ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রাহককে ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ বাস্তবায়নে টালবাহানা

কলড্রপের কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে অপারেটররা

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ১৮ আগস্ট ২০১৬

কলড্রপের কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে অপারেটররা

ফিরোজ মান্না ॥ নির্ধারিত সময় পার হলেও মোবাইল অপারেটররা গ্রাহকের কলড্রপের ক্ষতিপূরণের নির্দেশ বাস্তবায়ন করেনি। হিসাব অনুযায়ী প্রতিদিন এক কোটি ৬০ লাখ মিনিট কলড্রপ হচ্ছে। কলড্রপের কযেক কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে অপারেটররা। বিটিআরসি গ্রাহকদের কলড্রপের টাকা বা ‘টকটাইম’ ফেরত দেয়ার নির্দেশটি বাস্তবায়নের জন্য মোবাইল অপারেটরদের এ বছরের জুন মাস পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু জুনের মধ্যে অপারেটররা এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করেনি। সম্প্রতি বিটিআরসি কলড্রপের ক্ষতিপূরণ নিয়ে অপারেটরদের আবার চিঠি দিয়েছে। এবারের চিঠিতে বলা হয়েছে, কলড্রপের ক্ষতিপূরণ গ্রাহককে না দিলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে ছয়টি অপারেটরের দিনে মোট কলের সংখ্যা প্রায় ১৬০ কোটি মিনিট। এর মধ্যে গড় কলড্রপের হার ১ শতাংশ। এই হিসাবে প্রতিদিন কলড্রপ হচ্ছে এক কোটি ৬০ লাখ মিনিট। বিটিআরসির হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে দেশে মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা ১১ কোটি ৬০ লাখ। এতে গ্রাহকপ্রতি কলড্রপের হার শূন্য দশমিক ১২ শতাংশ। অপারেটররা বলছে, ইন্টার-কানেকশন এক্সচেঞ্জের (আইসিএক্স) ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্কের দুর্বলতার কারণেও কলড্রপ হচ্ছে। এর বাইরে ফাঁকা স্থানে হঠাৎ উঁচু ভবন নির্মাণ এবং থ্রিজি নেটওয়ার্ক কার্পেটিংয়ের কারণেও কলড্রপ হচ্ছে। কলড্রপ একদম হবে না এ কথা বলা যাবে না। নেটওয়ার্কের কারিগরি ত্রুটি কখন দেখা দেবে তা বলা যাবে না। যে কোন সময় এই ত্রুটি দেখা দিতে পারে। তখন কম-বেশি কলড্রপ হবে। আইটিইউ এর বেঁধে দেয়া নিয়মেও কলড্রপ স্বীকৃত। বিটিআরসি বলছে, কলড্রপ হতে পারে। তবে এটা হতে হবে সহনীয় মাত্রায়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে কলড্রপ হলে গ্রাহক টাকা বা সমপরিমাণ টক টাইম ফেরত পান। বিশ্বের অনেক দেশেই এই নিয়ম চালু আছে। আমরা কলড্রপের টাকা গ্রাহকদের ফেরত দেয়ার জন্য কয়েক বছর ধরে অপারেটরদের বলে যাচ্ছি। কিন্তু তারা নানা কারণ দেখিয়ে এটা বাস্তবায়ন করছে না। ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেন, বিটিআরসি আইটিইউয়ের (আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন) নীতিমালার বাইরে কতগুলো কলড্রপ হয় তা মনিটর করবে। যদি আইটিইউয়ের নীতিমালার বাইরে কলড্রপ হয় তাহলে অপারেটরকে ওই টাকা বা টক টাইম গ্রাহককে দিতে হবে। কল ড্রপের বিষয়ে মোবাইল গ্রাহকরা সিরিয়াস, মন্ত্রণালয়ও সিরিয়াস। বিটিআরসির কোয়ালিটি অব সার্ভিসের উপর সজাগ থাকতে হবে। যে কোন গ্রাহক কলড্রপের বিষয়ে বিটিআরসিতে মোবাইল ফোন, টেলিফোন, ই- মেইলের মাধ্যমে অভিযোগ জানাতে পারবেন। বিষয়টি নিয়ে বিটিআরসি অপারেটরদের সঙ্গে বৈঠক করে যাচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়টি