ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

নদীর অভ্যন্তর কিংবা পাড়ে ধর্মীয় উপাসনালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থানান্তর ও উচ্ছেদে গঠিত কমিটিরও নেই কোন অগ্রগতি

দখলমুক্ত করা যাচ্ছে না ॥ স্পর্শকাতর স্থাপনার কারণে ঢাকার চার নদী

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১২ নভেম্বর ২০১৬

দখলমুক্ত করা যাচ্ছে না ॥ স্পর্শকাতর স্থাপনার  কারণে ঢাকার চার নদী

তপন বিশ্বাস ॥ ধর্মীয় উপাসনালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থাপনা গড়ে উঠায় ঢাকার চারপাশে নদী দখলমুক্ত করা যাচ্ছে না। মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন এসবের কাছে নিতান্তই অসহায় হয়ে পড়েছে। তালিকা তৈরি করে এসব প্রতিষ্ঠান স্থানান্তর ও উচ্ছেদে কমিটিও গঠন করা হয়। এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এ বিষয়ে কোন অগ্রগতি নেই। স্পর্শকাতর এসব স্থাপন উচ্ছেদে কেউ দায়িত্ব নিতে চায় না। নদী দখল করা প্রতিষ্ঠানের তালিকাতেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে এ সকল উদ্যোগ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিগত বছরের ২৬ আগস্ট নদীর নাব্য ও স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ অব্যাহত রাখা সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সভায় নদীর তীর থেকে অবৈধ ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থানান্তর ও উচ্ছেদের উদ্যোগ নেয়া হয়। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান এতে সভাপতিত্ব করেন। সভায় অবৈধ ধর্মীয় উপাসনালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থানান্তর ও উচ্ছেদের বিষয়ে সুপারিশ দিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব নাসির আরিফ মাহমুদকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ধর্মীয় নেতা ও মাঠ প্রশাসনের প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত এ কমিটির সদস্য সচিব করা হয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক যুগ্মসচিবকে। কমিটিকে সরেজমিন তদন্ত করে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও কোন প্রতিবেদন দিতে পারেনি ওই কমিটি। গত বছরের ১ ডিসেম্বর কমিটির প্রধান নাসির আরিফ মাহমুদকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক যুগ্মসচিব এ বিষয়ে বলেন, আমরা এখনও প্রতিবেদন দিতে পারিনি। দীর্ঘদিন কমিটির কোন সভা হয়নি। তবে আগের কমিটি প্রধান চলে যাওয়ার পর এখন বিষয়টি দেখছেন অতিরিক্ত সচিব আবদুল কুদ্দুস খান। বিষয়টি একেবারে থেমে গেছে তা নয়। আমরা শীঘ্রই সরেজমিন পরিদর্শনে যাব। আশা করছি, এবার বিষয়টি গতি পাবে। তিনি আরও বলেন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থানান্তর বা উচ্ছেদের বিষয়টি সংবেদনশীল। এজন্য আমরা ধীরে-সুস্থে এগোচ্ছি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে এ বিষয়ে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। তারা প্রচার চালিয়ে নদী দখল করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার খারাপ দিক নিয়ে মানুষকে বোঝাবে। আমরা কারও অনুভূতিতে আঘাত দিতে চাই না। ঢাকার চারপাশের শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু ও বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ত্রিশটি ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা করেছিল বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এর মধ্যে ২২ মসজিদ, তিনটি স্কুল ও কলেজ, দুটি মাজার, একটি মাদ্রাসা, একটি এতিমখানা ও একটি স্নানঘাট রয়েছে। বিআইডব্লিউটিএর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলো চিহ্নিত করে আমরা মন্ত্রণালয়কে তালিকা দিয়েছিলাম। সেগুলো এখনও আগের মতোই আছে। এর মধ্যে কেরানীগঞ্জে নদী দখল করে আরও একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত আমাদের বাধায় তা আর হয়নি। তিনি বলেন, নদীর মধ্যে গড়ে ওঠা ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সর্বশেষ অগ্রগতি আমার জানা নেই। টাস্কফোর্স সভায় গঠিত কমিটি এ বিষয়ে বলতে পারবে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অপর এক কর্মকর্তা বলেন, ঢাকার চারপাশে নদীর তীরে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠায় দেশের বিভিন্ন জায়গায়ও এ ধরনের প্রবণতা অনেকটা ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে ও নদী দখল করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কোন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে মসজিদ করার জন্য জমি ওয়াকফ করতে হয়। এটাই ধর্মীয় অনুশাসন, অনেকেই ধর্মীয় অনুশাসন অনুসরণ না করে নদী দখল করে মসজিদ নির্মাণ করছে। অবৈধ প্রতিষ্ঠান ॥ নদীর মধ্যে স্থাপন করা ২২ মসজিদের মধ্যে রয়েছে বুড়িগঙ্গার বাদামতলী স্টিমার ঘাটে বায়তুল আমান জামে মসজিদ। বেড়িবাঁধের ভেতর নদীর দিকে একতলা বিল্ডিংয়ের মসজিদটিতে একটি সেমিপাকা টিনশেড ছাড়াও সেমিপাকা বাথরুম রয়েছে। বাদামতলীর নবাববাড়ি ঘাটে রয়েছে চারতলা বায়তুল সালাম জামে মসজিদ। বাকল্যান্ড বাঁধ রোডের সদরঘাটে রয়েছে বায়তুন নাজাত জামে মসজিদ ও সদরঘাট ছিন্নমূল এতিমখানা। চারতলাবিশিষ্ট এ মসজিদটি নদীর মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে। শ্যামবাজারে নদীর মধ্যে গড়ে উঠেছে শ্যামবাজার জামে মসজিদ। দোতলা এ মসজিদটির তৃতীয় তলায় রয়েছে টিনের ছাপড়া। সূত্রাপুরে বুড়িগঙ্গার তীরে আরও রয়েছে উল্টিনগঞ্জ জামে মসজিদ। সূত্রাপুরে নদীর তীরে গড়ে উঠেছে দোতলা ভবনের মসজিদ নূর মোহাম্মাদীয়া। কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় টিনের ছাপড়া দেয়া আগানগর ডকঘাট মসজিদ। যদিও গত ১২ আগস্ট মসজিদটি উচ্ছেদ করা হয়েছে। এছাড়া নদীর মধ্যে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে কেরানীগঞ্জে তিনতলা পাকা বিল্ডিংয়ের জিঞ্জিরা ফেরিঘাট জামে মসজিদ, কেরানীগঞ্জের খোলামোড়া লঞ্চঘাটে একতলা খোলামোড়া ঘাট জামে মসজিদ, কেরানীগঞ্জের ফয়েজনগর শাহী জামে মসজিদ। কেরানীগঞ্জের মান্ডাইল জামে মসজিদ, কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরার টিকাজোর জামে মসজিদ, লালবাগের মুসলিমবাদ টাওয়ার জামে মসজিদ, লালবাগের রসুলবাগে বাইতুর রহমান জামে মসজিদ, লালবাগ কয়লাঘাটের তারা মসজিদ ও লালবাগ কামরাঙ্গীচর সরকার বাড়ির আল-আকসা জামে মসজিদও নদীর জায়গা দখল করে গড়ে উঠেছে। হাজারীবাগের খাজা বাবা ফরিদপুরী জামে মসজিদ, হাজারীবাগের চরকামরাঙ্গীর জান্নাতুল মাওয়া জামে মসজিদ, কামরাঙ্গীচরের পাকাপুল আশ্রাফাবাদের বাইতুর নুর জামে মসজিদ ও বাইতুল হোসনা জামে মসজিদ, দারুসসালামের গাবতলী বালুঘাট জামে মসজিদ ও উত্তরা পশ্চিমপাড়া আব্দুল্লাহপুরের বায়তুন নূর জামে মসজিদও নির্মিত হয়েছে নদীর জায়গায়। নদীর পাড়ে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বিদ্যালয় রয়েছে তিনটিÑ দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চর মীরেরবাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়, লালবাগের চররঘুনাথপুরে রয়েছে জিঞ্জিরা বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাজারীবাগের আর এন রোডে লালবাগ স্কুল এ্যান্ড কলেজ। হাজারীবাগ ইসলামবাগের চন্দ্রপাড়া খানকা শরীফ ও হাজারীবাগের এনডি রোডের আঃ রহিম চিশতী দরবার শরীফও অবৈধভাবে নদীর জায়গায় স্থাপিত হয়েছে। কামরাঙ্গীরচরের নিজামবাগের জামিয়া তালাবিয়া আশরাফুল উলুম মাদ্রাসা ও কামরাঙ্গীচরের আশরাফাবাদ মাদ্রাসাপাড়ার নূর এতিমখানারও কোন অনুমোদন নেই। বুড়িগঙ্গায় অনুমোদনহীন স্নানঘাট রয়েছে একটি। এটি হচ্ছে বীনাস্মৃতি স্নানঘাট।
×