ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

কক্সবাজার, কুয়াকাটায় পর্যটকদের জন্য আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা

নীল জলের বেলাভূমিতে সৌন্দর্যপিপাসুদের হাতছানি ॥ স্বস্তির ছোঁয়া শেষ

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৫ অক্টোবর ২০১৬

নীল জলের বেলাভূমিতে সৌন্দর্যপিপাসুদের হাতছানি ॥ স্বস্তির ছোঁয়া শেষ

রশিদ মামুন/এইচএম এরশাদ/মেজবাহউদ্দিন মাননু ॥ একপাশে সাগরের নীল জল, মাঝখানটায় সমতল পেরিয়ে পাহাড়। সাগর-পাহাড়-দ্বীপ-নদী-সমতলের মিলনমেলা কক্সবাজার। তাবত দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সাগর সৈকত। পর্যটনশিল্প বলতেই কোন এক সময়ে কেবলমাত্র কক্সবাজারকেই বোঝানো হতো। মানুষ অবকাশযাপন করতে চাইলে ছুটে যেতেন কক্সবাজারে। ১২০ কিলোমিটারে এ সৈকত ছাড়াও কুয়াকাটায় রয়েছে আরও ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ আরেকটি সৈকত। দেশের সৌন্দর্য পিপাসুদের প্রথম পছন্দের জায়গা দুই সৈকত। সাগরের জলে পা ভেজানো হয়নি এমন মানুষের আক্ষেপের নিশ্চয়ই সীমা নেই। যারা এর মধ্যেই সৈকত দেখেছেন তাদের নিশ্চয়ই সাগর আবারও টানে। থেকে থেকেই স্পর্শ পেতে ইচ্ছা করে নীল জলের বেলাভূমির। পর্যটকদের জন্য কক্সবাজার আর কুয়াকাটায় নানা সুযোগ-সুবিধা প্রসারিত হয়েছে। গড়ে উঠেছে তারকামানের হোটেল, আধুনিক সব রিসোর্ট। কক্সবাজারের মতো এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন সত্যিই এক আশ্চর্য স্থান। সারাবছরই পর্যটকদের আনাগোনা থাকলেও শীতে প্রতিদিনই লাখো পর্যটকের ঢল নামে এ শহরে। সাগরকন্যা কক্সবাজারে পর্যটকদের আগমনকে কেন্দ্র করে মৌসুমের শুরুতে হোটেল-মোটেলগুলো সংস্কার, সাগরপাড়ের কিটকট চেয়ারে রং লাগানোসহ দর্শনীয় স্থানগুলো অপরূপ সাজে সাজানো হয়। প্রায় সময়ে সাগরে গোসল করতে নেমে অপ্রত্যাশিত প্রাণহানি এড়াতে এবং পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয় বিভিন্ন উদ্যোগ। পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে প্রশাসন। এজন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অনেকে আনন্দ উপভোগ করতে ছুটে আসেন সৈকত রানী কক্সবাজারে। ঢাকা থেকে কক্সবাজার যেতে হলে বাস, বিমান বা ট্রেনে চট্টগ্রাম পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে সড়কপথে কক্সবাজার যাওয়া যায়। দেশের প্রথম পর্যটন নগরীতে ভাল সকল পরিবহন চলাচল করে। ভাড়া এক হাজার ২শ’ থেকে দুই হাজারের মধ্যে। তবে বিমানে এ ভাড়া সাড়ে চার হাজার টাকা। প্রতিদিন বিকেলে লোকারণ্যে পরিণত হয় বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের বালুকাবেলা। রজততটে দাঁড়িয়ে বিকেলের সূর্যাস্ত দেখতে একই সঙ্গে লাখো লোকের সমাগম, নারী-পুরুষের মহাসম্মিলন, সব বয়সের শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীর উচ্ছ্বাস রাঙিয়ে তুলে সাগরকন্যা নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কক্সবাজারকে। বলাবাহুল্য, একই সঙ্গে পর্যটকদের পদভারে মুখরিত হয়ে ওঠে বিখ্যাত পর্যটন স্পট দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিনও। এখানে বেড়াতে যাওয়া মানুষ প্রাণের উচ্ছ্বাসে ঝাঁপিয়ে পড়েন লোনাজলে। আবার দলবেঁধে আসা পর্যটকরা