ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বর্ষায় সরব ব্যাঙরাজ্য

রাতভর ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ডাকাডাকি নয় শুধু, প্রণয় সম্ভাষণ

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৩ আগস্ট ২০১৬

রাতভর ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ডাকাডাকি নয় শুধু, প্রণয় সম্ভাষণ

মোরসালিন মিজান ॥ বর্ষার কাল। যখন তখন বৃষ্টি। রিমঝিম রিমঝিম শব্দ খুব কানে আসছে। একই সময়ের আরেকটি শব্দ অতিপরিচিত। গ্রামে ব্যাপক শোনা যায়। শহরে ডাকটা ঠিক কানে আসে না। কান পাতলে শোনা যায়। হ্যাঁ, ব্যাঙের ডাক। ব্যাঙ ডাকে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ। ভরা বর্ষায় ডাকটা যথারীতি শোনা যাচ্ছে। সারাবছরই থাকে ব্যাঙ। তবে এখন যৌবনা। বর্ষার জলে নতুন প্রাণ পেয়েছে। চলছে উৎসব। ব্যতিক্রমী উৎসবে নানা নামের হরেক জাত-পাতের ব্যাঙ যোগ দিয়েছে। এদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বর্ষা। বাংলাদেশের ৫৪ প্রজাতির উভচর প্রাণীর মধ্যে ব্যাঙ অন্যতম। প্রধানতমও বলা যায়। এ্যানিউরা বর্গের মেরুদ-ী প্রাণীটিকে স্থলভাগে কম-বেশি সারাবছর দেখা যায়। মূল আবাস জলে। বর্ষায় ডোবা-নালা, খাল-বিল ভরে উঠলে উৎসব শুরু হয়ে যায় ব্যাঙের। শুধু তাই নয়, এখন প্রজনন মৌসুম। স্ত্রী-পুরুষ একে অন্যের কাছাকাছি আসতে ব্যাকুল। অহর্নিশ ডাকাডাকি এ কারণেই। মূলত প্রণয় সম্ভাষণ! নিশাচর প্রাণী খাবার সংগ্রহসহ অন্য অনেক কাজ রাতে করে। রাতেই বেশি টের পাওয়া যায় অস্তিত্ব। বর্ষায় প্রায় প্রতিটি গ্রামেই দেখা মিলছে ব্যাঙের। বাড়ির আশপাশের বিল ঝিল-জলাশয় থেকে জলকেলির শব্দ ভেসে আসছে। শহরেও এখন জলজট। নিচু জায়গাগুলোতে জল জমেছে। ঝিলগুলো পানিতে পূর্ণ। সবখানেই দৃশ্যমান হচ্ছে ব্যাঙ। কেউ কেউ ভাবতে পারেন, যান্ত্রিক ঢাকায় ব্যাঙের কোন অস্তিত্ব নেই। আদতে তা নয়। কৌতূহলীরা ