ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থানই স্পষ্ট হলো

পাকিস্তানের অপারগতায় ভেস্তে গেল পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক

প্রকাশিত: ০৬:০১, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৬

পাকিস্তানের অপারগতায় ভেস্তে গেল পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক

তৌহিদুর রহমান ॥ ১৯৭১ সালের অন্যতম শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- বহালের ঘটনায় ঢাকা-ইসলামাবাদ পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক ভেস্তে গেছে। দুই দেশের মধ্যে আজ বৃহস্পতিবার ঢাকায় এই বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। তবে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে হঠাৎ করেই জানিয়ে দেয়া হয়, তারা এই বৈঠকে যোগ দিতে পারছে না। একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- বহালের কারণেই দেশটি এই বৈঠকে যোগদান থেকে বিরত রয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বেশ কয়েক মাস ধরে দুই দেশের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের প্রস্তুতি চলছিল। ঢাকায় আজ বৃহস্পতিবার এই বৈঠকটি চূড়ান্ত ছিল। এই বৈঠকে যোগ দেয়ার জন্য পাকিস্তানের পক্ষ থেকে নিশ্চিতও করা হয়। সে অনুযায়ী বুধবার ঢাকায় পৌঁছার কথা ছিল পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব আইজাজ আহমেদ চৌধুরীর। তবে মঙ্গলবার রাতে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে হঠাৎ করেই জানিয়ে দেয়া হয়, তারা এই বৈঠকে অংশ নিতে পারছেন না। তবে কি কারণে এই বৈঠকে তারা অংশ নিতে পারছে না, তারও কোন ব্যাখ্যা দেয়নি। দীর্ঘ ছয় বছর পরে দুই দেশের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। এই বৈঠকের প্রস্তুতির লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই ঢাকায় এসেছেন ইসলামাবাদে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার তারিক আহসান। বৈঠকের জন্য আলোচ্যসূচীও চূড়ান্ত করা হয়েছিল। তবে মঙ্গলবার হঠাৎ করেই ইসলামাবাদের তরফ থেকে এই বৈঠকে যোগ দেয়ার বিষয়ে অপারগতা প্রকাশ করা হয়। ঢাকা-ইসলামাবাদের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের প্রস্তুতির জন্য এর আগে ছয়বার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে প্রতিবারই কোন না কোন কারণে পাকিস্তান এই বৈঠকে যোগ দেয়নি। ঢাকার পক্ষ থেকে চূড়ান্তভাবে প্রস্তুতি নেয়ার পরে ইসলামাবাদ বারবার কোন না কোন অজুহাত দেখিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, তারা বৈঠকে যোগ দিতে পারছে না। তবে এবার যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- বহাল রাখার কারণেই এই বৈঠকে দেশটি যোগ দিতে পারছে না বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। ১৯৭১ সালের অন্যতম শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- গত মঙ্গলবার উচ্চ আদালত থেকে বহাল রাখা হয়। আর সেদিন রাতেই পাকিস্তানের তরফ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়, তারা এই বৈঠকে আসতে পারছেন না। আর বৈঠকে যোগ দেয়ার জন্য পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিবের বুধবার ঢাকায় আসার কথা, বুধবারই মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- বহালের প্রতিবাদে হরতাল আহ্বান করে জামায়াতে ইসলামী। তাই হরতালের দিন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিবও ঢাকায় আসতে চাননি। কেননা হরতালের দিন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল ঢাকায় পৌঁছলে জামায়াতের ডাকা হরতালের মধ্যেই তাদের গাড়িতে চলাচল করতে হতো। সে কারণে তারা হরতালের দিন ঢাকায় আসতে চাননি বলে জানা গেছে। প্রতিবছর দুই দেশের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের কথা থাকলেও ঢাকা-ইসলামাবাদের মধ্যে টানাপোড়েন চলতে থাকায় এই বৈঠক আর হয়নি। ২০১০ সালের পর প্রায় ছয়বার বৈঠকের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে, তবে সেই বৈঠক আর করা সম্ভব হয়নি। এখন দুই দেশই চেয়েছিল বৈঠকটি সফল হোক। কেননা দুই দেশের