ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

ভবিষ্যতে কাজে নাও লাগতে পারে

৮শ’ কোটি টাকার এলেঙ্গা গ্যাস কম্প্রেসার পড়ে রয়েছে

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

৮শ’ কোটি টাকার এলেঙ্গা গ্যাস কম্প্রেসার পড়ে রয়েছে

রশিদ মামুন ॥ বিশাল পরিকল্পনার আংশিকও বাস্তবায়ন না হওয়ায় পড়ে রয়েছে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা গ্যাস কম্প্রেসার। গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি (জিটিসিএল) প্রায় ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে কম্প্রেসার স্টেশনটি স্থাপন করে। এখন সংশ্লিষ্টরা বলছেন খামোখাই কম্প্রেসারটি স্থাপন করা হয়েছিল। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে ২০০৬ সালের প্রকল্পটি আট বছর পর ২০১৪ এসে শেষ হয়। তবে গ্যাসের চাপ না থাকায় এখনও চালানো যাচ্ছে না এলেঙ্গা কম্প্রেসার। গ্যাস উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি হিসাব করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন ভবিষ্যতে এই কম্প্রেসার আর কোন দিন কাজে নাও লাগতে পারে। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গত ২৪ মে বিদ্যুত জ্বালানি এবং খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদকে একটি চিঠি দেন। ওই চিঠিতে বলা হয় এলেঙ্গা ২০১ সি ইউনিটে স্থাপিত কম্প্রেসারটি পর্যাপ্ত গ্যাসের চাপের অভাবে কমিশনিং করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া গ্যাস সঞ্চালন গ্রিড লাইনে গ্যাসের চাপ হ্রাস পাওয়ায় কারণে পূর্ণাঙ্গ ক্ষমতায় কম্প্রেসার স্টেশনটি পরিচালনা করার ক্ষেত্রেও সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। করকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি কম্প্রেসার স্টেশনটি সরেজমিন পরিদর্শন করে পরিকল্পনামন্ত্রীর কাছে প্রতিবেদন দেয় বলে ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কম্প্রেসার স্টেশনটি অকার্যকর অবস্থায় পড়ে রয়েছে। গ্যাসের চাপ বাড়াতে কম্প্রেসার স্টেশনটি স্থাপন করা হয়। কিন্তু এখন কোন কাজেই লাগছে না ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা কম্প্রেসারটি। জিটিসিএল বলছে ২০১৪ সালের এপ্রিলে কম্প্রেসারটি স্থাপনের কাজ শেষ হয়। দেশে গ্যাস উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি হিসাব করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন আদৌ এই বিনিয়োগ আর কোন দিন কাজে লাগবে বলে মনে হয় না। প্রকল্প শুরু হওয়ার আট বছর পর কম্প্রেসারটি ২০১৪ সালে চালু হলেও তা এখনও পড়েই রয়েছে। গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানির (জিটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুব সারোয়ার জনকণ্ঠর কাছে কম্প্রেসারটি পড়ে রয়েছে বলে স্বীকার করেছেন। তিনিও জানান, পর্যাপ্ত গ্যাসের চাপ না থাকায় কম্প্রেসার স্টেশনটি চালানো সম্ভব হচ্ছে না। গ্যাসের চাপ বৃদ্ধি করতে ২০০৬ সালে কম্প্রেসার স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। ওই সময় থেকেই কম্প্রেসার স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)। কিন্তু অর্থায়ন ও দরপত্রের জটিলতার কারণে কাজ পিছিয়ে যায়। পরে ২০১১ সালের ২১ অক্টোবর কোরিয়ার হুন্দাই ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা জানান, দেশের উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ করার জন্যই এলেঙ্গা কম্প্রেসারটি স্থাপন