ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

বদলে যাচ্ছে গ্রামের জীবন, তাল মেলাচ্ছে শহরের সঙ্গে

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১৭ অক্টোবর ২০১৬

বদলে যাচ্ছে গ্রামের জীবন, তাল মেলাচ্ছে  শহরের সঙ্গে

সমুদ্র হক ॥ গ্রামের দৃশ্য পাল্টে গেছে। একদার কুঁড়েঘর, গোয়ালঘর, ঢেঁকি চোখে পড়ে না। বিদ্যুত পৌঁচ্ছে। যেখানে পৌঁছেনি সেখানে সোলার প্যানেল বসেছে। গ্রামের রাত এখন শহরের মতোই আলোকিত। পাকা সড়কে যন্ত্রচালিত যানবাহন চলছে। বড় নদী এলাকা ছাড়া খেয়া পারাপার নেই। পাকা সেতু হয়েছে। অভূতপূর্ব সাফল্য এসেছে কৃষিতে। সারা বছর কোন না কোন আবাদ হচ্ছে। বসে নেই কৃষক। ফুরসত নেই একদ-। কৃষির যাবতীয় কাজ এখন যন্ত্রে। কাজ জুটেছে এবং কাজ বেড়েছে গ্রামীণ নারীর। প্রতিযোগিতায় পুরুষের সমান্তরাল এগিয়ে যাচ্ছে নারী। একদার ‘মঙ্গা’ (তীব্র অভাব) এখন টেলিস্কোপেও খুঁজে পাওয়া যায় না। জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। খাদ্যাভাব নেই। উদ্বৃত্ত হয়ে চাল রফতানি শুরু হয়েছে। শহরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জীবন মান উন্নয়ন হয়েছে গ্রামে। দারিদ্র্য দ্রুত পালিয়ে যাচ্ছে। অতি দারিদ্র্যের হার ১১ বছর আগে ২ হাজার ৫ সালে যেখানে ছিল ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ, ২ হাজার ১৬ সালে তা ১২ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে এসেছে। এই তথ্য ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রিহেবিলিটেশন এ্যান্ড রিকনস্ট্রাকশনের (বিশ্ব ব্যাংক নামে অধিক পরিচিত)। চলতি বছর ৩ অক্টোবর বিশ্বের দারিদ্র্য পরিস্থিতির ওপর প্রকাশিত ‘টেকিং অন ইন ইক্যুয়েলিট’ রিপোর্টে তা উল্লেখ করা হয়েছে। অতি দারিদ্র্য কমে যাওয়ার এই হার প্রমাণ করে দেশ কতটা এগিয়ে গেছে। সূত্র জানায়, প্রতি বছর ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ হারে অতি দারিদ্র্য কমছে। এই কমানোর হার আরও বাড়িয়ে জাতিসংঘ ঘোষিত সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলের (এসডিজি) শর্তপূরণে ২ হাজার ৩০ সালে দারিদ্র্যর হার ৩ শতাংশে নামিয়ে আনতে সরকার সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। দিনে দিনে গ্রামীণ নারী স্বাবলম্বী হওয়ায় এবং কৃষিতে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের অংশগ্রহণে সকল ধরনের ফসল উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় অতি দারিদ্র্যের হার দ্রুত কমে আসছে। আশা করা হয়েছে এসডিজি ঘোষিত নির্ধারিত সময়েই আগেই দারিদ্র্য কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবন মান কতটা পরিবর্তিত হয়েছে তা খালি চোখেই দেখা যায় গ্রামের পথে পা বাড়ালে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে। বগুড়া জেলার নদী তীরবর্তী এলাকা সারিয়াকান্দির চরেও এখন পাকা সড়ক নির্মিত হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছে গেছে বিদ্যুত ও সোলার প্যানেল। বাঙালী নদী তীরের সোনাতলা এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুত পৌঁছেছে। বিদ্যুত পৌঁছায় সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা এলাকার গ্রামগুলোতে কুটির শিল্পের প্রসার ঘটেছে। নারী এখন ফসলের মাঠে কাজ ও ঘর গেরস্থালি ছাড়াও হাস-মুরগি ও গবাদি পশু পালন, মৎস্য চাষ, বনায়নে শ্রম শক্তি বিনিয়োগ করেছে। উন্নত গ্রামগুলোতে নারী সেলাই মেশিনে স্থানীয়ভাবে পোশাক বানিয়ে দিচ্ছে। এলাকার এই উন্নয়নে সার্বিক অবদান রেখেছেন বগুড়া-১ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য মোঃ আব্দুল মান্নান। তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন জনপ্রতিনিধি উদ্যোগী হলে মানুষের কল্যাণে এলাকা কত দ্রুত উন্নয়ন করা যায়। নীরব বিপ্লবে উন্নয়নের রোল মডেল হয়েছেন তিনি। গ্রামের পথঘাট এখন এতটাই উন্নত যে পাকা সড়কের দ্ইু ধারে খেজুরসহ নানা ধরনের গাছের সারি নজরে আসে। গ্রামে নারী শিক্ষার হার বেড়ে গেছে। এই সড়কে নারী শিক্ষার্থীদের নির্বিঘেœ হেঁটে যেতে দেখা যায়। গ্রামীণ সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটায় সড়ক জংশনগুলোতে উন্নত মার্কেট গড়ে উঠেছে। এইসব মার্কেটে