ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এগিয়ে যাচ্ছে ৫৩ নগর অঞ্চল ॥ পরিবেশবান্ধব উন্নয়নে

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ২২ অক্টোবর ২০১৬

এগিয়ে যাচ্ছে ৫৩ নগর অঞ্চল ॥ পরিবেশবান্ধব  উন্নয়নে

আনোয়ার রোজেন ॥ পরিবেশবান্ধব উন্নয়নে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের ৫৩ নগর অঞ্চল। ঢাকা ও খুলনা বিভাগের এসব নগরে অভাবনীয় সাফল্য আসছে যোগাযোগ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে। অনেকাংশে কমে এসেছে জলাবদ্ধতার প্রকোপ। বেড়েছে স্যানিটেশন ও সুপেয় পানির ব্যবহার। অন্ধকারের ‘অভিশাপ’ থেকে মুক্তি দিয়েছে সৌর বিদ্যুত। উন্নয়ন হয়েছে যাতায়াত ও যানবাহন অবকাঠামোর। খুলনা ও মংলা নগরসমূহ লবণাক্ততার প্রভাব থেকে অনেকাংশে রক্ষা পেয়েছে। ৫৩ নগরে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নও গতিশীল হচ্ছে। আর সাফল্যের এসব তথ্য পাওয়া গেছে সরকার গৃহীত ‘নগর অঞ্চল উন্নয়ন প্রকল্প’ থেকে। এমনই চিত্র তুলে ধরেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। সংস্থাটি সম্প্রতি প্রকল্পটির একটি নিবিড় মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করেছে। আইএমইডি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, প্রকল্পের আওতায় গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় স্যানিটেশন ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা হয়েছে। অফগ্রিড এলাকার দুটি ওয়ার্ড গাছা ও পুবাইলে সোলার লাইটের মাধ্যমে বিদ্যুত সরবরাহের ফলে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। অন্যদিকে প্রকল্পের আওতায় গৃহীত পদক্ষেপের কারণে খুলনার মংলা এলাকা লবণাক্ততার প্রভাব থেকে অনেকাংশে রক্ষা পেয়েছে। ব্রিজ-কালভার্ট ও রাস্তা নির্মাণের ফলে স্থলপথে যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছে। এ অঞ্চলের ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীরা অনেক দূর থেকে শহরে গিয়ে অফিস, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারছেন। আইএমইডি প্রকল্প এলাকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ঢাকা অঞ্চলের সুবিধাভোগীদের মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশ এবং খুলনা অঞ্চলের সুবিধাভোগীদের প্রায় ৮০ শতাংশ প্রকল্পের উন্নয়নজনিত সুবিধার তথ্য তুলে ধরেন। জানা গেছে, স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘নগর অঞ্চল উন্নয়ন’ প্রকল্পটি সরকারের একটি অন্যতম বড় প্রকল্প। প্রকল্পটি ঢাকা ও খুলনা অঞ্চলে দুটি বিভাগে ৫ সিটি কর্পোরেশন, ১২ পৌরসভা ও ৩৬ আরবান সেন্টার নিয়ে গঠিত। ঢাকা ও খুলনা নগর অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়ানো ও পরিবেশগত টেকসই উন্নতি সাধন করাই এর মূল লক্ষ্য। যার মধ্যে রয়েছে, নগর অঞ্চলের পরিবেশ ও স্থানীয় উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রধান প্রধান নগর অবকাঠামোর উন্নয়ন, আঞ্চলিক নগর পরিকল্পনার উন্নয়ন এবং কার্যকর ও টেকসই নগর উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌরসভাগুলোর ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি। এটি সরকারের ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রায় ১ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা ব্যয়ের এই মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে ২০১১ সালের জুলাই মাসে, যা চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ হওয়ার কথা। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি প্রায় ৭৩ শতাংশ। তাই নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রকল্পের সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। প্রকল্পের অর্থায়নে সহায়তা দিচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), কেএফডব্লিউ এবং সিডা। প্রকল্প এলাকা ॥ প্রকল্পের সংক্ষিপ্ত বিবরণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নগরায়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে একটি মহানগরী, তার আশপাশে অবস্থিত পৌরসভাসমূহ এবং সন্নিহিত আরবান সেন্টার নিয়ে নগর অঞ্চল গড়ে ওঠেছে। এই হিসেবে ‘নগর অঞ্চল উন্নয়ন প্রকল্পের’ আওতায় ৫৩ নগরের উন্নয়ন বাস্তবায়নের কাজ চলছে। এর মধ্যে রয়েছে ৫ সিটি কর্পোরেশন- ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ এবং খুলনা সিটি কর্পোরেশন। ১২ পৌরসভা- মানিকগঞ্জ, সাভার, নরসিংদী, কাঞ্চন, কালিয়াকৈর, সিংগাইর, তারাবো, সোনারগাঁও, নওয়াপাড়া, মংলা পোর্ট, ঝিকরগাছা এবং যশোর পৌরসভা। এবং ৩৬ উপজেলা আরবান সেন্টার- এর মধ্যে ঢাকা জেলার তিন, গাজীপুরের চার, নারয়ণগঞ্জের পাঁচ, খুলনার নয়, বাগেরহাটের নয় এবং যশোর জেলার ছয় উপজেলা আরবান সেন্টার হিসেবে প্রকল্প এলাকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আইএমইডির নিবিড় প্রতিবেদন ॥ প্রকল্পভুক্ত মোট এলাকার অর্ধেক (৫০ শতাংশ) এলাকায় সমীক্ষা চালিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে আইএমইডি। ৫ সিটি কর্পোরেশন হতে চার, ১২ পৌরসভা হতে ছয় এবং ৩৬ আরবান সেন্টার হতে ১৮ দৈবচয়নের ভিত্তিতে পরিদর্শনের জন্য নির্বাচন করা হয়। সংশ্লিষ্ট এলাকার সুবিধাভোগীদের মতামত নেয়ার জন্য পৃথকভাবে অন্তত ১০টি ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশনের (এফজিডি) ব্যবস্থা করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা অঞ্চলের সুবিধাভোগীদের মধ্যে ৯৫ শতাংশ এবং খুলনা অঞ্চলের সুবিধাভোগীদের প্রায় ৮০ শতাংশ মনে করেন তাদের এলাকায় ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ হওয়ার ফলে উৎপাদিত দ্রব্যাদি বাজারজাতকরণে সুবিধা হয়েছে। ঢাকা অঞ্চলের সুবিধাভোগীদের প্রায় ৯৬ শতাংশ এবং খুলনা অঞ্চলের সুবিধাভোগীদের প্রায় ৮৫ শতাংশ মনে করেন তাদের এলাকায় ব্রিজ কালভার্ট নির্মাণ হওয়াতে এলাকার কৃষকরা কৃষি পণ্যের সঠিক মূল্যায়ন পাচ্ছেন। দূর গ্রামাঞ্চল থেকে বড় বড় শহরে অফিস আদালতে যাওয়ার সুযোগের ক্ষেত্রে ঢাকা অঞ্চলের সুবিধাভোগীদের মধ্যে প্রায় ৯৬ শতাংশ এবং খুলনা অঞ্চলের সুবিধাভোগীদের প্রায় ৭৭ শতাংশ মনে করেন তাদের এলাকাতে ব্রিজ কালভার্ট হওয়াতে দূর গ্রামাঞ্চল থেকে বড় বড় শহরে অফিসে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। এ প্রসঙ্গে খুলনার বাসিন্দা ও জাতীয় গণমাধ্যমের কর্মী হাসান হিমালয় জনকণ্ঠকে বলেন, ২০১৩ সাল থেকে খুলনায় নগর অঞ্চল উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেকটা উন্নতি হয়েছে। তবে নদী ও খাল খননের যে সুফল পাওয়ার কথা, তা এখনও পাওয়া যায়নি। খুলনার আরেক গণমাধ্যমকর্মী উত্তম ম-ল জনকণ্ঠকে বলেন, ভৌত অবকাঠামো বেড়েছে। রাস্তা ঘাটের উন্নয়ন দৃশ্যমান। যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণের বিষয়টিও স্বীকৃতি পেয়েছে। এগুলো ইতিবাচক দিক। তবে জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি বলে তিনি মনে করেন। এদিকে স্বাস্থ্য সেবার জন্য বড় শহরে যাওয়ার সুযোগের ক্ষেত্রে ঢাকা অঞ্চলের সুবিধাভোগীদের মধ্যে প্রায় ৯৭ শতাংশ এবং খুলনা অঞ্চলের সুবিধাভোগীদের প্রায় ৮০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মনে করেন রাস্তাঘাট উন্নত হওয়াতে জনস্বাস্থ্য সেবার জন্য তারা বড় বড় শহরে যেতে পারছেন। ঢাকা অঞ্চলের সুবিধাভোগীদের মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশ এবং খুলনা অঞ্চলের ৮০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মনে করেন তাদের এলাকায় ব্রিজ কালভার্ট নির্মাণ হওয়াতে রাস্তার দুই পাশে দোকানপাট এবং শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। সৌর বিদ্যুতের কারণে বেড়েছে কর্মপরিধি। পুবাইলের বাসিন্দা আমজাদ হোসেন বলেন, আগে সন্ধ্যার একটু পরেই দোকানপাট বন্ধ হয়ে যেত। এখন রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত বাজার সরগরম থাকে। সৌর বিদ্যুতের কারণে এই পরিবর্তন এসেছে। বাস টার্মিনাল হওয়ায় এলাকায় কর্মসংস্থান ও ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করেন এফজিডিতে খুলনা অঞ্চলের অংশগ্রহণকারী ৫০ জন সুবিধাভোগী। সার্বিক বিষয়ে প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) আহসান হাবিব বলেন, প্রকল্পের আওতায় অনেক কম্পোনেন্ট রয়েছে। আরবান সেন্টার অংশ বাদে বাকি কম্পোন্টেগুলোর কাজ ৮০ ভাগ শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে প্রকল্পের সুফল মিলতে শুরু করেছে। পুরো ফল পাওয়া যাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের পর।
×