সৈকতের বালিয়াড়িতে হা-ডু-ডু, ফুটবল, ভলিবল খেলে। ভর মৌসুমে কক্সবাজার শহর, কলাতলী, টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন, ইনানীসহ বিভিন্ন স্থানের হোটেল-মোটেল, রেস্ট হাউস-গেস্ট হাউসের কক্ষ খালি থাকে না। জেলার পর্যটন স্পট মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির, ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, ইনানী পাথুরে সৈকত, হিমছড়ি ঝর্ণা, ইনানী মেরিন ড্রাইভ সড়ক, রামুর বৌদ্ধবিহার, টেকনাফ সৈকত, সেন্ট মার্টিন, সোনাদিয়া দ্বীপ আর বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকতজুড়ে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের ভ্রমণে মুখরিত ও ঝিমিয়ে পড়া পর্যটনশিল্প যেন হঠাৎ উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। পর্যটন নগরীর কোলাহলমুক্ত প্রকৃতির অতি কাছাকাছি হিমছড়ি ঝর্ণার অপরূপ সৌন্দর্য আবালবৃদ্ধবনিতা সবাইকে মুগ্ধ করে। যেখানে প্রকৃতির মধ্যে শুনতে পাওয়া যায় ঝর্ণার নূপুর ধ্বনি। পাহাড়িয়া সারি সারি গাছ মনে হয় পর্যটকদের অভ্যর্থনা জানাতে অপেক্ষা করছে। সকাল-বিকেল দেখা যায়, একটু উপরে শূন্য আকাশে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে সাদা বকগুলো। এসব উপভোগ করতে কক্সবাজারের মহামায়ার মায়ার জাদুতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন হাজার হাজার দর্শনার্থী। পর্যটন নগরীতে সকল বয়সী মানুষের গন্তব্য হচ্ছেÑ সি-বীচ, হিমছড়ি ঝর্ণা, ইনানী পাথুরে বীচ, প্রাণী জাদুঘর, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির, ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক, রামুর রামকোট, টেকনাফের মাথিনের কূপ, সেন্ট মার্টিন-ছেরাদিয়া ও কক্সবাজার সদরের ইন্টারন্যাশনাল এ্যামিউজম্যান ক্লাব। দেশী পর্যটকদের জন্য শহরে ও ইনানীতে ফাইভস্টার, থ্রিস্টার হোটেলের পাশাপাশি অন্তত চার শতাধিক হোটেল-মোটেল, রেস্ট হাউস ও গেস্ট হাউস রয়েছে। এক হাজার থেকে ২০ হাজারের মধ্যে এখানে রাত্রিযাপন করা যাবে। খাবারের দাম নির্ভর করে পর্যটকদের পছন্দের ওপর। সুখবর হচ্ছে, টেকনাফের নাফ নদীর বুকে জেগে ওঠা জালিয়ারদ্বীপে গড়ে তোলা হচ্ছে বিশ্বমানের পর্যটন কেন্দ্র নাফ ট্যুরিজম পার্ক। পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়াতে সেখানে গড়ে তোলা হবে আন্তর্জাতিকমানের কেবলকার, হোটেল, মোটেল, কটেজ, বীচ ভিলা, ওয়াটার ভিলা, সুইমিংপুল, কনভেনশন হল, বার, অডিটরিয়াম, এ্যামিউজমেন্ট পার্ক, ক্রাফট মার্কেটসহ চিত্তবিনোদনের সব উপকরণ। চলতি বছরই এ পার্কের কাজ শুরু করতে যাচ্ছে সরকার। জালিয়ারচরের এই ২৭১ দশমিক ৭১ একর জায়গাজুড়ে সরকার পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে ওই দ্বীপকে আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে সব ব্যবস্থাই করবে। দ্বীপটি দীর্ঘদিন অবৈধ দখলদারের হাতে ছিল। সম্প্রতি জালিয়ারচর তথা জইল্যার দিয়া দখলমুক্ত করেছে সরকার। এখন সে এলাকাকে ঘিরে আধুনিক ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) মনে করে, এর মাধ্যমে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করা সম্ভব হবে। বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবনী চৌধুরী বলেন, সরকার