তপন বিশ্বাস ॥ দেশে প্রথমবারের মতো কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনাকবলিত বা নিহত বা কোন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে আর্থিক সুবিধা পাচ্ছেন শ্রমিকরা। এতে শ্রমিকরা শুধু আর্থিক সুবিধাই নয়, পাচ্ছেন সামাজিক নিরাপত্তাও। সেই সঙ্গে শেষ বয়সে বেসরকারী শ্রমিকদের অসহায়ত্ব দূর এবং নিরাপত্তা বিধানে প্রভিডেন্ট ফান্ড গঠনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকার শ্রমিকদের কল্যাণে গঠন করেছে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল। এ পর্যন্ত এ তহবিলে ১৬০ কোটি টাকা জমা হয়েছে। শ্রম আইন সংশোধনের পর দেশের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে লভ্যাংশের অংশ এ তহবিলে জমা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করেছেন। তারই অংশ হিসেবে আমরা শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের ফান্ড বৃদ্ধি ও ব্যয়ের বিধিবিধান তৈরি করেছি। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে রফতানিমুখী সেক্টরের শ্রমিকদের কল্যাণে রফতানির ওপর থেকে ০.০৩ শতাংশ কর্তন করে ফান্ড তৈরি শ্রমিকদের কল্যাণে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। তিনি আরও বলেন. শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে বলব, এটি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজের একটি। এর মাধ্যমে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের (গার্মেন্টস) সার্বিক কল্যাণে বিশাল দিগন্ত উন্মোচিত হলো।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, এ কর্মসূচীর মাধ্যমে বাংলাদেশের শ্রমিকদের অসহায়ত্ব দূর হলো। শ্রমিকদের বিভিন্ন আর্থিক সহায়তা দেয়ার পাশাপাশি দুটি শ্রমিক হাসপাতালও গড়ে তোলা হবে। গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে দুটি বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে তোলা হবে, যা এ ফান্ডের টাকায় পরিচালিত হবে। সেখানে শ্রমিকদের পেশাগত কারণে সৃষ্ট রোগের ফ্রি চিকিৎসা দেয়া হবে। হাসপাতাল দুটির প্রতিটিই হবে ২শ’ বেডের। খুব শীঘ্র এর টেন্ডার আহ্বান করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শিল্পায়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, বহির্বিশ্বে দেশের সুনাম, মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত শ্রমিক ও শ্রমিকদের পরিবারের কল্যাণ সাধনের জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের আওতায় ‘বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন থেকে শ্রমিকদের কল্যাণে বিভিন্নভাবে অর্থ প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে কর্মরত অবস্থায় কোন শ্রমিক দৈহিক বা মানসিকভাবে স্থায়ী অক্ষম বা অসমর্থ হলে অথবা তার মৃত্যু ঘটলে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক অথবা তার পরিবার এককালীন অনধিক দুই লাখ টাকা অনুদান পাবে। এছাড়া মৃতদেহ পরিবহন ও সৎকারের জন্য শ্রমিক পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা সাহায্য প্রদান করা, দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসার জন্য অনধিক এক লাখ টাকা, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত মহিলা শ্রমিকের মাতৃত্ব কল্যাণে অনধিক ২৫ হাজার টাকা, কোন শ্রমিকের মেধাবী সন্তানের সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে অনধিক ২৫ হাজার টাকা ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারী মেডিক্যাল কলেজ এবং সরকারী কৃষি/প্রকৌশলী/প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারী অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি, শিক্ষা উপকরণ ও অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ বাবদ অনধিক তিন লাখ টাকা, কোন শ্রমিকের বিশেষ দক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ ২৫ হাজার টাকা প্রণোদনা প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়া শ্রমিকদের জীবন বীমাকরণের জন্য যৌথ বীমার প্রবর্তন এবং এ খাতে অত্র তহবিল থেকে সংশ্লিষ্ট বীমা প্রতিষ্ঠানকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ প্রিমিয়াম পরিশোধ করা হচ্ছে।
শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তা/অনুদান পাওয়ার জন্য নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে হবে। আবেদন ফরম শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে () পাওয়া যাবে। এছাড়া কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর এবং শ্রম পরিদফতরের প্রধান কার্যালয় ও স্থানীয় কার্যালয় থেকেও ফরম সংগ্রহ করা যাবে।
সূত্র জানায়, সংশোধিত শ্রম আইন অনুযায়ী কোন প্রতিষ্ঠানের বছরের লভ্যাংশের (নিট প্রফিট) ৫ শতাংশকে ১০০ ভাগ করে তার ৮০ ভাগ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তারা পান। বাকি ২০ শতাংশের ১০ শতাংশ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কল্যাণ ট্রাস্টে দেয়া হয়। বাকি ১০ শতাংশ বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিলে জমা হয়। বিগত ২০১৩-১৪ এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ পর্যন্ত মোট ১৬০ কোটি টাকা এ তহবিলে জমা হয়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের টাকা এখনও আসছে। শ্রমিকদের শিক্ষা/চিকিৎসা/কর্মস্থলে মৃত্যু/দুর্ঘটনা ইত্যাদিতে আর্থিক অনুদান দেয়া হচ্ছে। শ্রমিকদের কল্যাণে যৌথবীমার প্রিমিয়ামও দেয়া হচ্ছে। প্রতি বছর এ প্রিমিয়ামে অর্থের পরিমাণ ১৩০০ টাকা। এর মধ্যে শ্রমিক দেয় ৪৫০ টাকা এবং ফাউন্ডেশন দেয় ৮৫০ টাকা। এ পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার শ্রমিক বীমা করেছেন। পাঁচ বছর মেয়াদী এ বীমা ২০১৪ সাল থেকে শুরু হয়েছে।
এছাড়া রফতানিমুখী সকল শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে রফতানিমূল্য থেকে ওই সেক্টরের শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য ০.০৩ শতাংশ টাকা কেটে রেখে এ তহবিলে জমা করা হবে। চলতি বছরের (২০১৬) ১ জুলাই থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে রফতানিমূল্য থেকে কেটে ইতোমধ্যে তহবিলে টাকা জমা শুরু হয়েছে। এ খাতের তহবিলে জমা হওয়া টাকা দুই ভাগে ভাগ করা হবে। একভাগ শুধু শ্রমিকদের কল্যাণে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের বিধিমোতাবেক ব্যয় করা হবে। বাকি অর্ধেক রফতানিমুখী শিল্প সেক্টরে আপদকালীন কার্যক্রমে প্রয়োজনানুসারে ব্যয় করা হবে। এ তহবিল থেকে জার্মান সরকারের সহযোগিতায় দুর্ঘটনাকবলিত বীমা কর্মসূচী চালু করার পদক্ষেপ নেয়ার উদ্যোগ রয়েছে।
শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড ॥ শেষ বয়সে বেসরকারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিধানে প্রভিডেন্ট ফান্ড গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। সরকারের ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের সঞ্চয় স্কিমের আদলে এ প্রভিডেন্ট ফান্ড গড়ে তোলার লক্ষ্যে মন্ত্রণালয় কাজ করছে। এর মেয়াদ ১৫ বা ২০ বছর করা হতে পারে। বেসরকারী পর্যায়ের যে কোন শ্রমিক এ ফান্ড করতে পারবেন। এতে কোন শ্রমিক যে পরিমাণ টাকা রাখবেন, সরকারও ওই পরিমাণ টাকা প্রত্যেকের ফান্ডে জমা করবে। শ্রমিক ও সরকারের জমাকৃত টাকার ওপর নির্ধারিত হারে সুদও প্রদান করা হবে। নির্ধারিত মেয়াদ শেষে সুদসহ মোট জমাকৃত টাকার সঙ্গে ফাউন্ডেশন আরও দুই লাখ টাকা যোগ করে একসঙ্গে শ্রমিকের হাতে তুলে দেবে। কিস্তি চলাকালে কোন শ্রমিক মৃত্যুবরণ করলে তার (শ্রমিকের) জমাকৃত টাকার সঙ্গে সরকারের জমাকৃত টাকা এবং সুদসহ অতিরিক্ত দুই লাখ টাকা ওই শ্রমিকের পরিবারের বা নমিনির হাতে তুলে দেয়া হবে।