ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভোট দিতে পেরে খুশি ভোটাররা

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ১ নভেম্বর ২০১৬

ভোট দিতে পেরে খুশি ভোটাররা

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ ঘড়ির কাঁটায় তখন ৮টা বেজে ১৫ মিনিট। বিলুপ্ত দাসিয়ারছড়ার ছিটমহলের কালীরহাট গ্রামের সাইজন বিবি স্বামী আজগার আলী বয়স নব্বইয়ের কাছাকাছি জীবনে এই প্রথম ভোট দিতে এসেছেন। খুব খুশি এই প্রথমবার ভোট দিতে পেরে। শুধু তিনি একা নন কালীরহাটের বালাটারী গ্রামের মহম্মদ আলী, সখিনা বেওয়া সবাই এসেছেন ভোট দিতে। তারা এবার তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করবেন। তাড়াতাড়ি ভোট দেয়ার জন্য কাক ডাকা ভোরে উঠেছেন ঘুম থেকে। সবার আগে যেন লাইনে দাঁড়াতে পারেন এ আশায়। দাসিয়ারছড়ার মানুষের এই ভোট যেন ঈদের আনন্দ বইছিল সমস্ত এলাকায়। প্রায় দেড় বৎসর আগে বঞ্চিত আর লাঞ্ছনার জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিল তারা। দীঘ ৬৮ বৎসর পর এবার তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকের মর্যাদা পুরোপুরি লাভ করল ছিটবাসী। তাদের এ সুখ স্মৃতি যেন অম্লান হয়ে থাকবে। ছিটের বয়োবৃদ্ধরা বলছেন এখন তারা মরেও শান্তি পাবেন। তাদের এ আনন্দের দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান। তার জন্য দোয়া করেন। একই দিন পঞ্চগড় জেলার সাবেক ছিটগুলোতেও ভোট অনুষ্ঠিত হয়। এসব এলাকার ভোটাররাও জীবনে প্রথমবারের মতো ভোট দিতে পেরে খুশি বলে জানান পঞ্চগড়ের জনকণ্ঠ প্রতিনিধি। কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী ও ভুরুঙ্গামারী উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে সোমবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ভোটগ্রহণ চলাকালীন কোথাও কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। সারাদিনই জনকণ্ঠের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে গিয়েছিলেন। সব খানেই ছিল উৎসবের আমেজ। বিশেষ করে ছিটমহলগুলোর মানুষ এই ভোটকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে উঠেছিলেন। কালীরহাট গ্রামের নতুন প্রজন্মের এক ভোটার পাঁপড়ী এবার এইচএসসি পাস করেছে। বিভিন্ন কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছে। শুধু ভোট দিবে এ আশায় এসেছে বাড়িতে। সে জানায় দীঘদিন ছিটের মানুষরা ভোট বঞ্চিত ছিল। জীবনে প্রথমবার তাদের এলাকার মানুষের সঙ্গে সেও ভোট দিতে পেরে খুশি। একই এলাকার সখিনা বেগম (৫৮), আলীজন বেওয়া (৬৭) জানায় আগে ছিটমহলগুলোতে পঞ্চায়েত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো। এই নির্বাচন ছিটবাসীরা নিজেরাই করতেন। সরকারের এতে কোন সংশ্লিষ্টতা ছিল না। শুধু পুরুষদের ভোটে পঞ্চায়েত নির্বাচিত হতো। মহিলারা কোন ভোট দিতে পারত না। এভাবেই যুগের পর যুগ চলে আসছে। এই প্রথমবার মহিলারও ভোট দিতে পারল। ভীষণ খুশি তারা। কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ীর উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ারছড়া ও ভুরুঙ্গামারী উপজেলার ১০টি ছিটমহল মোট ১১টি বিলুপ্ত ছিটমহলে ৩ হাজার ২০৭ জন ভোটার। এর মধ্যে দাসিয়ারছড়ায় ২ হাজার ৯১৫ জন আর ভুরুঙ্গামারীতে ২৯২ জন ভোট প্রয়োগ করছেন। দাসিয়ারছড়ার ৪টি ওয়ার্ড ফুলবাড়ী ইউনিয়নে পড়েছে। দাসিয়ারছড়ায় শেখ ফজিলাতুন নেসা দাখিল মাদ্রাসায় একটি ভোট কেন্দ্র হয়েছে। এখানে পুরুষ ভোটার ৩৮২ জন। মহিলা ভোটার সংখ্যা ৪০৪ জন মোট ভোটার সংখ্যা ৭৮৬ জন এই কেন্দ্রে ভোট প্রয়োগ করেছেন। জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন হচ্ছে ফুলবাড়ী সদর, ভাঙ্গামোড় ও