দেশের বিনিয়োগ ও অর্থনীতির উন্নয়নে ১শ’টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে। এর অংশ হিসেবে টেকনাফের নাফ নদীতে জেগে ওঠা জালিয়ারচরে গড়ে তোলা হবে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। আর এর মধ্যে থাকবে পর্যটক আকর্ষণের সব ধরনের চিত্তবিনোদন। গড়ে তোলা হবে একটি আধুনিক ট্যুরিজম পার্ক। এর মাধ্যমে সেখানে সৃষ্টি হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান। বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন ঘিরে পর্যটকদের আগ্রহ সব থেকে বেশি। কক্সবাজারে গিয়ে প্রবালদ্বীপ না দেখে ফিরে আসতে চান না কেউ-ই। টেকনাফ হতে প্রায় নয় কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মিয়ানমারের উপকূল হতে আট কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত। প্রচুর নারিকেল পাওয়া যায় বলে স্থানীয়ভাবে একে নারিকেল জিঞ্জিরাও বলা হয়ে থাকে। পর্যটন মৌসুমে এখানে প্রতিদিন পাঁচটি লঞ্চ বাংলাদেশের মূল ভূখ- হতে আসা-যাওয়া করে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে বর্তমানে বেশ কয়েকটি ভাল আবাসিক হোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে। এর পাশাপাশি সরকারী একটি ডাকবাংলো রয়েছে। তবে এখানে বড় সমস্যা বিদ্যুত। মূল ভূখ- থেকে বাইরে হওয়ায় এখানে কোন গ্রিডলাইন নেই। বিদ্যুতের সমস্যা সমাধানে বড় ভরসা জেনারেটর সার্ভিস। সন্ধ্যা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত জেনারেটর চলে। তবে বিশেষ আয়োজনে সারারাতই জেনারেটর চলে। দিনের বা রাতের অন্য সময়ে বিদ্যুত পাওয়া যায় না। এখানে রাত্রিযাপন করা যায় ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে। এখানে সামুদ্রিক নানা প্রজাতির মাছ একেবারে সস্তায় খেতে পারবেন। ঢাকা থেকে সরাসরি টেকনাফের বাস সার্ভিসেও সেন্ট মার্টিন যাওয়া যায়। ভাড়া এক হাজার ২শ’ থেকে দুই হাজার ২শ’ টাকা। টেকনাফ থেকে জাহাজ সার্ভিসগুলো সকালে সেন্ট মার্টিন যায় আবার বিকেলে ফিরে আসে। এখানে ফিরতি টিকেটসহ পাওয়া যাবে ৭শ’ থেকে দুই হাজার টাকায়। বিনোদনপ্রেমী মানুষের কাছে কুয়াকাটা নামটি এখন খুব বেশি পরিচিত। দেশজুড়ে রয়েছে এ নামটির পরিচিতি। সুখ্যাতি রয়েছে বিদেশেও। এটি শুধু বিনোদন কেন্দ্র নয়, দর্শনীয় স্থানও বটে। এখানেও রয়েছে নয়ন ভোলানে সৈকত। এ সৈকতের বেলাভূমে একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের মনোরম, বর্ণিল ও দুর্লভ দৃশ্য অবলোকন করা যায়। এ দৃশ্য বিমোহিত করে আগত পর্যটক ও দর্শনার্থীকে। অপরূপ এ দৃশ্য দেখতে পারায় কুয়াকাটা নামের সঙ্গে সংযোজন হয়েছে সাগরকন্যা শব্দটি। এখন বলা হয় ‘সাগরকন্যা কুয়াকাটা’। একটু নির্মল আনন্দঘন সময় কাটাতে ব্যক্তি, কপোত-কপোতী, নবদম্পতিসহ পারিবারিকভাবে সকল শ্রেণীর বিনোদনপ্রেমী মানুষ এখন ছুটে আসছেন কুয়াকাটায়। সর্বশেষ কুয়াকাটাকে পৌরসভায় উন্নীত করা হয়েছে। প্রায় ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং দুই কিলোমিটার প্রস্থ কুয়াকাটা সৈকতটি পরিচ্ছন্নতার কারণে আগতদের কাছে খুবই সমাদৃত। দিন-রাত সমানভাবে, সমানতালে, নির্বিঘেœ আমুদে সময় কাটান এখানে আসা প্রকৃতিপ্রেমীরা। দারুণ এক প্রাণভরা স্বস্তিতে প্রকৃতির অপার এ দৃশ্য উপভোগ করেন আগতরা। প্রত্যুষে সাগরস্নাত সূর্যের উদয় দেখতে পুবের আকাশপানে চেয়ে থাকার অপেক্ষা। দুপুর গড়াতেই সাগরের নীলজলে উপভোগ্য স্নান আর শেষ বিকেলে খালি পায়ে সৈকতের বেলাভূমে দাঁড়ানো, লোনা ও শীতল জলের স্পর্শে পা ভেজানোর অনুভূতি শরীরের মধ্যে কী যে শিহরণ জাগায় তা বোঝানো যাবে না। মনের মধ্যে ভেসে ওঠে হারানো সব স্মৃতি, যদি থাকেন একাকী। সীমাহীন সাগরে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে ই”াছ করে অনেক কিছুই। কিন্তু নির্বাক হয়ে যান সবাই। শুধু চেয়ে থাকেন যতদূর দৃষ্টি যায়। সবশেষ পশ্চিমের আকাশে সূর্যের সাগর অতলে হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্য...। এসব চোখে না দেখলে বোঝানো যায় না। সরাসরি সড়কপথের পাশাপাশি পটুয়াখালী পর্যন্ত লঞ্চে গিয়ে সেখান থেকে সড়কপথেও কুয়াকাটা যাওয়া যায়। সড়কপথে মোটামুটি হাজার টাকার মধ্যেই ভাড়া আর লঞ্চে কেবিন এক হাজার থেকে ছয় হাজার পর্যন্ত ভাড়া গুনতে হবে। পটুয়াখালী থেকে ৭০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে কুয়াকাটা যেতে আরও ২শ’ টাকা খরচ হবে। কুয়াকাটার দীর্ঘ সৈকতের কোলঘেঁষে রয়েছে নারিকেল, ঝাউ ও কড়ই বাগান। পুবের শেষদিকে গঙ্গামতির বিরাট সংরক্ষিত বনাঞ্চল, যার মাঝখানের লেকটি বনাঞ্চলকে করেছে বিভক্ত। পশ্চিমের শেষে মোহনায় রয়েছে আরেক অপরূপ লেম্বুরচর বনাঞ্চল। এখানে দাঁড়িয়ে আন্ধারমানিক নদী মোহনার উল্টোদিকে দূর থেকে দেখা যায় দশ সহস্রাধিক একরজুড়ে মনোরম বিস্তৃত ফাতরার বনাঞ্চল। সৈকতের কিনারে রয়েছে ছোট্ট একটি শালবাগান। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের উত্তরদিকে রয়েছে কুয়াকাটা সৃষ্টির ইতিহাস, সেই কুয়াটি। এখানকার আদি বাসিন্দা রাখাইন সম্প্রদায় মিঠাপানি সংগ্রহের জন্য খনন করেছিল কুয়াটি। প্রায় সোয়া ২শ’ বছর আগের কথা। তখন আরাকান থেকে বিতাড়িত রাখাইনরা বনজঙ্গল কেটে আবাদ ও বাসের উপযোগী করে এ শ্বাপদ সঙ্কুলের জনপদ। সেই রাখাইন উপজাতির রয়েছে ভিন্ন জীবনযাত্রা। টংঘরের রাখাইনপল্লী। রয়েছে টংয়ের নিচে কাপড় বুননের তাঁত। স্বচক্ষে দেখার সুযোগ রয়েছে রাখাইনদের এসব ভিন্নমাত্রার জীবন-বৈচিত্র্য। বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী এই সম্প্রদায়ের রয়েছে বুদ্ধ ধর্মীয় মন্দির। শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধবিহার নাম এটির। বর্তমানে কুয়াকাটায় আগতরা মন্দিরটি দর্শনে ভুল করেন না। এটিকে আধুনিকায়ন করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে গৌতম বুদ্ধের ধ্যানমগ্ন অষ্টধাতুর বিশালকায় বুদ্ধমূর্তি। রাখাইনদের দাবি, এর ওজন ৮৭ মণ। এছাড়াও কুয়াকাটার অদূরে মিশ্রিপাড়ার রাখাইনপল্লীতে রয়েছে আরেকটি দর্শনীয় বৌদ্ধবিহার, যার মধ্যে বিশালকায় প্রায় ৭০ ফুট উঁচু গৌতম বুদ্ধের মূর্তি রয়েছে। স্থানীয় রাখাইনদের দাবি, এ মূর্তিটি এশিয়ার মধ্যে সর্ববৃহৎ। প্রতিদিন সেখানে ভিড় জমে অসংখ্য পর্যটকের। মিশ্রিপাড়ার কয়েক কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণ দিকেই রয়েছে পর্যটনপল্লী গঙ্গামতি সৈকত, যেখানে সাগরের বেলাভূমে লাল কাঁকড়াদের বিচরণ দেখা যায়। বিশাল এই সৈকত পর্যন্ত এখন যোগাযোগের জন্য দুর্ভোগ পোহাতে হয় না। পাকা মসৃণ সড়ক রয়েছে