ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

ডক্টর নীলিমা ইব্রাহিম এক সাহসী জীবন যোদ্ধা

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬

ডক্টর নীলিমা ইব্রাহিম এক সাহসী জীবন যোদ্ধা

১৯২১ সালে তৎকালীন খুলনা জেলার বাগেরহাটের একটি গ্রামে নীলিমা ইব্রাহিমের জন্ম। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রবেশের সময় অনুযায়ী তিনিও অন্যদের মতো ৫ বছর বয়সে খুলনার করোনেশন বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তীক্ষè মেধাবী নীলিমা ইব্রাহীম মাত্র ১৪ বছর বয়সে ১৯৩৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। চারটি বিষয়ে লেটার নিয়ে প্রথম বিভাগে পাস করে সফলতার স্বাক্ষর রাখেন। এরপর চলে যান কলকাতায়, কলকাতায় অভিজাত কলেজ ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশন থেকে ১৯৩৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায়ও সফলভাবে উত্তীর্ণ হন। এই কলেজেই অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক সম্মান কোর্সে ভর্তি হন। ১৯৩৯ সালে স্নাতক সম্মান ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৪৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে বাংলায় প্রথম শ্রেণীতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৪৫ সালে ঢাবা নিবাসী ডাঃ মোহাম্মদ ইব্রাহীমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এর পরই স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। এখানেই তার কর্ম এবং পড়াশোনার জীবনে সাময়িক বিরতি। ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। তার এই কর্ম জীবনই তাকে নতুন মাত্রায় চালিত করতে বিশিষ্ট ভূমিকা রাখে। ১৯৫৯ সালে ‘সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিকায় ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নাটাক’-এর গবেষণামূলক অভিসন্দর্ভ জমা দিয়ে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলায় তিনিই প্রথম এই ডিগ্রী অর্জনের কৃতিত্বের দাবিদার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের সূচনাকাল থেকেই তিনি সহকর্মী হিসিবে পান মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জেল হায়দার চৌধুরী এবং কাজী দীন মোহাম্মদের মতো জ্ঞান তাপসদের। তাদের সাহচর্য এবং সান্নিধ্য তাকে কতখানি আনন্দিত এবং প্রভাবিত করেছিল তা তার দীর্ঘ জীবনের বহু স্মৃতিতে উল্লেখ আছে। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অনুসন্ধানের যে তাগিদ অনুভব করেছিলেন অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে সেদিন নীলিমা ইব্রাহীম বঙ্গবন্ধুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। শুধু তাই নয় মিরপুর বধ্যভূমিতে তিন মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার এবং জহির রায়হানের অস্তিত্ব খুঁজে বের করার সর্বাত্ম প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। অনেক সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি সেদিন মাতৃভূমি ছেড়ে কলকাতায় পাড়ি জমাননি। নরসিংদীতে তার বাসস্থান ছিল মুক্তিযাদ্ধাদের নিশ্চিন্ত এবং নিরাপদ আশ্রয়। কত মুক্তিযোদ্ধা তার মায়াঘন আশ্রয়ে নির্বিঘœ মুহূর্তগুলো কাটাতেন তা বলে শেষ করা যাবে না। দেশপ্রেমের এই বোধ-অভিব্যক্তি তার জাগে পারিবারিক সুস্থ পরিবেশের নির্মল আবহাওয়ায়। যা তার সারা জীবনের আদর্শ এবং কর্ম সাধনায় উজ্জীবিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের জাগ্রত প্রহরী অসংখ্য বাংলার দামাল ছেলে তার স্নেহছায়ায় শান্তির পরশ পেয়েছে আসলে তার কোন জবাবই নেই। এই গরীয়সী মাতৃসমা জননীর উদ্দীপ্ত আধার আজও আমাদের মনে সাহস আর উদ্দীপনা জাগায়। শুধু কী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি দায়িত্ব