অপারেটররা কোনভাবেই মেনে নেয়নি। বৈঠকে রাজি হলে বাস্তবে অপারেটররা কোন কাজই করেনি। পরে প্রতি কলড্রপে এক মিনিট করে ক্ষতিপূরণ দিতে অপারেটরগুলোকে নির্দেশ দেয় বিটিআরসি। এতেও কোন কাজ হয়নি। বিটিআরসি চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ বলেন, কলড্রপের জন্য গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ আছে। কিন্তু অপারেটররা এটা বাস্তবায়নে নানা টালবাহানা করে যাচ্ছে। এ বিষয়ে মোবাইল অপারেটরদের আবার চিঠি দেয়া হবে। তাদের সঙ্গে বসে গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করা হবে। কলড্রপ নিয়ে মোবাইল অপারেটররা জানিয়েছে, নেটওয়ার্ক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রতিবন্ধকতা কলড্রপের বড় কারণ। যেমন ঢাকার একটি স্থানে গ্রাহক বেড়ে গেছে কিংবা বড় বড় উঁচু দালান ওঠার কারণে উন্নত সেবা ধরে রাখতে সেখানে আরও বেশি বেস ট্রান্সমিশন স্টেশন (বিটিএস) বসানো প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবে বিটিএস বসানোর জন্য উপযুক্ত জায়গা পাওয়া যায় না। এখন বেশির ভাগ বাড়িওয়ালা, এমনকি সরকারী অফিসের কর্মকর্তারাও বিটিএস বসানোর জন্য ভবনের ছাদ ব্যবহার করতে দিতে চান না। আবার যেখানে স্থান পাওয়া যায়, সেখান থেকে পুরো এলাকায় বৃত্তাকারে সমমানের নেটওয়ার্ক সেবা দেয়া সম্ভব হয় না। ফলে কলড্রপ হচ্ছে। আবার ইন্টার-কানেকশন এক্সচেঞ্জে ত্রুটির কারণে কলড্রপ হয়। এই এক্সচেঞ্জ পৃথক লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে। একই সঙ্গে ট্রান্সমিশন কেবল একবার কাটা পড়লে সংশ্লিষ্ট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সেই নেটওয়ার্ক ঠিক করতে দু’ তিন দিন পর্যন্ত সময় নেয়। এ সময় বিচ্ছিন্ন হওয়া বিটিএসের পরিবর্তে বিকল্প বিটিএস দিয়ে সেবা দিতে হয়। এতে নেটওয়ার্ক দুর্বল হয়ে যায়। তখন কলড্রপ হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে কম সক্ষমতার হ্যান্ডসেট ব্যবহারের কারণেও হয়। কারণ কম ক্ষমতাসম্পন্ন হ্যান্ডসেট পূর্ণ ক্ষমতায় নেটওয়ার্ক গ্রহণ করতে পারে না। শব্দবিষয়ক ফিচার ভাল না হওয়ায় গ্রাহক ভাল শব্দ শোনেন না। এ্যামটব সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে থ্রিজি সেবা দেয়া পাঁচটি অপারেটরই নেটওয়ার্ক কার্পেটিং করছে। এর অর্থ, বিটিএস টু বিটিএস থ্রিজি চালু করা। অনেক সময়ই বিটিএস টু বিটিএস থ্রিজি চালু করতে গিয়ে পরিপূরক নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। এ জন্য আরও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিটিএস বসাতে হয়। সেই কার্পেটিংয়ের কাজটি চলমান। কার্পেটিং শেষ হতে আরও সময় লেগে যেতে পারে। এ কাজ শেষ হলে কলড্রপ কমবে। প্রযুক্তিবিদ সুমন সাবির বলেন, তারবিহীন নেটওয়ার্ক শতভাগ কলড্রপমুক্ত রাখা বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, বেতার তরঙ্গভিত্তিক নেটওয়ার্কে অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে একটি কল যাচ্ছে। নির্ভরতার একটি ক্ষেত্র এক সেকেন্ডেই অদৃশ্যভাবে সমস্যা তৈরি করতে পারে। তবে কারিগরি সক্ষমতা বাড়ালে শতভাগ কলড্রপমুক্ত নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা সম্ভব। কিন্তু এখানে গ্রাহকের স্বার্থে গুণগত সেবা দেয়ার বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে।
×