ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

ভালবাসার শক্তিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন জলি

এখনও ছুঁয়ে আছে দীপন, ওকে হারতে দেইনি

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৩১ অক্টোবর ২০১৬

এখনও ছুঁয়ে আছে  দীপন, ওকে হারতে দেইনি

মোরসালিন মিজান ॥ সুন্দর চলছিল জলি আর দীপনের। কী যে হাসিখুশি একটা জীবন! কিন্তু হঠাৎই সব তছনছ। অন্ধকারের শক্তি ছোঁ মেরে নিয়ে যায় ফয়সল আরেফিন দীপনকে। শৈশবের খেলার সাথী হারান রাজিয়া রহমান জলি। যৌবনে যে বন্ধুর হাত শক্ত করে ধরেছিলেন, সে হাত ফসকে যায়। পরস্পরের প্রতি ভালবাসা থেকে স্বপ্নের সংসার। অচিরেই দুই পুত্র কন্যা রিদাত ও রিদমা। এভাবে জীবন যখন সুখপাঠ্য কোন গল্পের বই, তখনই আসে আঘাত। বইয়ের পাতা রক্তাক্ত করে দেয় মৌলবাদীদের চাপাতি। অসংখ্য বইয়ের মতোই একটি বিজ্ঞানবিষয়ক বই প্রকাশ করেছিলেন দীপন। বন্ধু অভিজিত রায়ের লেখা। বইটি নিয়ে নির্বোধদের আপত্তি ছিল। তাতেই খুন হতে হয় জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধারকে। বিভৎস হত্যাকা-ের পর থেকে জলির চোখ ভর্তি জল। তবে এই সেই জল, ‘যে জলে আগুন জ্বলে’! প্রিয়জন হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করেছেন এই একলা যোদ্ধা। ঘরের দেয়ালে আসবাবে চায়ের কাপে প্রতি চুমুকে প্রিয় মানুষটিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। দীপন নিজেও নাকি তার কাছে আসেন। কথা বলেন। জলির দীপনই দীপ। দীপনই শক্তি। সেই শক্তিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। প্রিয়তমকে হারতে দেননি। পরাজিত হতে দেননি। অসীম সাহসী নারী ধ্বংস থেকেই জন্ম নিয়েছে পুনর্বার। প্রকাশনা শিল্পের মর্যাদা সচেতনভাবে অক্ষুণœ রেখেছেন। অক্ষুণœ রাখতে কাজ করে চলেছেন। আজ ৩১ অক্টোবর সোমবার। দীপন হত্যার প্রথম বার্ষিকী। গত এক বছর কেমন ছিলেন তার স্ত্রী? পিতৃহারা সন্তানরা? ভাল আছে তো? দীপনের স্বপ্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান জাগৃতির শেষ খবর কী? এমন বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গত শুক্রবার এই প্রতিবেদক কড়া নাড়েন ‘ডাক্তার বাড়ি’র দরজায়। হ্যাঁ, রাজিয়া রহমান জলি পেশায় চিকিৎসক। তার সরকারী বাসার দরজায় গ্রামীণ ঐতিহ্যের ছোঁয়া ‘ডাক্তার বাড়ি’ লেখা নেমপ্লেট। প্রবেশদ্বারটিও সুরুচির পরিচয় বহন করে। দেখে বেশ একটা অনুভূতি হয়। কিন্তু পাশেই যে কালো ফ্রেম, সেখানে নিহত প্রকাশকের ছবি। দেখে মন মুহূর্তেই বিষণœ হয়ে যায়। বিষণœতা যতটা সম্ভব আড়াল করে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা হয় জলির সঙ্গে। বেশ সাবলীল! হেসেই স্বাগত জানান। বাইরের মতো বাসার ভেতরটাও খুব নান্দনিক। জলি বললেন, সরকারী বাসা কেউ এভাবে সাজায় না। আমি আর দীপন ছিলাম পাগল। দুজনে মিলে নতুন করে গড়ে নিয়েছি। স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, ঘরের সব কাজ শেষ হওয়ার পর দীপন খুব আয়েশী ভঙ্গিতে বসে বলেছিল, বুঝলে, এখানে ২০ বছর থাকব! আমার চাকরি জীবনের পুরো সময়টা এই ঘরে এমন মায়ার পরিবেশে কাটাতে চেয়েছিল দীপন। হয়নি। জলিকে তাই হয়ত ঘরের ডেকোরেশনে হাত দিতে হয়েছে। এখন ঘরের সর্বত্রই দীপন আর দীপন শুধু। ঘরে পা রাখলে প্রথমেই যে ছবিটি, সেখানে চিবুক স্পর্শ করে থাকা দীপন। মিষ্টি হাসি এখনও অমলিন। বসার ঘরের এক কোণে ফ্যামেলি এ্যালবাম। বিভিন্ন ছবিতে প্রাণভোমরা হয়ে আছেন দীপন। অন্য একটি কোণে পুরনো চেয়ার। কৌতূহল নিয়ে তাকাতেই জলি জানালেন, এই সেই চেয়ার যেখানে বসে কাজ করা অবস্থায় খুন হন দীপন। বসার জায়গাটিতে তার ব্যবহৃত চশমা গুটিসুটি হয়ে আছে। লেখার কলম আর লেখে না। স্মারক হয়ে গেছে। জলি ও দীপনের সবচেয়ে পছন্দের জায়গা টি কর্নার। বারান্দায় বসে একসঙ্গে চা পান করতেন। