ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আবার অশান্ত কাশ্মীর উপত্যকা

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ১৭ আগস্ট ২০১৬

আবার অশান্ত কাশ্মীর উপত্যকা

আবার অশান্ত হয়ে উঠেছে কাশ্মীর উপত্যকা। গত ৮ জুলাই ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে এক জঙ্গী নেতা নিহত হওয়ার পর থেকে সেখানে সহিংসতার জোয়ার বয়ে চলেছে এবং তাতে প্লাবিত হয়েছে গোটা তল্লাট। এ পর্যন্ত সেখানে সহস্রাধিক হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ ও সৈনিকদের সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় খ- যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে ৬০ জনের মতো সিভিলিয়ান। আহত হয়েছে ২ হাজারেরও বেশি। অন্যদিকে নিরাপত্তা বাহিনীর ৩ হাজারের বেশি সদস্যও আহত হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কার্ফু দেয়া হয়। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট সার্ভিস সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়। কাশ্মীরী জনগণের অসন্তোষের এত ভয়াবহ বিস্ফোরণ গত ছয় বছরের মধ্যে হয়নি। একবারের গোলযোগের এক উল্লেখযোগ্য দিক হলো অ-মারণাস্ত্র পাম্প এ্যাকশন গানের ব্যাপক ব্যবহার। নিহতের সংখ্যা কমানোর জন্য ২০১০ সালে কাশ্মীরে এই অস্ত্র প্রথম চালু হয়েছিল। কিন্তু এবারের মতো এত ব্যাপক ব্যবহার আর হয়নি। এই অস্ত্রের দ্বারা শত শত ক্ষুদে ধাতব টুকরো ছুড়ে দেয়া হয়। এতে লোকজন আহত হয়। কেউ চোখ হারায়, কেউবা অন্য কোন অঙ্গ। তবে অ-মারণাস্ত্র বলা হলেও বাস্তবে তা মারণাস্ত্রের চেয়েও বিপজ্জনক। কাশ্মীর একদিকে যেমন ভূস্বর্গ অন্যদিকে তেমনি আবার বিশ্বের অন্যতম গোলযোগপূর্ণ স্থান। নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) নামে কার্যত একটি সীমান্তের দ্বারা অঞ্চলটি ভারত ও পাকিস্তান এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে বিভক্ত। দুটো দেশই আবার কাশ্মীরের সমগ্র এলাকাকে নিজের বলে দাবি করে থাকে। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভেঙ্গে ভারত ও পাকিস্তান দুটো আলাদা রাষ্ট্র হওয়ার পর থেকে এই দুই দেশের মধ্যে চারবার যুদ্ধ হয়েছে। তার মধ্যে তিনটি যুদ্ধই কাশ্মীর নিয়ে। সর্বশেষ লড়াইটি হয়েছে ১৯৯৯ সালে কাশ্মীরে বিদ্রোহী তৎপরতা শুরু হওয়ার প্রায় এক দশক পর। ঐ বিদ্রোহী তৎপরতায় পাকিস্তানের উস্কানি ছিল বলে নয়াদিল্লী অভিযোগ করে। সশস্ত্র জঙ্গীদের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য হাজার হাজার ভারতীয় সৈন্য নামানো হয়। ফলে কাশ্মীর উপত্যকায় ভারতীয় বাহিনীর উপস্থিতি বিশাল আকার ধারণ করে। নব্বইয়ের দশকে সহিংসতা তুঙ্গে পৌঁছলেও এখনও সেখানে প্রায় ৬ লাখ ভারতীয় সৈন্য ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য রয়ে গেছে। ভারতীয় কাশ্মীরের জনসংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। তাদের সামলাতে এত বিশাল বাহিনী মোতায়েনের ফলে কার্যত তা দখলদার বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। বেসামরিক লোকজনকে ধরপাকড় করা ও প্রয়োজনে গুলি করার ব্যাপক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীকে। অভিযোগ আছে যে তারা এই ক্ষমতার দারুণ অপব্যবহার করছে। ২০১৫ সালের এক রিপোর্টে এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানান যে, ১৯৯০-এর দশকে সেনা ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটক থাকা অবস্থায় নির্যাতনে মৃত্যুর ৮ শতাধিক ঘটনা তাদের কাছে নথিভুক্ত আছে। তাছাড়া ১৯৮৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুম করে ফেলার আরও শত শত অভিযোগও তাদের হাতে আছে। ২০১০ সালে এক সাজানো বন্দুক যুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যদের হাতে তিনজন সিভিলিয়ান নিহত হওয়াকে কেন্দ্র করে সর্বশেষ অসন্তোষের বিস্ফোরণ ঘটেছিল। নিরাপত্তা বাহিনী ও সিভিলিয়ান জনগোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক বৈরিতা ও সন্দেহ-অবিশ্বাসের পরিবেশে অসন্তোষ ধূমায়িত হয়ে চলেছে। আর সেটা ঘটছে ক্রমবর্ধমানভাবে তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে। ভারতীয় কাশ্মীরের জনগোষ্ঠীর অর্ধেকেরও বেশির বয়স ত্রিশ বছরের নিচে। তারা ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ছায়ার নিচে বেড়ে উঠেছে। অবশ্য ১৯৯০ এর দশকের সেই রক্তাক্ত দিনগুলোর তুলনায় সহিংসতার ঘটনা ও মাত্রা অপেক্ষাকৃত কমই আছে। তেমনি এলাকায় বিচরণরত জঙ্গীর সংখ্যা কমে এসেছে। এখন বড়জোর ওদের সংখ্যা হবে কয়েকশ। তবে অতীতের গেরিলাদের থেকে এখনকার জঙ্গীদের পটভূমি ভিন্ন। আর্থিক দিক থেকে স্বাচ্ছন্দ্যকর ও শিক্ষিত পটভূমির তরুণরা এখন আজাদীর ডাকে এগিয়ে আসছে। এবং সেটাই নয়াদিল্লীর অস্বস্তির কারণ। গত ৮ জুলাই বুরহান ওয়ালী নামে ২২ বছরের যে জঙ্গী কমান্ডারের হত্যাকা-কে কেন্দ্র করে কাশ্মীরের বর্তমান গোলযোগের সূত্রপাত সে-ই হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকের ভারতবিরোধী জাগ্রত তারুণ্যের প্রতীক। তার জানাজায় তরুণ-বৃদ্ধ নির্বিশেষে ২ লাখ মানুষের উপস্থিতি ছিল স্মরণকালের বৃহত্তম জানাজার দৃষ্টান্ত। জনৈক ভারতপন্থী কাশ্মীরী রাজনীতিক মন্তব্য করেছেন যে জীবিত অবস্থায় ওয়ালী সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যতজন তরুণকে জঙ্গীবাদে টেনে আনতে পেরেছিলেন এখন কবর থেকে তার চেয়ে অনেক বেশিসংখ্যককে এই পথে নিয়ে আসতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেখানে অর্থনীতি চাঙ্গা করতে ও বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি বাড়াতে হিমশিম খাচ্ছেন সেখানে কাশ্মীরে নতুন গোলযোগ তার সামনে অনাকাক্সিক্ষত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর মোদি প্রতিবেশী পাকিস্তানের প্রতি শুভেচ্ছার হাত বাড়িয়েছিলেন। তার অভিষেকে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফকে। শরীফের জন্মদিনে অভিনন্দন জানাতে পাকিস্তানে অনির্ধারিত যাত্রাবিরতিও করেছিলেন। কিন্তু এতকিছু করার পরও দুদেশের সম্পর্কে তিক্ততা রয়েই গেছে। কাশ্মীরে সাম্প্রতিক অসন্তোষ ও গোলযোগের পেছনে পাকিস্তানের ইন্ধন রয়েছে বলে নয়াদিল্লীর অভিযোগ আছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছেন যে, কাশ্মীরে যা কিছু ঘটছে তার পেছনে রয়েছে পাকিস্তানের পৃষ্ঠপোষকতা। অন্যদিকে পাকিস্তান কাশ্মীরের রক্তাক্ত ঘটনার জন্য কালো দিবস পালন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শরীফ বলেছেন, আমরা সেদিনের অপেক্ষায় আছি যেদিন সমগ্র কাশ্মীর পাকিস্তানের অংশ হয়ে দাঁড়াবে। চলমান ডেস্ক সূত্র : টাইম
×