ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দেয়ালিকার সামনেই এখন দেয়াল

প্রকাশিত: ০৪:০২, ১ অক্টোবর ২০১৬

দেয়ালিকার সামনেই এখন দেয়াল

কিশোর বেলায় স্কুল ও কলেজে দেয়াল ম্যাগাজিন বা দেয়ালিকা প্রকাশের কথা শুনলেই সাহিত্যমনা শিক্ষার্থীদের বা ছোট কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে শুরু হয়ে গেছে কথামালার চর্চা। কাগজের পর কাগজে যা মনে আসে তাই লিখে সে কি মহা আনন্দ। সাধারণত কবিতা ও ছোট গল্প প্রকাশিত হয়েছে দেয়ালিকায়। এর বাইরে কৌতুক নক্সা ভ্রমণ কাহিনী জায়গা পেয়েছে। যারা কার্টুন, ছবি আঁকা ও অলংকরণ করতে পারে তাদের কদর গেছে বেড়ে। কদর সবচেয়ে বেশি যাদের হাতের লেখা ভাল। সুন্দর হস্তাক্ষর ছাড়া দেয়ালিকা বেমানান। এর মধ্যে আলপনা বাড়িয়ে দেয় বাড়তি সৌন্দর্য। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ দেয়ালিকা প্রকাশে উৎসাহ দিতেন। স্কুলে নবম শ্রেণী, কলেজে একাদশ শ্রেণী, ¯œাতক ও সম্মানের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের কাঁধেই দেয়ালিকা প্রকাশের দায়িত্ব পড়েছে। তাই বলে এর উপরের শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা দায়িত্ব এড়াতে পারেনি। অনুজরা কি করছে তা দেখভাল ও পরামর্শ দিয়েছে তারা। শিক্ষকগণ উপদেশক হয়ে দেয়ালিকা প্রকাশের কমিটি করে দিতেন। এই কমিটির মধ্য থেকে নির্বাচিত হয়েছে সম্পাদনা পরিষদ। কার কবিতা গল্প কৌতুক নক্সা দেয়াল পত্রিকায় স্থান পাবে তা নির্ধারণ করে দিয়েছে পরিষদ। তারপর পরিষদ দেয়ালিকার আয়তন অনুযায়ী লেখার চূড়ান্ত নির্বাচন করে দিয়েছে। এর পরের ধাপ দেয়ালিকায় লেখা ও সাজানো। সুন্দর হাতের লেখা এবং অলংকরণ করতে শিক্ষার্থীদের ওপর এই দায়িত্ব পড়ে। দেয়ালিকা বড় আর্ট পেপারের কয়টিতে হবে তা নির্ধারণ করা হতো নির্বাচিত লেখা দেখে। সাধারণত বড় সাইজের আর্ট পেপারেই দেয়ালিকা প্রকাশ হয়েছে। দেয়ালিকার নামকরণ করার পর নামটি সুন্দর করে নক্সায় লিখে ওপরের কোন একটি স্থানে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। এই নামকরণ নিয়েও ছিল আলাদা আনন্দ। কি নাম দেয়া হবে তা আহ্বান করা হয়েছে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই। শিক্ষকগণ নাম পছন্দ করে দিতেন। কলম দিয়ে সুন্দর করে গল্প কবিতা লেখা শুরু করার আগে কোথায় কোন গল্প কবিতা বসবে তার লেআউট করা হয়েছে। দেয়ালিকায় কলম দিয়ে লেখার সময় আরেক মজা। সাধারণত মাদুর পেতে তার ওপর আর্ট পেপারটি রেখে লেখকরা উপুর হয়ে বসে লেখা শুরু করেছে। কোথায় কোন লেখা বসবে তা নির্ধারণ করে দু’জন করে লেখা শুরু করেছে। তাদের হাত লেগে গেলে দু’জনের আরেক দল এসেছে। তিন থেকে সাত দিনের মধ্যে দেয়ালিকায় হাতের লেখা শেষ হয়ে কার্টুন ও আলপনার কাজ শুরু হতো। এই কাজ দ্’ুদিনের মধ্যে শেষ হয়ে প্রকাশের দিনক্ষণ ঠিক হতো। দেয়ালিকা