পালনই তার একমাত্র ব্রত ছিল? না পাশাপাশি তিনি এদেশে ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানিতার বিরুদ্ধে সোচ্চারই হননি, নিবিড় মমতায় তাদের সাহচর্য দিয়েছেন, আন্তরিক পরশে তাদের সমব্যথী হয়েছেন এমনকি তাদের স্থায়ী পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে তার যুগান্তকারী ভূমিকা আজও আমাদের প্রাণিত করে, উজ্জীবিত করে। মানবিক মূল্যবোধ আর মনুষ্যতের দাবিতে তার সেই বিখ্যাত বই আজও পাঠক সমাজে সমাদৃত। বীরাঙ্গনাদের নিয়ে সেই অমরগ্রন্থ ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ আজও স্বাধীনতা যুদ্ধে লাঞ্ছিত নারীদের এক রক্তাক্ত গল্পগাথা। মা আজও সমাজের নিগৃহীতা, নির্যাতিতা নারী সমাজকে নতুন করে বাঁচার পথ দেখায়, সামনে এগিয়ে চলতে সাহসী করে তোলে, দুর্জয় মনোবলে, দীপ্ত শপথে তারা সংকল্পবদ্ধ হয়। এমন একটি সময়োপযোগী এবং প্রয়োজনীয় সৃষ্টি সম্ভার স্বজাতির প্রতি গভীর মমত্ববোধ এবং মঙ্গলপ্রদীপ হাতে তাদের চলার পথে আলো বিকিরণের এক উদ্দীপ্ত রচনাসৌধ। যা কালের প্রবাহে আজও অমলিন। কারণ আজও সিংহভাগ নারী জাতির সত্যিকার অর্থে কোন মুক্তি ঘটেনি। শিক্ষায়, কর্মে, বিভিন্ন পেশায় নারীরা দীপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে গেলেও নারী যে শুধু নারীই এ ধারণার ব্যত্যয় সমাজে এখনও সুস্থিরভাবে আসন গড়তে পারেনি। তাই নারী আজও বিভিন্ন আঙ্গিকে বৈষম্যের শিকার। নারীরা তাদের প্রাপ্ত মর্যাদা, অধিকার এবং স্বাধীনতা নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছে। যৌতুকের জন্য এখনও নারীকে নির্মমভাবে বলি হতে হয়, বাল্যবিবাহের যাঁতাকল থেকে নারীরা কি সেভাবে বেরিয়ে আসতে পেরেছে? ধর্ষণ নামক কুরুচিসম্পন্ন পাশবিক নির্যাতন থেকে নারীেেদর নির্বিঘœ মুক্তি কবে ঘটবে জানি না। তাই আজও নীলিমা ইব্রাহীম আমাদের পাথেয়, তার সৃষ্টিচেতনা আমাদের দিশারী, তার কর্মজীবন আমাদের উদ্বুদ্ধ করে, সাহস যোগায়। আরও একটা কথা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়, ১৯৭৪ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব ভারও নিয়েছিলেন। এখানেও এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত রেখে অবৈতনিকভাবে বাংলা একাডেমিতে তার সংক্ষিপ্ত কার্যক্রম চালিয়ে যান। নারী জাতির অহঙ্কার এই গরীয়সী নারী ১৯৬৯ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০০০ সালে একুশে পদকসহ আরও অনেক দুর্লভ পুরস্কার তার সৃষ্টিশীল এবং কর্মজীবন ভরে ওঠে। তিনি প্রবন্ধ, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, অনুবাদ, ভ্রমণ কাহিনী এবং আত্মকথার মতো অনেক সৃজনশীল ভা-ার আমাদের জন্য রেখে গেছেন। বিভ্রান্ত, বিপথে চালিত নতুন প্রজন্মের প্রতি তার কিছু আহ্বান ছিল, বার্তা ছিল যা তাদের যথার্থ পথনির্দেশ করবে। ‘এখনকার কিশোর-কিশোরীরা ঘরের সংস্কৃতির দিকে তাকায় না। বিশ্ব সংস্কৃতি নিয়ে তারা মাতামাতি করে। সব কিছু সময়সাপেক্ষ প্রথমে পরিবার ধারণ করবে, তারপর সন্তান সেখান থেকে শিখে বড় হয়ে উঠবে। আমার কাছে মনে হয় আমার মা বাবা যে ট্রাডিশনাল সমাজে ছিলেন, সেখানে অনেক কিছু শেখার ছিল। আর আমাদের সন্তান যারা তারা কতটুকু আমাদের কাছ থেকে পেয়েছে জানি না, তাদের সন্তানরা যা পাচ্ছে তার কথা আর না বলাই ভাল। মেয়েদের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং মমতাঘন অনুভূতি থেকে যে অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছিলেন তাও উল্লেখ করার মতো। ‘এ যুগের মেয়েদের তো কিছু বলা মুশকিল। তাদের জীবন তো বড় কঠিন। আমার তো মেয়ে আছে, আমি দেখতে পাই। এরা স্বামী, সহকর্মী কারও শ্রদ্ধা পায় না। বরং ধারণা পোষণ করে তারা এসেছে আমাদের কেড়ে খেতে। এ যুগের মেয়েদের সম্পর্কে আমার একটাই বক্তব্য- পথ চলতে হবে এবং মাথা উঁচু করে চলতে হবে। এ ছাড়া আর কোন পথ নেই।
×