ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ তানভীর নাসরীন

কাঁচের দেয়াল ভাঙ্গা

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬

কাঁচের দেয়াল ভাঙ্গা

শাকিব খানের মুখে ছেয়ে গিয়েছে এই বঙ্গের দেয়াল। শাকিবের অভিনীত ‘শিকারি’ মুক্তি পেয়েছে ১২ আগস্ট। সে কারণেই কলকাতা থেকে শহরতলি, সর্বত্র এখন পোস্টারে, হোর্ডিংয়ে শাকিব খানের চেহারা। অনেকেই হয়ত ভাবছেন টলিউডের এই নতুন হিরোটি কে? এপারের নায়িকা শ্রাবন্তীর সঙ্গে সুদর্শন এই যুবকটি কে? নতুন কোন মুখ? না, শাকিব খান, বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়ক, ঢাকার ‘হার্টথ্রব’। শাহরুখ খানকেও ঢাকায় অনুষ্ঠান করতে যাকে সঙ্গে রাখতে হয়। কারণ, শাকিব থাকলে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে যত সহজে ‘লোকাল কানেক্ট’ করা যায়, অন্য কোন উপায়ে তা করা সম্ভব নয়। একক হিরো হিসাবে শাকিবের ছবি পশ্চিমবঙ্গে মুক্তি পাওয়া বা তার পোস্টারে টালা থেকে টালিগঞ্জ ছেয়ে যাওয়াটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা? ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে? কলকাতা-ঢাকার সংস্কৃতি আদান-প্রদানের পরিপ্রেক্ষিতেও আমি নিজে মনে করি বড় ঘটনা। ঢাকার বাঙালীর এমনিতেই সাংঘাতিক অভিমান আছে কলকাতার কালচালার এডিটরদের নিয়ে। কতবার ঢাকায় অধ্যাপকদের আড্ডায় বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে গিয়ে অনুযোগ শুনেছি, আপনারা তো আমাগো পাত্তাই দেন না। আমাদের সিনেমা-নাটক দেখেনই না। হয়ত এই বক্তব্যে বাংলাদেশে সত্যিও, বাংলাদেশের আইকন হুমায়ুন আহমেদকেই কলকাতার পাঠক বা প্রকাশকরা আপন করে নিতে পারেনি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা রফিক আজাদ, এই বঙ্গে ব্রাত্যই। আমাদের ক’জন ছাত্র মুনতাসীর মামুন বা মেসবাহ কামালের লেখা পড়ে? তানভীর মোকাম্মেল, নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বা মুস্তাফা ফারুকীর তৈরি সিনেমার সঙ্গে পরিচিতই নয় কলকাতার দর্শক। নির্মলেন্দু গুণের কবিতা কেন এপারের শারদ সংখ্যায় ছাপা হয় না বা বুনোহাঁস- এ দেবের সঙ্গে স্ক্রিন স্পেস শেয়ার করার পরও কেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যাকে আর টালিগঞ্জ ডাকল না, এই অনুযোগ ঢাকা এয়ারপোর্টে নামার পর থেকেই শুনে যেতে হয়। সেই নয়ের দশকে গঙ্গা-যমুনা নাট্যাৎসবের সুযোগ এপার বাংলার দর্শক বাংলাদেশের নাটকের সঙ্গে সম্যক পরিচিতি হয়েছিল। সারা যাকেরের নাটাক আমরা দেখেছিলাম, সেলিম আল দীন কত শক্তিশালী নাট্যকার, কলকাতার নাট্যপ্রেমীরা জানতে পেরেছিলেন, তারপরে দীর্ঘদিনের বিরতি। অধুনা আবার ব্রাত্য বসুর উদ্যোগে এবং তার নাটকের দল ব্রাত্যজনের উৎসবের দৌলতে বাংলাদেশের নাটকের দল কলকাতায় আসছে। কিন্তু তার বাইরে? এ বঙ্গের যে সাংস্কৃতিক সমাজের সঙ্গে পরিচিত হতে, সামান্য স্বীকৃতি পেতেও বঙ্গের, ঢাকার শিল্পী, গায়ক, সাংস্কৃতিক কর্মী বা এমনকি, ঐতিহাসিকরাও চান, তার সুযোগ কোথায়? মনে আছে প্রায় এক যুগ আগে রাজশাহীতে প্রথম অর্ণবের গান শুনেছিলাম। সেটা ছিল শীতের রাত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অদ্ভুত মায়াবি পরিবেশে আকাশ ছিল তারায় মোড়া। অর্ণবের গান শেষ হওয়ার পরে যে অদ্ভুত মুগ্ধতা থাকে, সেই ভাললাগা ছিল বাতাসে। হঠাৎ চমক ভেঙ্গে ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের আক্ষেপে, ‘আপা, আপনারা তো পাকিস্তানের গায়কদের দিয়েও ইন্ডিয়ায় কত গান গাওয়ান। আমাদের এই পোলাটারে দিয়ে বাংলা সিনেমার মিউজিক করানো যায় না।’ আমার কাছে কোন উত্তর ছিল না। পরবর্তীকালে আলাপ হয়েছে পাবনায় সুচিত্রা সেনের প্রতিবেশী, অধুনা প্যারিসবাসী পার্থপ্রতিম মজুমদারের সঙ্গে। পার্থ দা আরও হুল বিঁধিয়ে বলতেন, ‘আমার ভাগ্যে স্টিভেন স্পিলবার্গের ছবিও জুটেছে। কিন্তু টালিগঞ্জের কোন পরিচালক আমাকে আজ পর্যন্ত ডাকেনি।’ শুধু মুকাভিনয়ের জন্য বিশ্ব ঘুরে বেড়ানো পার্থ দার কোন শো আজ পর্যন্ত কলকাতায় হয়েছে বলে জানি না। পার্থ দার তুতো ভাই, বাপ্পা মজুমদার ঢাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় সুরকার হওয়া সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত টালিগঞ্জ তাকে ডাকেনি। শাকিবের ছবিতে চৌরঙ্গীপাড়া ছেয়ে যাওয়া তাই বড় ঘটনা। প্রথম মহিলা হিসেবে ডেমোক্র্যাট দলের মনোয়ন পাওয়ার পরে হিলারি ক্লিনটন যেমন বলেছেন, ‘এতদিনে কাচের দেয়ালটা ভাঙ্গল।’ দুই বাংলার সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে শাকিব খানের মেনস্ট্রিম বাংলা সিনেমায় প্রবেশটা অবশ্যই মাইলফলক। দেরিতে হলেও টালিগঞ্জ বুঝেছে, বাংলা সিনেমার দর্শক ধরতে গেলে বাংলাদেশকে উপেক্ষা করে লাভ নেই। এ বঙ্গের ৮ কোটির চেয়ে বাংলাদেশের ১৬ কোটির জনসংখ্যা সংখ্যার বিচারে অনেক বেশি। অতএব পুঁজির স্বাভাবিক নিয়মে গত চার বছর ধরেই টালিগঞ্জের প্রযোজকরা বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায় ঝুঁকেছিলেন। টলিউডের রটনা অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে যে ক’টি বাংলা ছবি হিট করেছে, তার মধ্যে সিংহভাগই ঢাকার সঙ্গে যৌথ প্রযোজনার ছবি। অতএব সেই বাজারের শর্ত ধরেই এবার শাকিবের আবির্ভাব কলকাতার বিলবোর্ডে। অনেকদিন আগে এক সেমিনারের পরে মুনতাসীর মামুন আমায় বলেছিলেন, ‘তোমাদের টেলিভিশনের উঠতি অভিনেতারা এলেও আমাদের দেশের প্রথম শ্রেণীর পত্রিকায় তার সাক্ষাতকার ছাপা হয়। আর আমাদের গবেষণা গ্রন্থও তোমাদের আলোচনায় স্থান পায় না?’ জানি না শাকিবের ‘এ্যান্ট্রি’ কলকাতার কালচারাল এলিটিজমের কাচের দেয়াল ভাঙতে পারবে কিনা। কিন্তু আমি সত্যি সত্যিই সেই দিকে তাকিয়ে আছি। শাকিবের পরের ছবি ঢাকার তরুণ, কিন্তু অসম্ভব প্রতিভাবান পরিচালক হাসিবুর রেজা কল্লোলের সঙ্গে, যে ‘সত্তা’ ছবিতে নায়িকা এপারের পাওলি দাম এবং ‘সত্তা’র ফাস্ট কাট দেখে অনেকেই মনে করেন, এ ছবির জন্য পাওলি হয়ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাবেন। কিন্তু শাকিব-পাওলির ‘সত্তা’ কি কলকাতার দর্শক দেখতে পাবে? কিংবা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘ভুবনমাঝি’? যে ছবিতে তরুণ পরিচালক ফাকরুল আরোফিন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন মৌলবাদের বিরুদ্ধে? গুলশানে আর্টিজান বেকারিতে হামলার পরে তো পরমব্রতর ‘ভুবনমাঝি’ আরও প্রাসঙ্গিক ছবি। এপার বাংলাতে, ওপার বাংলাতেও। যে ছবিতে পরমব্রতর চরিত্রের যাত্রা ১৯৭১ থেকে আজকের ইসলামিক স্টেটের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেও। আরোফিন-পরমব্রতর পাশাপাশি ‘ভুবনমাঝি’তে সুর দিয়েছেন দোহারের কালিকা প্রসাদ। সেই ছবি কি পৌঁছবে কলকাতার দর্শকদের কাছে? আমি হিলারি ক্লিনটনের মতোই কাচের দেয়াল ভাঙ্গার অপেক্ষায়। অধ্যাপক, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিম বঙ্গ
×