ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘পুরো বিচার বিভাগ জিম্মি, রাষ্ট্রপতির নামে চালাচ্ছেন আইনমন্ত্রী’

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৮ নভেম্বর ২০১৬

‘পুরো বিচার বিভাগ জিম্মি, রাষ্ট্রপতির নামে চালাচ্ছেন আইনমন্ত্রী’

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধি জারি না হওয়ায় পুরো বিচার বিভাগ জিম্মি হয়ে আছে বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। মাসদার হোসেন মামলার রায় বাস্তবায়নের অগ্রগতি বিষয়ে শুনানিকালে সোমবার আপীল বিভাগ বলেন, সারা বিচার বিভাগ জিম্মি হয়ে আছে। কাজ করতে পারছে না। আপীল বিভাগ নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিধিমালা আগামী ২৪ নবেম্বরের মধ্যে গেজেট আকারে প্রণয়ন করতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে ঐদিন গেজেটটি আপীল বিভাগে দাখিল করতে বলা হয়েছে। আদালত বলেছেন, এটা শেষ সময়। আর কোন সময় দেয়া হবে না। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বে ৯ সদস্যের আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এ আদেশ দেন। রবিবার শুনানি শেষে মামলাটি সোমবার কার্যতালিকায় আদেশের জন্য ছিল। সে অনুযায়ী আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের কার্যতালিকার শীর্ষেই ছিল আবেদনটি। সোমবার সকালে শুনানির শুরুতে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ৮ সপ্তাহের সময় প্রার্থনা করেন আদালতে। সকালে চাকরিসংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের কাজ কতদূর এগিয়েছে সে বিষয়ে একটি এফিডেভিট দাখিল করেন এ্যাটর্র্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তাতে বলা হয়, চাকরির শৃঙ্খলা বিধির খসড়া রাষ্ট্রপতির দফতরে পাঠানো হয়েছে। হলফনামা দেখে আদালত বলেন, এটা কি হলো, এটা কথা হলো? অফিসিয়ালি বলছি। আমাদের যে সমস্যা সেটা লিখিতভাবে রাষ্ট্রপতির কাছে দিয়ে আসছি। আমরা কি এটা ফ্রিজ করে রেখে দিব? ড্রাফট পাঠিয়েছিলেন। আমরা কারেকশন করে দিয়েছি। হলফনামায় প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানোর কথা বলেছেন। কবে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করলেন। কি হলো কিছুইতো নেই। দুই মাস আগে আমরা এটা চূড়ান্ত করে দিয়েছিলাম। এখন বলছেন সেটার বিধিমালার খসড়া রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়েছেন। এর মধ্যে দুইবার রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা হয়েছে। সেসময় আমরা রাষ্ট্রপতির কাছে গেজেটের কথা বলেছিলাম। আমাদের কাছে ইনফরমেশন আছে, পুরো বিচার বিভাগ শৃঙ্খলার বাইরে চলে যাচ্ছে। আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। একজন তো রাষ্ট্রপতির কাছে অভিশংসন চেয়ে চিঠি দিয়েছেন। একজন অতিরিক্ত জেলা জজ রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি দেয় সাহস কত? আদালত বলেন, আপনি না পারলে বলেন, সারেন্ডার করেন। আমরা দেখছি। যে পিটিশন দিয়েছেন এটা ফলস স্টেটমেন্ট। এর কোন সত্যতা নেই। কবে এ বিধি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়েছেন তা সাড়ে এগারোটার মধ্যে বলেন। এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, উনিতো দেশের বাইরে। আপীল বিভাগ বলেন, সারা বিচার বিভাগ জিম্মি হয়ে আছে। কাজ করতে পারছে না। আপনাকে একটা শব্দ বাদ দিতে বলেছিলাম। পারেননি। একটির শব্দের জন্য বছরের পর বছর কেটে গেছে। এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এ মামলায় এর আগে অনেকবার দাঁড়িয়েছি। এটা অনেকটা আসামির মতো। আপীল বিভাগ বলেন, ১৪ বছর পার হয়ে যাচ্ছে মাসদার হোসেন