ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

যে অভিযোগে ফাঁসি

প্রকাশিত: ০৬:০০, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬

যে অভিযোগে ফাঁসি

বিকাশ দত্ত ॥ জামায়াতের মূল খাজাঞ্চী, বদর বাহিনীর কমান্ডার, চট্টগ্রামের বাঙালী খান মীর কাশেম আলীর আলোচিত মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। তদন্ত শুরু হওয়ার পর থেকে আইনী প্রক্রিয়ার সর্বশেষ ধাপ রিভিউয়ের রায় পর্যন্ত সময় লেগেছে ৬ বছর ১ মাস ৪ দিন। রিভিউ শুনানিতে অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীর মামলার চেয়ে এ মামলায় সময় নেয় বেশি। সরকারের দুই প্রভাবশালী মন্ত্রী -খাদ্যমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে মামলা নিয়ে কিছু মন্তব্য করায় আদালত অবমাননায় জরিমানা গুনতে হয়। শুধু তাই নয়, রিভিউয়ের রায় ঘোষণার একদিন আগে খোদ এ্যাটর্নি জেনারেল মাববুবে আলমকেও উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা যায়। শুধু এ্যাটর্নি জেনারেল নয়, এর আগে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির, বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনকেও মীর কাশেমের মামলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। বিশেষ করে যখন এ্যাটর্নি জেনারেল উদ্বেগ প্রকাশ করেন তখন গোটা জাতি সুপ্রীমকোর্টের দিকে উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়েছিল। অবশেষে সকল উদ্বেগের অবসান ঘটিয়ে ৩০ আগস্ট রিভিউয়ের রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে মীর কাশেম আলীর আবেদন খারিজ করে মৃত্যুদ- বহাল রাখা হয়। জাতি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। ২০১৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণসহ ১৪ অভিযোগ গঠন করে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু করে। ২০১৪ সালের ২ নবেম্বর ১৪ অভিযোগের মধ্যে দশটি প্রমাণিত হয়। ট্রাইব্যুনাল তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- প্রদান করে। আপীল বিভাগ সাতটি অভিযোগ বহাল রাখে। আর তিনটি অভিযোগ থেকে মীর কাশেম আলীকে খালাস দেয়। এর মধ্যে চার্জ ১১তে মৃত্যুদ- বহাল রাখা হয়। অভিযোগ ১১ তে রয়েছে, শহীদ জসিমসহ মোট ৬ জনকে অপহরণ, আটক, নির্যাতন ও হত্যা করে লাশ গুম। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে অসংখ্য নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষকে ধরে নিয়ে বিভিন্ন নির্যাতন কেন্দ্রে আটক রেখে নির্যাতন ও অনেককে হত্যা করে। ওই ঘটনার ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের রমজানের ঈদের দিনের পর যে কোন সময় মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে চট্টগ্রাম শহরের অজ্ঞাত স্থান থেকে আটক ও অপহরণ করে পাকিস্তানী দখলদার সেনাবাহিনীর দোসর আলবদর বাহিনীর সদস্যরা আসামি মীর কাশেম আলীর নির্দেশে ও ইঙ্গিতে তার নিয়ন্ত্রণাধীন চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলের নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যায়। নির্যাতন কেন্দ্রে আটক রেখে তাকে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৮ নবেম্বর আসামি মীর কাশেম আলীর নেতৃত্বে ও নির্দেশে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা ডালিম হোটেলের ছাদে জসিমকে নির্যাতন করে হত্যা করে। তাদের নির্যাতনে নিহত অজ্ঞাতনামা আরও ৫ জনের লাশের সঙ্গে জসিমের লাশ ওই দিন সন্ধ্যাবেলা আসামির নির্দেশে ও ইঙ্গিতে তার নেতৃত্বাধীন আলবদর বাহিনীর সদস্যরা কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দিয়ে লাশ গুম করে। ২৪ আগস্ট রিভিউ শুনানি শেষে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, এ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধের মামলায় কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন যেদিন দায়ের করা হয়েছে, তার পরদিনই শুনানি হয়েছে। কামারুজ্জামানের মামলায় রিভিউ দায়েরের ৩১ দিনের মাথায় শুনানি হয়েছে। আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর মামলায় ৩৪ দিন, নিজামীর মামলায় ৩৭ দিনের মাথায় রিভিউ শুনানি হয়েছে। মীর কাশেমের মামলায় রিভিউ দায়ের হয়েছে গত ১৯ জুন, ২৪ আগস্ট পর্যন্ত ৬৬ দিন চলে গেছে। আপীল শুনানির এক পর্যায়ে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলী জামায়াতের অর্থদাতা এতদিন শুনছিলাম। এখন তা বিশ্বাস হচ্ছে। কারণ তার টাকা দিয়ে মানবতাবিরোধী বিচার বন্ধের জন্য লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছিল। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ২০১০ সালের ২৬ জুলাই তদন্ত শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালের ১৭ জুনে মীর কাশেম আলীকে গ্রেফতার করা হয়। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ২০১৩ সালের ১৬ মে মীর কাশেমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে। একই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মীর কাশেমের যুদ্ধাপরাধের বিচার। এরপর মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয় এবং সেখানেই ১৮ নবেম্বর প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সীমন ও রেজিয়া সুলতানা চমনের সূচনা বক্তব্যের (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) মধ্য দিয়ে শুরু হয়। ২০১৩ সালের ১১ ডিসেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত মীর কাশেম আলীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন তদন্ত কর্মকর্তা নুরুল ইসলামসহ মোট ২৪ জন। এরপর ২১ ও ২২ এপ্রিল মীর কাশেম আলীর পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেন তার ছোট বোন মমতাজ নুরুদ্দিনসহ তিনজন। সাক্ষ্য-জেরা এবং দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে ২০১৪ সালের ৪ মে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৪ সালের ২ নবেম্বর মীর কাশেম আলীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-াদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ তার রায়ের পর্যবেক্ষণে মীর কাশেম আলীকে বাঙালী খান হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। মীর কাশেম ছিলেন হত্যাকা-ের প্রতিটি ক্যাম্পের একটি অপরিহার্য অংশ। নির্যাতন ও নির্মমতার মাত্রা এতটাই ছিল যে, তাকে ‘বাংলার খান সাহেব’ হিসেবেও অনেকে উল্লেখ করেছেন। এতে প্রমাণিত, ওই নির্যাতন ক্যাম্পে যারা নির্যাতিত হয়েছেন এবং যারা হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন, সবকিছুর পেছনেই মীর কাশেম মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামী ও তার প্রধান গোলাম আযমের নির্দেশ অনুযায়ী ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা মীর কাশেম আলী চট্টগ্রামে আলবদর বাহিনী গঠন করে নির্যাতন ক্যাম্প স্থাপন করে সেখানে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের মানুষকে ধরে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করে লাশ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দিয়েছে যা মানবতার ইতিহাসে অত্যন্ত জঘন্যতম অপরাধ। এই বিচারের ফলে দায়মুক্তির আরেকটি ধাপ অগ্রসর হওয়া গেল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ৩০ নবেম্বর মীর কাশেম আলী আপীল করেন। ২০১৬ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় আপীল মামলাটির শুনানি। ওই দিন এবং পরদিন ১০ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনালের রায় এবং সাক্ষীদের অভিযোগভিত্তিক সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন শেষে আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন মীর কাশেমের আইনজীবী এস এম শাহজাহান। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেন তিনি। আর রাষ্ট্রপক্ষে এ্যাটর্নি জেনারেল শুরু করেন ২৩ ফেব্রুয়ারি । ২৪ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষ যুকিতর্ক শেষ করার পর পুনরায় আসামি পক্ষের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন আইনী পয়েন্টে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। এর মধ্য দিয়ে মীর কশেমের মামলার আপীল শুনানি শেষ হয়। এর আগে ২৪ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্র ও আসামি উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য ৮ মার্চ দিন ধার্য করে আদেশ দেয় আপীল বিভাগ। ২০১৬ সালের ৮ মার্চ প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ৫ সদস্যের আপীল বিভাগ ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদ- বহাল রাখে। আপীলের রায়ে যে তিনটিতে ট্রাইব্যুনালে দ- পেয়েছিলেন, তার মধ্যে ৪,৬,১২ অভিযোগ থেকে খালাস দিয়েছে আপীল বিভাগ। আর ২,৩,৭,৯,১০,১১,১৪ নং অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দ- বহাল রাখে আপীল বিভাগ। আপীল আদালত ১২ নম্বর অভিযোগ থেকে মীর কাশেমকে খালাস দেয়া হয়। যেখানে তাকে মৃত্যুদ- দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল। ৪ ও ৬ নম্বর অভিযোগে সাত বছর করে সাজার রায় থেকেও এই জামায়াত নেতা খালাস পেয়েছেন। আপীল নাকচ করে ১১ নম্বর অভিযোগে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজনকে হত্যার দায়ে মীর কাশেমের সর্বোচ্চ সাজার রায়ই বহাল রাখা হয়েছে। একই সিদ্ধান্ত হয়েছে ২, ৩, ৭, ৯, ১০ ও ১৪ নম্বর অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ-ের সাজার ক্ষেত্রেও। মৃত্যুদ- বহাল রেখে আপীলের পূর্ণাঙ্গ রায় ৬ জুন প্রকাশের পর তা পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে ১৯ জুন আবেদন করেন মীর কাশেম। রিভিউ আবেদন শুনানির দিন ধার্যের জন্য আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। এ ধারাবাহিকতায় ২১ জুন চেম্বার বিচারপতি বিষয়টি ২৫ জুলাই নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠান এবং মামলাটি সোমবারের দৈনন্দিন কার্যতালিকায় ৬৩ নম্বর ক্রমিকে আসে। তবে শুনানির জন্য আরও সময়ের আবেদন করা হবে জানিয়ে মীর কাশেমের ছেলে মীর আহমেদ বিন কাশেম বলেছিলেন, ‘প্রস্তুতির জন্য দুই মাস সময়ের আবেদন করা হয়েছে। আপীল বিভাগের রায়ে এসেছে, এই মামলায় অভিযোগ গঠনের আদেশ ত্রুটিপূর্ণ। আদালত শুনানি পিছিয়ে দেয়ার পর আসামিপক্ষের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, প্রস্তুতির জন্য আমরা দুই মাস সময় চেয়েছিলাম। আদালত এক মাস দিয়েছে। ২৪ আগস্ট শুনানির তারিখ দিয়েছে। ২৪ আগস্ট ও ২৮ আগস্ট রিভিউ আবেদনের শুনানি হয়। রিভিউ আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন মীর কাশেম আলীর প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। শুনানি শেষে রায় ঘোষণার জন্য ৩০ আগস্ট দিন নির্ধারণ করা হয়। অবশেষে ৩০ আগস্ট রিভিউ রায়ে মীর কাশেম আলীর আবেদন খারিজ করে দেয়া হয়। আপীল বিভাগের দেয়া মৃত্যুদ- বহাল রাখা হয়।
×