গঙ্গামতি সৈকত পর্যন্ত। কুয়াকাটাকে পর্যটন কেন্দ্রে উন্নীতের গোড়াপত্তন করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালে আড়াই একর জমি অধিগ্রহণ করেছিলেন আর আনুষ্ঠানিকভাবে ’৯৮ সালে পর্যটন কর্পোরেশনের হোটেল উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখনই কুয়াকাটাকে আধুনিক পর্যটনে উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়। এখন পর্যটন কর্পোরেশনের হোটেল-মোটেল তৈরি হয়েছে। কেটে গেছে আবাসন সঙ্কট। কুয়াকাটায় অবকাশযাপনের জন্য আগতদের এখন আর ভাবতে হয় না। পর্যটন কর্পোরেশনের একাধিক মোটেল রয়েছে। বেসরকারীভাবে নির্মিত হয়েছে অর্ধশতাধিক উন্নত আবাসিক হোটেল। অসংখ্য হোটেলের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে রেস্তরাঁ। কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ জানান, এখন কুয়াকাটায় আধুনিকমানের অন্তত আটটিসহ অর্ধশত ভাল-মাঝারিমানের আবাসিক হোটেল রয়েছে, যেখানে অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ অবস্থান করতে পারছেন। তিনি আরও জানান, পারিবারিকভাবে কোন পার্টি কিংবা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান করার সুবিধা রয়েছে। এছাড়া অফিসিয়াল সভা-সেমিনার কিংবা সমাবেশ করার মতো হলরুমসংবলিত হোটেল স্পেসও রয়েছে। ইতোমধ্যে এসব স্থানে নববর্ষ, বর্ষ বিদায়সহ বিভিন্ন ধরনের জমকালো অনুষ্ঠান হচ্ছে। সেখানে হচ্ছে বিশেষ কনসার্ট। কুয়াকাটায় ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে বিনোদনকেন্দ্রিক একাধিক রিসোর্ট কেন্দ্র। এর মধ্যে হোটেল গ্র্যান্ড মাস্টারের নিজস্ব ক্যাম্পাসে হেলিপ্যাড, সুইমিং এরিয়া, বনসাইয়ের আস্তরণঘেরা সুবজ অরণ্য, শিশুপার্ক, কৃত্রিম লেক। সিকদার রিসোর্ট সেন্টারে রয়েছে অসংখ্য কটেজ, সুইমিং এরিয়া, শিশুপার্ক, সুইমিং জোন, হেলিপ্যাড। রয়েছে ইলিশ পার্ক, ছোট্ট লেক, বসে আড্ডা দেয়ার গোলঘর। সেখানে আপনি ভারি এবং হাল্কা খাওয়ার সুযোগ পাবেন। রয়েছে বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর প্রতিকৃতিসহ জীবিত পশুপাখি। আঝে ইলিশের আদলে করা একটি রেস্তরাঁ, যেখানে ১২ মাস ইলিশের বিভিন্ন ধরনের খাবারের সুযোগ রয়েছে। কুয়াকাটায় রয়েছে প্রায় আড়াই শ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী কুয়া, যার নামানুসারে কুয়াকাটার নামকরণ হয়েছে। প্রবীণ রাখাইন বাচিং তালুকদার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ১৭৮৪ সালের দিকে যখন আরাকান থেকে বিতাড়িত হয়ে বনজঙ্গলে ঘেরা শ্বাপদ-সঙ্কুলের এ জনপদকে বাসযোগ্য করে তোলা হয়েছে। তখনকার লোকজন থাকতেন বনজঙ্গলের জীবজন্তুদের সঙ্গে যুদ্ধ করে টংঘর তুলে। তখন খাবার পানির সঙ্কট মেটাতে এ কুয়াটি তারা কেটেছিলেন, যার নামে আজকের বিশ^খ্যাত কুয়াকাটা নামটি। এ কুয়াটি এখন দর্শন করেন এখানে আগতরা। কুয়ার পথ ধরেই রয়েছে ঐতিহ্যবাহী আরেক নিদর্শন। শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধবিহার। ইন্দো-চীনের সৌকর্যে নির্মিত একটি টিনশেডে স্থাপিত ছিল এ বিহারটি, যার মধ্যে ছিল গৌতম বুদ্ধের ধ্যানমগ্ন বিশালকায় বুদ্ধমূর্তি। কয়েক বছর আগে বর্তমান সরকার পুরনো টিনশেড মন্দিরের পাশে পুরনো আদল ঠিক রেখে পাকা একটি অত্যাধুনিক মন্দির প্রতিষ্ঠা