ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যতিক্রমী উদ্যোগ

কচিকাঁচাদের সবুজ প্রেম

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ৭ আগস্ট ২০১৬

কচিকাঁচাদের সবুজ প্রেম

ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাৎ থামতে হচ্ছিল। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আগলে দাঁড়াচ্ছিল পথ। না, কোন চাওয়া নেই তাদের। উল্টো দিতে চায়! সকলের হাতেই সবুজ চারা গাছ। নিজেদের টাকায় কেনা। বিতরণ করছিল বিনে পয়সায়। সঙ্গে একটি আবেদন গাছটি প্লিজ বাঁচিয়ে রাখবেন। সবুজ না বাঁচলে বিবর্ণ হয়ে যাবে শহর। আমরা সবুজে বাঁচতে চাই। একই সময় নাম পরিচয় জাত ইত্যাদি তথ্যেসমৃদ্ধ লিফলেট ধরিয়ে দেয়া হচ্ছিল পথচারীদের হাতে। চমকপ্রদ এই দৃশ্য দেখে অভিভূত হয়েছেন নগরবাসী। তার চেয়ে বড় কথা, নামী দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে সংশয় শঙ্কার এই কালে আশাবাদী হওয়ার মতো বার্তা দিয়েছে কচিকাঁচার দল। উদ্যোগটি ঢাকার খুব নামকরা স্কুল-কলেজের একদল শিক্ষার্থীর। তাদের সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম ‘অনির্বাণ’। নটরডেম, ভিকারুন নিসা, মনিপুর, রেসিডেন্সিয়াল মডেলের মতো স্কুল-কলেজগুলো থেকে অনেকেই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। অনেক পুরনো অভিযোগ, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীরা ঘরকুনো। শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন। এখানে দেখা যায় বিপরীত চিত্র। গ্রীন হ্যারাল্ড, সানিডেল, স্কলার্স, কার্ডিফ, অক্সফোর্ডসহ বেশ কয়েকটি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা নিজেদের আগ্রহে কর্মসূচীতে যোগ দেয়। সংখ্যায় ওরা প্রায় তিন শ’। ঢাকার মোট দশটি স্পটে ভাগ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রতিটি জায়গা থেকে চারা বিতরণের কাজ চলে। শুরু হয় দুপুর ১২টায়, চলে বিকেল পর্যন্ত। এদিন মিরপুর রোডে ছিল বড়সড়ো জমায়েত। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সিটি কলেজের কাছের একটি ফুটপাথ বিভিন্ন গাছের চারা দিয়ে রীতিমতো সাজানো। পলিপ্যাকের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে চেনা-অচেনা অল্পচেনা গাছের নবীন পাতা এবং এই পাতার মতোই সবুজ সতেজ মনে হচ্ছিল ছেলেমেয়েগুলোকে। সবার গায়ে সবুজ টি-শার্ট। মুখে মিষ্টি হাসি। বাংলা ইংলিশের মিশেলে যে কথা বলা, সেখানেও অদ্ভুত সারল্য। অপেক্ষাকৃত সিনিয়র একজন সকলকে ডেকে কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছিল। সে অনুযায়ী, ফুটপাথ দিয়ে আসা যাওয়া করার সময় বিনীত ভঙ্গিতে পথচারীদের সামনে দাঁড়াচ্ছিল তারা। গাছের চারা হাতে তুলে দিচ্ছিল। প্রথমে অনেকেই তো অবাক! ইতস্তত করছিলেন। কেউ কেউ বলছিলেন, অন্য কাজে যাচ্ছি। এখন গাছ কিনব না। শিক্ষার্থীদের জবাবÑ গাছ নিলেই আমরা খুশি। কোন টাকা দিতে হবে না। এই দেখে সাধারণ মানুষও কাছে এসে লাজুক ভঙ্গিতে গাছ চেয়ে নিয়ে যায়। কর্মসূচীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন অভয় দত্ত। আর কিছুদিন পরই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আমেরিকা যাবেন। তার আগের সময়টা ভাল কিছু করে কাটাতে চান। তাই ‘অনির্বাণ’র সঙ্গে থাকা। এই তরুণ সংগঠনটির উদ্যোক্তাদের একজন। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে প্ল্যাটফর্মটি গড়ে তুলেছিলাম। নানা কর্মসূচী আমরা পালন করেছি। এবার গাছের চারা বিতরণ করলাম। তার মতে, গাছ মানুষকে অকৃত্তিমভাবে দান করে। শহর ঢাকা আজ যতটা বিবর্ণ, বিপন্ন, তার অনেকটাই বৃক্ষের অভাবে। এ কারণে গাছের চারা বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আরেক সংগঠক সারাফ বলেন, এই বর্ষা বৃক্ষ রোপণের উৎকৃষ্ট সময়। আমরা সময়টি কাজে লাগানোর আহ্বান জানাচ্ছি কর্মসূচীর মাধ্যমে। অমৃতাভ যেন আর গভীরে যান। বলেন, আগামী প্রজন্মকে সমাজের জন্য দেশের জন্য কিছু করতে হবে। সেই মানসিকতা এখান থেকে জাগ্রত হবে। আমরা এই আশা করছি। কর্মসূচীতে যোগ নেয়া শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ এসেছিল গ্রীন হ্যারাল্ড ইন্টান্যাশনাল স্কুল থেকে। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী আদৃতা এমন একটি উদ্যোগের সঙ্গে থাকতে পেরে খুব উৎফুল্ল। বার বার বলছিল, আমার নাম লিখবেন কিন্তু! নিজের স্কুলের কথাও বলল। জানাল, গ্রীন হ্যারাল্ড ক্যাম্পাসে বড় বাগান আছে। গাছে ভর্তি। গাছের নিচে তাদের ক্লাসও হয়। এসব কারণেই গাছের প্রতি প্রেম। একই স্কুলের আনিকা এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে একজনের হাতে গাছ তুলে দিচ্ছিল। পরীক্ষা নেয়ার মতো করে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়- কী গাছ এটি? নাম জান? ঝটপট জবাব, এটা তুলশী। তুলশী গাছের দু-একটি উপকারিতার কথাও জানিয়ে দেয় সে। সানিডেল স্কুলের সৌম্য জানায়, ফুটপাথে লোকজনের মধ্যে দাঁড়িয়ে গাছ বিতরণের মতো কাজ সে প্রথমবারের মতো করেছে। সমাজের ভালর জন্য কোন কাজ করার আনন্দটা তার ভাষায় ‘বিলিভ মি, অন্য রকম।’ প্রায় একই রকম উচ্ছ্বাস দেখা যায় তামিম, আবিদ, নিশাথ, আদিত্যদের চোখে মুখে। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের হাত থেকে বিনামূল্যে গাছের চারা গ্রহণ করে পথচারীরাও অভিভূত। দোকান কর্মচারী নূর ইসলাম তো দারুণ খুশি। বললেন, এই গাছটা বিনা টাকায় পাইলেও অনেক দামী। আমি এটা বড় করব। গাছ নিয়ে বেসরকারী একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সেলিনা আক্তার বললেন, গাছ আমার খুব প্রিয়। এই প্রথম কেউ ডেকে গাছ উপহার দিল। এটা নতুন অভিজ্ঞতা। ভাল লাগছে। তিনি গুরুত্ব দিয়ে বললেন, গাছ দেয়া নেয়া নয় শুধু, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাদের চারপাশ নিয়ে ভাবছে। এই ভাবনাটা আজকের দিনে বড্ড প্রয়োজন। আমি তাদের দেখে খুব আশাবাদী হয়েছি। আশা জেগে থাক- আমাদেরও তাই প্রত্যাশা।
×