ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পেশা ছাড়ছে নতুন প্রজন্ম

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ১৫ অক্টোবর ২০১৬

পেশা ছাড়ছে নতুন প্রজন্ম

সঙ্গীতে স্বরলিপির প্রথম সোপান হারমোনিয়াম। কণ্ঠশিল্পীর হাতেখড়ি হারমোনিয়ামের মাধ্যমে। হারমোনিয়ামের আবেদন আজও সঙ্গীত শিল্পীদের কাছে গুরুত্বের সঙ্গে সমাদৃত। হারমোনিয়াম যেমন কণ্ঠশিল্পীর জন্ম দেয়, তেমনি দক্ষ কারিগর জন্ম দেয় হারমোনিয়াম। যিনি হারমোনিয়াম নির্মাতা বা কারিগর তিনিও শিল্পী। শিল্পীর জন্ম না হলে শিল্পের জন্ম হয় না। তেমনি মাদারীপুরের শচীন্দ্র নাথ ম-ল হারমোনিয়াম শিল্পী। যার নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হয় হারমোনিয়াম। বংশপরম্পরায় শত বছরের পেশা ধরে রেখেছেন। আপন সাধনা বলে ছোট বেলায় বাবার কাছে হাতেখড়ি নিয়ে তিনি দক্ষ হাতে হারমোনিয়াম তৈরি করে আসছেন। জীবন-জীবিকার তাগিদে রুটি-রুজির প্রয়োজনে এটাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে দীর্ঘ ৬০ বছর নিরলস পথ চলা তার। বর্তমানে আধুনিক সব বাদ্যযন্ত্র উদ্ভাবনের মাঝেও তিনি টিকে আছেন কঠোর পরিশ্রম করে। তবে ডিজিটাল প্রযুক্তির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কতদিন টিকে থাকবেন তা নিয়ে শঙ্কিত থাকলেও হারমোনিয়াম সঙ্গীত জগত থেকে হারিয়ে যাবে না এ ব্যাপারে তিনি আত্মবিশ্বাসী। তার বিশ্বাস যতদিন সঙ্গীত আছে, ততদিন হারমোনিয়াম থাকবে। তাই তো তিনি এ পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছেন এবং থাকবেন আমৃত্যু। শচীন্দ্র নাথ ম-লের জন্ম ১৯৪৬ সালে কোটালীপাড়ার বড়ুয়া গ্রামে। স্বাধীনতার পর মাদারীপুর শহরে বসবাস শুরু করেন। তার বাবা সন্ন্যাসী কুমার ম-ল ছিলেন দক্ষ হারমোনিয়াম কারিগর। তিনি তার বাবা বাঁশিরাম ম-লের কাছ থেকে শিখেছিলেন এ কাজ। ১৯৫৬ সালে শচীনের বয়স যখন ১০ বছর তখন তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি সন্ন্যাসী কুমার ম-লের কাছ থেকে হারমোনিয়াম তৈরির কাজ শিখতে থাকেন। বাবাও তাকে দক্ষ কারিগর হিসেবে গড়ে তোলেন। ১৯৭৩ সালে মেট্রিক পাস করে পরের বছর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে চাকরি পান। কিন্তু ধরাবাঁধা জীবন ভাল লাগেনি। তাই সরকারী চাকরি ছেড়ে কলেজে ভর্তি হন। ১৯৭৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে আবার পৈত্রিক পেশায় ফিরে আসেন। মাদারীপুর পুরনো বাসস্ট্যান্ডে স্বপন এ্যান্ড কোং নামে কারখানা খুলে বসেন। পরে মায়ের নামে বিরোজা সুর বিতান নামকরণ করে ব্যবসা চালিয়ে আসছেন। প্রথমে জীবনে তিনি ৩৭ পর্দা, ৪২ পর্দা, স্টিক চাবি ও প্লেন চাবি হারমোনিয়াম তৈরি করেন। ঢাকার শাঁখারী বাজার থেকে কাঁচামাল যেমন- রিড, স্যালোলয়েড, আঠা, লেদার এবং গে-ারিয়া থেকে সেগুনকাঠ কিনে আনেন শচীন। নিপুণ হাতে তৈরি করেন সুরেলা হারমোনিয়াম। ৩৭ পর্দা, ৪২ পর্দা, স্টিক চাবি ও প্লেন চাবি হারমোনিয়াম তৈরির পাশাপাশি শচীন ম-ল আধুনিক চেঞ্জার কপোলা হারমোনিয়াম তৈরিতেও দক্ষ। তবে চেঞ্জার কপোলা হারমোনিয়ামের দাম বেশি হওয়ায় চাহিদা কম। অর্ডার পেলে বছরে ৩/৪টি চেঞ্জার কপোলা তৈরি করেন। চেঞ্জার কপোলা হারমোনিয়াম তৈরি করতে খরচ হয় ২৫-৩০ হাজার টাকা। সময় লাগে প্রায় দেড় মাস। চেঞ্জার কপোলা হারমোনিয়াম বিক্রি হয় ৭৫-৮০ হাজার টাকায়। ৩৭ পর্দা, ৪২ পর্দা, স্টিক চাবি ও প্লেন চাবি হারমোনিয়াম মাসে ৩/৪টি তৈরি ও বিক্রি হয়। এসব হারমোনিয়াম প্রতিটি তৈরিতে খরচ হয় ৫-১২ হাজার টাকা। আর বিক্রি হয় ১০-৩০ হাজার টাকায়। কারিগর হিসাবে শুধু প্রশংসা কুড়িয়ে জীবন চলে না। জীবন চালাতে হলে অর্থের প্রয়োজন। দীর্ঘ পাঁচ যুগ শচীন ম-ল বাপ-দাদার পেশাকে আঁকড়ে ধরে আছেন। সুরের মূর্ছনায় মানুষকে বিমোহিত করে আসছেন। কিন্তু তার জীবন চলছে বেসুরো পথে। সংসারে তার আট সদস্য। দক্ষ কারিগর বা শিল্পী শচীন্দ্র নাথ ম-ল কোন পৃষ্ঠপোষকতা পাননি। যে কারণে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে আসছেন। বয়সের ভারে এখন নুয়ে পড়েছেন। তবুও জীবন ও জীবিকার তাগিদে দোকানে যেতে হয় সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা। -সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে
×