শহরে যা পাওয়া তার সবই মেলে। উপজেলাগুলোতেও এখন শো রুম ও উন্নত মার্কেট গড়ে উঠেছে। যা দেখে মনে হয় মিনি শহর। বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিক্সের (বিবিএস) এক জরিপে বলা হয়েছে দেশে মোট নারী শ্রমশক্তি ১ দশমিক ৬২ কোটি। যার ৭৭ শতাংশ গ্রামীণ নারী। নারী শ্রমশক্তির এই হার পার্শ¦বর্তী দেশ ভারতের চেয়ে বেশি। নোবেল বিজয়ী ভারতীয় বাঙালী অর্মত্য সেন ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের নারী উন্নয়নের এই চিত্র তুলে ধরেন। বিবিএসের ওই জরিপে বলা হয় গ্রামীণ নারীর এই শ্রম শক্তির ৬৮ শতাংশ কৃষি, পোলট্রি, ফিশারিজ ও বনায়নের সঙ্গে যুক্ত। একটা সময় গ্রামে লাঙলে হাল চাষের জন্য বলদ ও দুধের জন্য গাভী পালন করা হতো। কৃষিতে যান্ত্রিক সভ্যতা প্রবেশের পর হাল চাষের জন্য আর বলদ পালন হয় না। হাল চাষ রোপণ, মাড়াই কাটাই, ধান ভানাসহ সকল কাজ যন্ত্রে। গ্রামের বিদ্যুতায়িত বাড়িতে কেবল সংযোগসহ টিভি ফ্রিজ কম্পিউটার আছে। এলপিজি সিলিন্ডারে রান্না হয়। স্মার্ট মোবাইল ফোন, ট্যাবও ব্যবহার করে গ্রামের তরুণ-তরুণীরা। পুষ্টি চাহিদা মোকাবেলায় গাইয়ের দুধের জন্য বেশিরভাগ গ্রামে ডেইরি ফার্মের আদলে মিনি ডেইরি ফার্ম স্থাপিত হয়েছে। এই ফার্মের গাভীর দুধ নিজেদের চাহিদা পূরণের পর বাড়তি দুধ বাজারে বিক্রি করে গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এদিকে বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ) বিদেশ থেকে উন্নত প্রজাতির গরু এনে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বাছুর উৎপাদন করে তা গ্রামে পৌঁছে দিচ্ছে। এভাবে গ্রামীণ মিনি ডেইরি ফার্মের উন্নয়ন ঘটে দুধের চাহিদা মিটিয়েছে। এ ছাড়াও উত্তরাঞ্চলের প্রতিটি এলাকায় সবজি উৎপাদনে বড় ধরনের বিপ্লব ঘটেছে। প্রায় সকল সবজি রফতানির তালিকায় স্থান পেয়েছে। প্রতিদিন সকালে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বড় ব্যসায়ীরা বগুড়া নওগাঁ রংপুর রাজশাহী থেকে ট্রাকের পর ট্রাকে সবজি কিনে নিয়ে যাচ্ছে। বড় একটি অংশ রফতানি হচ্ছে আমেরিকা ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশে। মাছ রফতানি শুরু হয়েছে। বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রা। গ্রামীণ অর্থনীতি দিনে দিনে চাঙ্গা হয়ে দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে (২০১৬-১৭) জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা আছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আশা করা হচ্ছে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় এই টার্গেট পূরণের কাছাকাছি পৌঁছবে। গ্রামের পথঘাট এখন এতটাই উন্নত যে পাকা সড়কের দুই ধারে খেজুরসহ অন্যান্য গাছের সারি নজরে আসে। গ্রামে নারী শিক্ষার হার বেড়ে গেছে। এই সড়কে নারী শিক্ষার্থীরা নিবিঘেœ হেঁটে যায়। স্থানীয় সরকার ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের এক তথ্যে বলা হয়েছে : দেশের মোট আয়তনের ৮৫ শতাংশ গ্রাম। মোট জনসংখ্যার ৭২ শতাংশের বাস গ্রামে। তবে জেলাগুলোর উপশহর এবং উপজেলাগুলোর অবকাঠামো ও পথঘাট উন্নত হওয়ায় কার্যত নগরায়ন বেড়েছে। গ্রাম ও গ্রামীণ জীবনের সামদ্রিক উন্নয়নে সরকার বড় ভূমিকা রেখেছে। গ্রাম উন্নয়নে তুলনামূলক বরাদ্দ বেড়েছে। গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ ও সড়কের ব্রিজ কালভার্ট গ্রোথসেন্টার তথা হাটবাজারের উন্নয়ন, মাটির রাস্তার উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ, বৃক্ষরোপণ, বাঁধনির্মাণ, ফ্লাড ও সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ পুনর্বাসন, নিরাপদ সুপেয় পানি প্রাপ্তির ব্যবস্থা, পানি নিয়ন্ত্রণ কাঠামো খাল খনন ও পুনর্খনন, সেচের উন্নয়ন, স্যানিটেশন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ নানা ধরনের কর্মযজ্ঞ চলছে। গ্রাম ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়নে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতেও বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। এদিকে দ্বিতীয় লোকাল গবর্নেন্স সাপোর্ট প্রকল্পে নারী পুরুষের সমান অংশগ্রহণে ইউনিয়ন পরিষদের সার্বিক উন্নয়নে গতি এসেছে।
×