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, দু’টি চেয়ার। ছোট্ট টেবিলে চায়ের কাপ। চিনি। জলি খুব সাধারণ বলার মতো করেই বলেন, এখনও ছেলেমেয়ে স্কুলে চলে গেলে আমরা এখানে বসে চা খাই। গল্প করি। জলিকে লেখা দীপনের অসংখ্য চিঠিও অবিকল আছে। সেই কবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে লেখা। আগলে রেখেছেন জলি। চিঠিগুলোতে প্রিয় মানুষটিকে খুঁজে ফেরেন তিনি। একটি চিঠির ভাষা এরকমÑ মনামী আমার, তোমার সব সাহস হব আমি। সব অহঙ্কার সর্বস্ব শুধু আমি। তোমার কিসের ভয়? তোমার কিসের সংশয়? আমাকে নিয়ে সমগ্র পৃথিবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবে না? যুদ্ধ জারি রেখেছেন জলি। চিঠির মতো দীপনের জামা জুতোগুলোও রেখে দিয়েছেন। জামাগুলো থেকে গুমোট গন্ধ আসতে শুরু করেছে জানিয়ে জলি বলেন, এগুলো ধুয়ে ইস্ত্রি করে রাখব। কিন্তু এখন পর্যন্ত নিজের ভেতরে সেই সাহস সঞ্চার করতে পারছি না। চেষ্টা করছি। পারব। এভাবেই প্রিয়জনকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। নিজের পাশে রেখে দিয়েছেন। তা-ই কি? জানতে চাইলে প্রথমবারের মতো আবেগঘন হয়ে ওঠে কণ্ঠ। জলি বলেন, আমার রাখার কিছু নেই। দীপন... কথা শেষ করতে পারেন না। কণ্ঠ বুজে আসে। এর পরও নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা। দীপন খুন হওয়ার দিনটিতে ফিরে গিয়ে বলেন, ও আছে। আমি বললে কেউ বিশ্বাস করবে না, ওই রাতটা দীপন আমাকে ধরে বসেছিল। ও একদম আমাকে ধরে বসেছিল। পরবর্তী দিনগুলোতে কতজনের কত কথা। আমাকে সবাই বিদেশ চলে যেতে বলছে। পালাতে বলছে। কিন্তু দীপন আমাকে ধরে ধরে বুঝিয়েছে। ডিসকাশন হয়েছে আমাদের। ও বলেছে, কেন দেশে থাকতে হবে। বলেছে, প্রত্যেকটা ফার্নিচারে তোমার আমার স্মৃতি। কেন ফেলে চলে যাবে? পরের কথাটি বলতে মেয়ের উদ্ধৃতি দেন। বলেন, এমনও হতো আমার মেয়েটা আমাকে বলত, মা, বাবা এইমাত্র গেল এখান দিয়ে, দেখ। এ পর্যায়ে কান্না আর ধরে রাখতে পারেননি। জলির ভেতরে গুমরে মরা কান্নাটি সজোরে সামনে আসে। আবেগ জড়ানো কণ্ঠে তিনি বলেন, আমি আমার ইউনিফর্ম পরা ছেলের শার্টের পকেটে টুপি গুঁজে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, পরীক্ষা শেষ করে সরাসরি বাবার জানাযায় অংশ নিও। সে তা-ই করেছিল। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে তিনি বলেন, আমি শুধু দীপনকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি এমন নয়। যার সাথেই দীপনের স্মৃতি আছে, তাদের কেউ তাকে ভুলতে পারবে না। দারোয়ান থেকে শুরু করে কলিগ অফিসের কর্মচারী যার যখন যেভাবে দরকার, দীপনকে তারা সেভাবে পেয়েছে। দীপন কোনদিন কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি। ওর মতো করে মানুষকে ও ভালবেসে গেছে। জলি নিজেও দীপনের ভালবাসা দ্বারা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত। ভালবাসার শক্তিই তাকে গুঁড়িয়ে যেতে দেয়নি। বরং ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি যুগিয়েছে। নতুনভাবে শুরু করেছে জাগৃতি। কীভাবে সম্ভব হলো এটা? জানতে চাইলে জলি বলেন, ফ্রম দি ভেরি বিগিনিং আমার একটা জিদ চেপে গিয়েছিল। এভাবে দীপনকে হারতে দেয়া যায় না। যত বড় অপশক্তিই আসুক, থামলে চলবে না। চেতনাতে কী নিয়ে বড় হলাম যে, পালাতে