশনের আয় আরও ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ বাড়বে। সবচেয়ে বড় বিষয় পিপিপি প্রকল্পে এমন একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এডিএসবি চালু করা হবে- যা দিয়ে বাংলাদেশ ছাড়াও গোটা সমুদ্রসীমা এলাকার ছবি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ধারণ করা যাবে। তখন প্রতিটি উড়োজাহাজ চলাচলের নির্ভুল চিত্র পাওয়া যাবে। কেউ আর কিছু ফাঁকি দিতে পারবে না। এসব কারণেই পিপিপি প্রকল্পটি দেশের স্বার্থেই দ্রুত হওয়া উচিত। সিভিল এভিয়েশন সূত্র জানায়- আগামী পঞ্চাশ বছরের জন্য নিরাপদ আকাশসীমা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বল্প সময়ে স্বল্প ব্যয়ে নতুন রাডার সিস্টেম স্থাপনের সিদ্বান্ত নেয় বর্তমান সরকার। এককালীন বিপুল পরিমাণ আর্থিক ব্যয়ের সাশ্রয় বিবেচনা করে সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নতুন রাডারসহ এয়ার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সংস্কারের এই প্রকল্পটি পিপিপির (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ) মাধ্যমে করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির নির্দেশনা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত পিপিপি অফিস এবং সিএএবি এর তত্ত্বাবধায়নে গত ২২ জুন এ সংক্রান্ত দরপত্র জমা পড়ে। কিন্তুু দরপত্র জমাদানের পর থেকেই একটি দুষ্টচক্র প্রকল্পটি নস্যাত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। তারা ভিন্ন ভিন্ন নামে দরপত্র জমাদান করলেও পরদিনই দরপত্রের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নারাজি জানিয়ে সিএএবিতে একটি চিঠি দেয়। জবাবে সিএএবি ও পিপিপি অফিস তাদের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করলে এই চক্র শুরু করেছে নানান ধরনের অপকর্ম। এমনকি আদালতের আশ্রয় নিয়ে একই বিষয়ের ওপর বার বার মামলা করে কাজে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। সিভিল এভিয়েশন জানায়- সর্বাধুনিক রাডার ও কন্ট্রোল টাওয়ার স্থাপনের এই প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর দফতরাধীন পিপিপি সেল- এর প্রথম আনসলিসিটেড প্রকল্প। পিপিপির মাধ্যমে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে সিএএবি এর কোন অর্থ ব্যয় হবে না বরং আগামী ২০ বছরে সরকার ২ হাজার কোটি টাকার বেশি আয় করতে পারবে। পিপিপি’র আওতায় ১০ বছর পর্যন্ত বিনামূল্যে রাডার রক্ষণাবেক্ষণ, খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ ও রাডার অপারেটর এবং সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীসহ আনুমানিক ১৫০ জনকে দেশে ও বিদেশে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। যারা প্রকল্পটির কার্যাদেশ পাবে তাদের আগামী ১০ বছরের মধ্যে তাদের খরচসহ লাভের একটি অংশ দেয়া হবে। কারিগরি মূল্যায়নে উত্তীর্ণ প্রতিষ্ঠান মেসার্স করিম এ্যাসোসিয়েটস তাদের আর্থিক প্রস্তাবে ১০ বছরের জন্য মোট ১,৭৫৫ কোটি টাকা প্রস্তাব করেছে যার নেট মূল্য আনুমানিক ৫০০ কোটি টাকা। অথচ এই প্রকল্পটি সিএএবি কর্তৃপক্ষ পিপিপি ছাড়া নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়িত করলে ব্যয় দাঁড়াত ৮০০ কোটি টাকার চেয়েও বেশি। পিপিপি’র মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সিএএবি তথা সরকারের প্রাক্কলিত অর্জন হবে ন্যূনতম ৩০০ কোটি টাকা। পক্ষান্তরে, সিএএবি প্রকল্পের এই ৭০০ কোটি টাকা ব্যাংকে এফডিআর হিসেবে গচ্ছিত রাখলে পিপিপি খাতে ১৭৫৫ কোটি টাকা খরচের পরেও সিএএবি এর অর্জন হবে ২০০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ পিপিপি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সিভিল এভিয়েশানের ব্যাপক আর্থিক ও প্রযুক্তিগত মুনাফা হবে। এ সম্পর্কে জানা যায়- মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত প্রস্তাবে যে দর উল্লেখ করা হয়েছে তার প্রয়োজনীয়তা ও যৌক্তিকতা খতিয়ে দেখতে ইতোমধ্যে ঢাকায় এসেছেন আইকাও এর টিসিবি এক্সর্পাট মি. নিকস কামভিসিস। তিনি এ প্রকল্পের প্রস্তাব মূল্যায়ন করে মতামত দেয়ার পরই ফের পাঠানো হবে মন্ত্রণালয়ে। যাতে এ নিয়ে কোন বিতর্ক না থাকে। আন্তর্জাতিকভাবেও প্রকল্পটির স্বচ্ছতা বজায় রাখার জন্য এমন উদ্যোগ নিয়েছে সিভিল ্এভিয়েশন। বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেছেন- এ ধরনের এয়ারট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট আমাদের আরও আগেই চালু করা দরকার ছিল। এখন একটা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। পিপিপির দেয়া দরদাম চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। এ প্রকল্পের প্রস্তাব মন্ত্রণালয় থেকে সিভিল এভিয়েশনে পাঠানো হয়েছে প্রস্তাবিত দরদাম যুক্তিসঙ্গত কিনা সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। সেখান থেকে অনুমোদিত হয়ে আসলে যাবে মন্ত্রিসভা ক্রয় কমিটিতে। এভাবেই স্বচ্ছতা বজায় রেখে এ প্রকল্প চূড়ান্ত অনুমোদনের পর বাস্তবায়ন করা হবে। তিনি বলেন-আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিরাপদ বিমান চলাচলে এয়ারট্রাফিক ম্যানেজমেন্টেরও আধুনিকায়ন করতে হবে। সে জন্যই পিপিপি‘র আওতায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে সরকারী অর্থের সাশ্রয় হবে। বাংলাদেশের আকাশসীমাও থাকবে নিরাপদ।
×