প্রকাশ মানে আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেয়ালের কোন দর্শনীয় স্থানে টাঙ্গিয়ে দেয়া। তারপর যাদের লেখা প্রকাশিত হয়েছে, তাদের তো আনন্দ আছেই, প্রকাশিত লেখা নিয়ে কত টিপ্পনি কত আলাপ কত সরস আলোচনা সমালোচনা। দিন কয়েক দেয়ালিকার লেখা নিয়ে মেতে থেকেছে শিক্ষার্থীরা। এইসব আলোচনার মধ্যে কেমন হলো দেয়ালিকা কোথাও কোন অসঙ্গতি হলো কি না হাতের লেখা ছোট না বড় হলে ভাল হতো গল্পের আকার ছোট হলে আরও দুই একজন লেখার জায়গা পেত। কে কাকে উদ্দেশ্য করে কবিতা লিখেছে, গল্প লিখেছে, তা খোঁজার জন্য গোয়েন্দাগিরি শুরু হয়ে গেছে। দুই একটি প্রমাণ মিললে তো হয়েছে। কে কার প্রণয়ে মত্ত, হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দেয়ার মতো অবস্থা। দেয়ালিকা প্রকাশের এমন সাড়া পাওয়ার পর দ্বিতীয় সংখ্যা তৃতীয় সংখ্যা এভাবে কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশের প্রস্তুতি নিয়ে ফের প্রকাশ। দেয়ালিকা প্রকাশের সবচেয়ে বড় দিক প্রতিভা, সৃজনশীল মেধা, সৃজনী ভাবনা, কল্পনার পরিধির বিস্তার ইমাজিনেশন বেড়ে গেছে। এ সবই প্রতিভা আর মেধাকে শাণিত করার মাধ্যম। দেয়ালিকার লেখনি পড়ে ও দেখে শিক্ষকগণের শিক্ষার্থীর মেধা সম্পর্কে ধারণা জন্মেছে। বিদ্বান, জ্ঞানী-গুণীজন, প-িত ব্যক্তিগণ বলেছেন ইমাজিনেশন ইজ মোর পাওয়ারফুল দ্যন নলেজ (কল্পনা শক্তি জ্ঞানার্জনের চেয়ে শক্তিশালী)। একটা সময় মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে একাডেমিক লেখাপড়ার বাইরে শিক্ষার্থীদের এক্সট্রা কারিকুলাম এ্যাকটিভিটিজের দিকে বেশি দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। স্কুল ছুটির পর শিক্ষার্থীরা কেউ খেলাধুলা, কেউ সাংস্কৃতিক কর্মকা-, কেউ সাহিত্য, কেউ বিতর্কসহ নানা কিছু নিয়ে তাদের ভেতরের লালিত প্রতিভা প্রকাশের সুযোগ পেয়েছে। শিক্ষকগণও উৎসাহ দিতেন। এরই অংশ দেয়ালিকা। কখনও বলা হতো দেয়াল ম্যাগাজিন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক ছাপানো ম্যাগাজিনের চেয়ে দেয়ালিকার কদর ছিল বেশি। মঞ্চ নাটক যেমন দর্শক শ্রোতাদের সামনে অভিনয়ের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা দেয়ালিকাও তেমনই নিজেকে প্রকাশ করার সবচেয়ে বড় প্লাটফর্ম। আরেক দিকে সুন্দর হাতের লেখা মননশীলতার বড় প্রতীক। বর্তমান সময়ে দেয়ালিকা আগের অবস্থানে নেই। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা একাডেমিক শিক্ষার সঙ্গে বাড়তি আর কিছু নিতে রাজি নয়। দেয়ালিকা যে সৃজনশীলতার অন্যতম মাধ্যম এই ধারণা দিনে দিনে অসার হয়ে যাচ্ছে। দেয়ালিকার সামনেই এখন দেয়াল। জিপিএ-৫ এর সংখ্যা বেড়ে গেছে, পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে আর কিছু বাড়ছে না...। -সমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×