মধ্যে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ, বাণিজ্যিক সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক কর্মসূচী বিনিময়, ভিসা সহজীকরণ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনার জন্য প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এছাড়া ঢাকায় অনেক পাকিস্তানী চোরাচালান ও জাল টাকার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। পাকিস্তানের কাছে বিষয়টি খোলামেলা আলোচনা করতে চায় ঢাকা। আর পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকেই এসব আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হতে পারে। সে কারণে দু’পক্ষ পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকটি সম্পন্ন করতে চেয়েছিল। তবে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের দুই দিন আগেই যুদ্ধাপরাধী মীর কাশেম আলীর মৃত্যুদ- বহালের ঘটনায় পাকিস্তানই এই বৈঠকে যোগদানে অপরাগতা জানাল। আর এর মধ্যে দিয়ে আবারও তারা প্রমাণ করল বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান রয়েছে। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে পাকিস্তান শুরু থেকেই অবস্থান নিয়ে এসেছে। বিভিন্ন সময়ে তারা প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আসছে। তবে জামায়াতে ইসলামীর নেতা মীর কাশেমের মৃত্যুদ- বহালের ঘটনায় পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও কোন বিবৃতি না দিলেও ঢাকা-ইসলামাবাদের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে অংশ না নিয়ে দেশটি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষেই অবস্থান পরিষ্কার করেছে। ঢাকা-ইসলামাবাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে শীতল সম্পর্ক চলে আসলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে নতুন করে টানাপোড়েন শুরু হয়। এর আগে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা আলী আহসান মুজাহিদের মৃত্যুদ-ে নাখোশ হয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় পাকিস্তান। পাকিস্তানের ওই প্রতিক্রিয়ার প্রতিবাদে দেশটির ঢাকায় নিযুক্ত হাইকমিশনার সুজা আলমকে তলব করে বাংলাদেশ। সে সময় পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে জানিয়ে দেয়া হয়, পাকিস্তান সরকার সরাসরি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তান সরকার কোনভাবেই যেন আর হস্তক্ষেপ না করে, সে বিষয়ে তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়। সে সময় ঢাকার পাক হাইকমিশনারকে তলবের প্রতিক্রিয়া হিসেবে গত বছর ডিসেম্বরে ইসলামাবাদে নিযুক্ত বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার মৌসুমী রহমানকে তলব করে পাকিস্তান সরকার। তাকে তলবের পর ১৯৭১ সালের হত্যাকা-ে সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করে পাকিস্তান। তলব ও পাল্টা তলব নিয়ে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে নতুন করে টানাপোড়েন শুরু হয়। এরইমধ্যে ঢাকা থেকে পাকিস্তানের কূটনীতিক ফারিনা আরশাদকে বহিষ্কার করা হয়। ফারিনা আরশাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে জঙ্গী তৎপরতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ দেয় বাংলাদেশ। তারই পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ইসলামাবাদ থেকে বাংলাদেশের কূটনীতিক মৌসুমী রহমানকে বহিষ্কার করা হয়। এছাড়া যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদ-ের প্রতিবাদে পাকিস্তান পার্লামেন্টে শোক প্রস্তাব পাস করেছিল দেশটি। এদিকে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর বেলুচিস্তান নিয়ে মন্তব্যের জের ধরে ঢাকা-ইসলামাবাদের মধ্যে নতুন করে টানাপোড়েন শুরু হয়। তথ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রতিবাদে গত ১৯ আগস্ট ইসলামাবাদে বাংলাদেশের হাইকমিশনার তারিক আহসানকে তলব করা হয়। এই নিয়ে দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েনও চলে। তবে ওই টানাপোড়েনের মধ্যেই পহেলা সেপ্টেম্বর ঢাকা-ইসলামাবাদের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল।
×