মামলার আসল জিনিস বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তখন এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, হবে। এটাও হবে। আদালত বলেন, এমন কিছু বলবেন না। এর মধ্যে দুইবার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। মন্ত্রী বলতে পারবেন কবে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়েছেন। অক্টোবরের এ সপ্তাহ বা অমুক তারিখে। এটা এ্যাবসুলেটলি ভেইক। আড়াই মাস হয়ে গেছে কিছু করতে পারলেন না। তখন এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, কথা হয়েছে। দেখা হয়েছে। আমি নিজেও হাসপাতালে ছিলাম। আদালত বলেন, একটি দেশের একটি বিভাগ জিম্মি হয়ে থাকবে, এটা হতে পারে না। আপনাদের সুবিধার জন্য খসড়ায় লাল কালি দিয়ে মার্ক করে দিয়েছিলাম। একজন বিচারককে হাতে নাতে ধরে ফেললে তখন মিনিস্ট্রি বলে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য পাঠাবে। এভাবে কি চলবে? আর কতদিন অপেক্ষা করব। বিচার বিভাগ চলছে না। আদালত আরও বলেন, ৪টি বিধি করছেন। ১৭০ জন বিচারক বসে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। তাদের কোর্ট রুম নাই। একটা ভবন নির্মাণে তিন বছর সময় নেন। পরে বলেন বিদ্যুত নেই। সর্বশেষ আদেশে গেজেট প্রকাশ করতে বলেছি। রুল অব বিজনেস অনুসারে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা মন্ত্রণালয় নিয়ে নিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির দোহাই দিয়ে আইন মন্ত্রণালয় কাজ করছে। আমরা রুলস করেছি মাসদার হোসেনের মামলায় দেয়া গাইড লাইনের বাইরেও না। এখানে রাষ্ট্রপতির কথা নেই। জবাবে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন প্রস্তুতকৃত বিধিমালাটি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়েছে। আইনমন্ত্রী দেশের বাইরে আছেন, বিধি চূড়ান্ত করে গেজেট আকারে জারি করতে সময় প্রয়োজন। আপীল বিভাগ বলেন, আপনারা বারবার সময় আবেদন করছেন। আপনারা যদি ভেবে থাকেন রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করলেই তা মঞ্জুর করব, এটা দুর্ভাগ্যজনক। পরে আদালত ২৪ নবেম্বর দিন ধার্য করে দেন। এ পর্যায়ে এ্যাটর্নি জেনারেল আরও চারদিন সময় বাড়ানোর জন্য অনুরোধ জানান। কিন্তু আপীল বিভাগ আবেদনটি নাকচ করে দেন। আদালত আরও বলেন, শেষবারের মতো সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে বিধি চূড়ান্ত করে গেজেট আকারে জারি করবেন। এর আগে বিধি প্রণয়ন সংক্রান্ত এ মামলার শুনানি হয় গত ২৮ আগস্ট। সেদিনই ৬ নবেম্বর পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছিল। সোমবার আবার ২৪ নবেম্বর পরবর্তী দিন ঠিক করেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরি, নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা বিধান এবং চাকরির অন্যান্য শর্তাবলী) বিধিমালা-২০০৭ অনুযায়ী এখন অধস্তনও ও আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা পৃথক বিধি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত ১৯৮৫ সালের গবর্নমেন্ট সার্ভিস রুল অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হবে। ১৯৯৯ সালে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের ৭ নম্বর নির্দেশনা অনুযায়ী পৃথক শৃঙ্খলা বিধি তৈরি হয়নি। মাসদার হোসেন মামলার রায় ঘোষণার আট বছর পর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করা হয়। ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর মাসদার হোসেন মামলায় ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেয়া হয়। ওই রায়ের আলোকে নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা ছিল।
×