হবে? তাই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা। জাগৃতি বিক্রির প্রক্রিয়া থামিয়ে দেন জলি। স্বামীর রক্তাক্ত টেবিলে সাহস নিয়ে বসেন। বলেন, একটা মানুষকে ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি। আমি জানি, প্রকাশনাটা দীপনের স্বপ্নের জায়গা। আমি এটাকে এভাবে ছেড়ে দিতে পারি না। মানুষটা যদি এক্সিডেন্টে মারা যেত, রোগে মারা যেত, তাহলে জাগৃতি বন্ধ করার একটা কার্যকরণ পাওয়া যেত। কিন্তু যে পরিস্থিতিতে দীপনকে বিদায় নিতে হয়েছে, সেটা তো অস্তিত্বের ওপর আঘাত। প্রকাশনা শিল্পের ওপর আঘাত। এভাবে কোন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে কেউ আর এ পেশায় আসবে না। তাই জাগৃতি বাঁচানোটা ছিল আমার চ্যালেঞ্জ। আমার প্রতিবাদ। সে সময় অনেকে আমাকে সামনে রেখে প্রতিবাদ সমাবেশ মানববন্ধন করতে চেয়েছেন। আমি যাইনি। আমি প্রতিবাদ হিসেবে জাগৃতিকে দাঁড় করিয়েছি। শত্রুরা ধ্বংস করতে চেয়েছে। আমি হতে দেইনি। আদর্শ তো হত্যা করা যায় না। আদর্শ আমি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি। তবে কাজটা সহজ ছিল না। জলি জানান, দীপনকে প্রকাশনার কাজে তিনি সব সময়ই সাহায্য করেছেন। কিন্তু পুরো দায়িত্ব কাঁধে নেয়ার পর দেখা গেল, অনেক অনেক কঠিন। দীপন ব্যবসাটা খুব গোছালোভাবে করেনি। এলোমেলো ছিল। এ অবস্থায় দিন রাত কাজ করে সব গুছাতে হয়েছে। দীপন হত্যাকা-ের মাত্র তিন মাস পর অমর একুশে গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হয়। এত কম সময়ের মধ্যে নিজেকে সামলে নেয়া ছিল অসম্ভব ব্যাপার। অথচ জলি সবাইকে অবাক করে দিয়ে মেলায় অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সে কথা জানিয়ে বলেন, আমার ফ্যামেলি সঙ্গত কারণেই এ সিদ্ধান্ত মানতে চাইছিল না। বাচ্চারা পর্যন্ত বলছিল, তোমাকেও মেরে ফেললে আমাদের কী হবে? এর পরও থামিনি। মেলা হবে। দীপন থাকবে না। জাগৃতি থাকবে না। মেনে নিতে পারছিলাম না। তখন মনে হতো, আমাকে মেরে ফেললে আমি তো দীপনের কাছেই চলে যাব। সমস্যা নেই। অবশ্য শেষতক দীপনের কাছে যেতে হয়নি জলিকে। ভালবাসার টানে দীপন নিজেই মেলায় এসেছিলেন। জলির ভাষায়Ñ এটা কেউ বিশ্বাস করবে না, আমি যখন একুশের মেলায় স্টল করছি, আমার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জ্বর চলে এসেছে। এত ঠা-া বাতাস। আমার ১০৪ ডিগ্রী জ্বর। ওই রাতে স্বপ্নে দেখলাম, দীপন যে কী খুশি। মেলায় এসে আমাকে জরিয়ে ধরে বলছে, অনেক ভাল হয়েছে, জলি। এত সুন্দর হয়েছে স্টলটা...। কথা শেষ হয় না। দুমড়ে মুচড়ে বের হয়ে আসে কান্না। এমন সময় সামনে বসে থাকা যে কী বেদনার, তা লিখে প্রকাশ করা সত্যি দুরূহ কাজ। জলির চোখের দিকে তাকানোর সাহস হয় না। জলি চোখ মুচছেন। মেঝের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে হয়। তার পর বাকি কথাগুলো। জলি বলেন, পরে প্রমাণিত হয়েছে মেলায় অংশগ্রহণ সঠিক ছিল। তা না হলে তো দীপনের কোন চিহ্নই থাকত না মেলায়। ভবিষ্যতেও সকলের সহায়তায় যাত্রা অব্যাহত রাখতে চান জলি। বলেন, দীপন নিজের দেশ ও সংস্কৃতিকে ভালবাসত। সবার ছেলে মেয়ে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে। দীপন তার ছেলে মেয়েদের সাধারণ স্কুলে পাঠিয়েছে। নিজে যে উদয়ন স্কুলে পড়ত, সেখানেই পড়ে বাচ্চারা। অদ্ভুত তথ্য দিয়ে জলি বলেন, দীপন আমাদের কাউকে পাসপোর্ট করতে দেয়নি। বলত আগে নিজের দেশটা শিখুক ছেলে মেয়েরা। এমন সরলপ্রাণ মানুষটাকে ওরা মেরে ফেলল? এত সহজে খুন করা যায়? কষ্ট দিয়ে মারা যায়? জলি হয়ত এখনও ভাবেন। উত্তর পান না। বাংলাদেশ কি জানে উত্তরটা?
×