কাশিপুর। এখানে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দিতা করছেন ১৬ জন প্রার্থী। সংরক্ষিত আসনে ৫১ জন এবং সাধারণ সদস্য পদে প্রার্থী রয়েছেন ১০৭ জন। ৪৬টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে ১৮টি। এখানে মোট ভোটার ৭১ হাজার ৩৬৯ জন। ভুরুঙ্গামারী উপজেলার তিনটি ভুরুঙ্গামারী সদর, শিলখুড়ি ও পাথরডুবি ইউনিয়ন ভোট অনুষ্ঠিত হয়। এখানে ১৫ প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তিন ইউনিয়নে সংরক্ষিত আসনে ৩৩ এবং সাধারণ সদস্য পদে লড়ছেন ৯৪ প্রার্থী। এখানে মোট ভোটর সংখ্যা ৬৩ হাজার ৪২৩ জন। ছিটমহলের নতুন ভোটার ২৯২ জন। ভোট কেন্দ্র ৩৮টি মধ্যে ১৯টি কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ। পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত কাজলদিঘী ছিটমহলের বাসিন্দা হামিদা বানু (৭২)। নাতির হাত ধরে জীবনে প্রথম ভোট দিতে পেরে মহাখুশি। সকাল ন’টার মধ্যেই বোদেশ^রী সরকারী প্রাইমারী স্কুলের ভোট কেন্দ্রে এসে তার পছন্দের চেয়ারম্যান ও মেম্বার প্রার্থীদের ভোট দিয়েছেন। ভোট দিয়ে কেন্দ্র থেকে বের হয়ে হাসিমুখে বলেন, শেষ বয়সে প্রথম ভোট দিতে পেরে আমি আনন্দিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘ ৬৮ বছর পর ছিটবাসীদের বাংলাদেশী হিসেবে নাগরিকত্ব দিয়ে আজ ভোট দেয়ার সুযোগ করে দেয়ায় প্রধানমন্ত্রীর দীঘায়ু কামনা করছি। হামিদা বানুর মতো হাজারো বিলুপ্ত ছিটমহলের নারী ভোটার নির্বিঘেœ জীবনের প্রথম ভোটটি দিতে পেরে যারপরনাই আনন্দিত। এসব নারী ভোটার সাবেক ছিটমহল নাগরিক কমিটির ভোটেও ভোট দিতে পারত না। কোনদিনই তাদের ভোটাধিকার ছিল না। তাই এবার ছিটমহলের নারী ভোটারগণ নতুন শাড়ি-কাপড় পড়ে উৎসবমুখর পরিবেশে দলে দলে ভোট কেন্দ্রে এসে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। পঞ্চগড় জেলার বিলুপ্ত ৩৬টি ছিটমহলেই যেন উৎসবের আমেজ বিরাজ করছিল। এসব ছিটমহল লাগোয়া পঞ্চগড়ের ৩ উপজেলায় ৮টি ইউনিয়ন পরিষদে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। মোট ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৪০ হাজার ৩৮৫ জন। এর মধ্যে বিলুপ্ত ৩৬টি ছিটমহলের ভোটার ৮ হাজার ৯৩৫ জন। তিন উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহল সংযুক্ত ৮টি ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদে ৩৯ জন, সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে ৯৮ জন এবং সদস্য পদে ৩২৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সদর উপজেলার হাফিজাবাদ ইউপির পুকুরী ডাঙ্গা সরকারী প্রাইমারী স্কুল কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা বিলুপ্ত গাড়াতি ছিটমহলের বাসিন্দা আনোয়ারা (৫৭), হাছেনা বেগম (৪৮) বলেন, প্রথম ভোট, তাই খুব খুশি লাগছে। গাড়াতি ছিটের আরেক বাসিন্দা বেলাল হোসেন (৬০) বলেন, আমরা আর অন্ধকার জীবনের বাসিন্দা নই। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আমাদের আলোর পথে নিয়ে এসেছে, একটি স্বাধীন দেশের নাগরিকত্ব দিয়েছেন আর আজ পছন্দের প্রার্থীকে ভোটও প্রদান করলাম। এর মতো আনন্দ আর কি আছে আপনারাই বলুন। বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত হওয়া বিলুপ্ত শালবাড়ি ছিটমহলের ভোটার দিজেন্দ্র নাথ রায় বলেন, জীবনের প্রথমবার ভোট দিলাম, মনে অনেক আনন্দ পাচ্ছি। যোগ্য প্রার্থীকেই ভোট দিয়েছি। দেবীগঞ্জ উপজেলার চিলাহাটি ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত হওয়া বিলুপ্ত কাজলদিঘী ছিটমহলের নতুন ভোটার জয়নুল হক বলেন, সারাজীবন শুধু শুনেছি ভোটের কথা, কিন্তু এবার নিজের হাতে ব্যালটে সিল মেরে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করছি।
×