করে, যেখানে পুরনো বুদ্ধমূর্তিটি স্থানান্তর করা হয়েছে। বিহারাধ্যক্ষ এ্যানোতরা ভিক্ষু জানান, এ মন্দিরটিকে আরও দর্শনীয় করতে গেটসহ বিভিন্ন স্পটে অসংখ্য ছোট-বড় মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। মন্দিরে সকাল-সন্ধ্যা ধর্মীয় আচার পালিত হয়। এখানে রয়েছে দর্শনী ফি, জনপ্রতি ১০ টাকা। এ টাকা দিয়ে পিতৃ-মাতৃহীন ১২ রাখাইন শিক্ষার্থীর লেখাপড়াসহ খাওয়ার যোগান দেয়া হয়। দর্শনীয় এ মন্দিরটি ছাড়াও কুয়াকাটার অদূরে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে রয়েছে মিশ্রিপাড়া রাখাইনপল্লীতে আরেকটি বিশাল সীমা বৌদ্ধবিহার। বিহারটির মূল বেদির উপরে রয়েছে গৌতম বুদ্ধের ধ্যানমগ্ন এক বিরাট মূর্তি। রাখাইনদের দাবি, এটি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় বুদ্ধমূর্তি। বিহারাধ্যক্ষ উত্তম বান্তে এমন দাবি করেছেন। কুয়াকাটায় শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধবিহারের পূর্ব পাশেই বেড়িবাঁধের সেøাপে সংরক্ষণ করা রয়েছে ঐতিহ্যবাহী আরেক পুরাকীর্তি ২শ’ বছরের আগের প্রাচীন একটি নৌকা। কুয়াকাটা সৈকতের বেলাভূমির নিচ থেকে এটি উদ্ধার করা হয়, যেটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পর্যটক-দর্শনার্থীর জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে। কুয়াকাটায় বিনোদনের বাড়তি উপভোগ্য আরেক স্পট জাতীয় উদ্যানের অধীন কুয়াকাটা ইকোপার্ক ও ফাতড়ার বনাঞ্চল, যেখানে বেড়াতে গেলে প্রকৃতির আরেক নিদর্শন সুন্দরবনের পরে আরেক বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল দেখার সুযোগ মেলে। কুয়াকাটা ট্যুরিস্টবোট ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জনি আলমগীর জানান, কুয়াকাটা সৈকত থেকে প্রতিদিন ফাইবারবোটে কিংবা স্পিডবোটে এসব ঘুরে দেখার সহজতর সুযোগ রয়েছে। কুয়াকাটায় পর্যটক ও বিনোদনপ্রেমীদের নিরাপত্তার জন্য নৌ-পুলিশের কার্যক্রম ছাড়াও ট্যুরিস্ট পুলিশের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কুয়াকাটার অদূরে পাঁচ কিলোমিটার দূরে মহিপুরে পুলিশী থানা করা হয়েছে। করা হয়েছে পুলিশী নিরাপত্তা বলয়। মোট কথা কুয়াকাটা এখন বিনোদনপ্রেমীদের কাছে দেশসেরা একটি স্পট। কুয়াকাটার টেকসই উন্নয়নে এবং আধুনিক পর্যটনে রূপান্তরে ইতোমধ্যে সরকারের উদ্যোগে মাস্টারপ্ল্যান করা হয়েছে। সৌন্দর্যময় সমুদ্র সৈকত আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটায় এখন চলছে এক চিলতে জমি কেনার প্রতিযোগিতা। ইতোমধ্যে অন্তত অর্ধশত আবাসন কোম্পানি ঘাঁটি গেড়েছে। কিনছে হাজার হাজার একর জমি। তবে প্রতারিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষার জন্য জমি কেনাবেচায় জেলা প্রশাসকের অনুমতি নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাই কুয়াকাটায় বেড়াতে আসুন। আপনিও হোন কুয়াকাটার বাসিন্দা। স্বপ্ন পূরণ করুন স্বার্থকতার সঙ্গে। মত্ত হোন বিনোদনে। রাখুন জীবনের আনন্দঘন মুহূর্তকে এখানকার সাক্ষী করে। কুয়াকাটায় থাকা যাবে এক হাজার থেকে বিশ হাজার টাকার মধ্যে। তবে রিসোর্টগুলোর ভাড়া তুলনামূলকভাবে বেশি। পর্যটন কর্পোরেশনের হোটেলেও থাকা যাবে সাড়ে তিন থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে।
×