করা হয়েছিল। তবে সরকার পরবর্তীতে ওই সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটে। যে কারণে খুলনায় গ্যাস পাইপলাইন স্থাপনের কাজটি ঝুলে যায়। পাইপলাইন স্থাপনের কাজ অনেক দূর এগিয়ে আবার অদৃশ্য কারণে বন্ধ করে দেয়া হয়। খুলনাতে একটি দ্বৈত জ্বালানির (ডুয়েল ফুয়েল) বিদ্যুত কেন্দ্রও নির্মাণ করা হয়। পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল খুলনায় সরবরাহ করা গ্যাস দিয়ে কেন্দ্রটি চালানো হবে। তবে এখন গ্যাসের অভাবে কেন্দ্রটি তরল জ্বালানি দিয়ে চালানো হচ্ছে। রাজশাহীতে পাইপলাইন গেলেও পর্যাপ্ত গ্যাস সংযোগ দেয়া হচ্ছে না। রাজশাহী এবং সিরাজগঞ্জে শিল্প উদ্যোক্তারা গ্যাসের জন্য আবেদন করেও পাচ্ছেন না। মূলত এসব কারণেই এলেঙ্গা কম্প্রেসারটি কোন কাজে লাগছে না। তিনি জানান, শুরুতে যেভাবে সারাদেশে গ্যাস গ্রিড ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা ছিল এখন সেখান থেকে সরকার নিজেকে গুটিয়ে নেয়াতে এই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। জান যায়, সরকারের পরিকল্পনায় সিরাজগঞ্জে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রের একটি হাব হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভারতের কোম্পানি ল্যাঙ্ককে কাজ দেয়ার পরও তারা নির্মাণ চুক্তি করতে পারেনি। আবার ল্যাঙ্কর পরিবর্তে একই স্থানে সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোম্পানি সেম্বক্রপ এবং সরকারের নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে একটি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য সমঝোতা চুক্তি হয়। তবে বিদ্যুত কেন্দ্রটির চূড়ান্ত চুক্তি করতে এসে বেঁকে বসে সিঙ্গাপুরের কোম্পানিটি। দেশের বিনিয়োগ নীতিতে আইপিপি বিদ্যুত কেন্দ্রর জন্য ১৫ বছরের কর অবকাশ সুবিধা দেয়ার কথা রয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ববোর্ডের একটি এসআরওতে ভিন্নতা থাকায় কোম্পানিটি চুক্তি করতে এসেও ফিরে গেছে। ফলে সিরাজগঞ্জে বিদ্যুত হাবের বিষয়টিও খুব বেশি দূর অগ্রসর হচ্ছে না। এর বাইরে উত্তরবঙ্গে গ্যাস না দিলে এই কম্প্রেসারটিকে বসেই থাকতে হবে। পেট্রোবাংলার একজন কর্মকর্তা জানান, শেভরন বিবিয়ানা ক্ষেত্র থেকে সরকারকে যে পরিমাণ গ্যাস দিতে পারবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা দিতে পারেনি। শেভরণের চাপে সরকার বিবিয়ানা-ধনুয়া পাইপলাইন নির্মাণ করেছিল। এই পাইপলাইনে শেভরণ পর্যাপ্ত গ্যাস দিতে পারলে কম্প্রেসারটি চালানো সম্ভব হতো। ফলে বিবিয়ানা থেকে গ্যাস না পাওয়া এবং সরকার উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ না করায় এলেঙ্গা কম্প্রেসার কোন কাজে আসছে না। দেশে এখন গ্যাসের যে অবস্থা তাতে অদূর ভবিষ্যতেও এসব এলাকায় গ্যাস দেয়া সম্ভব হবে না। এখনও দৈনিক সরকারী হিসাবেই অন্তত ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। পর্যায়ক্রমে এই ঘাটতি আরও বৃদ্ধি পাবে। ভবিষ্যতে মহেশখালীতে দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করা হলেও চট্টগ্রাম এবং ঢাকা অঞ্চলেই তার থেকে বেশি ঘাটতি থাকবে। এর বাইরে সরকার পটুয়াখালীতে পৃথক এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। পটুয়াখালীর এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করা হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তরবঙ্গের জ্বালানি সঙ্কটের সমাধান সম্ভব। তবে এক্ষেত্রেও এলেঙ্গার কম্প্রেসার কোন কাজে লাগবে না।
×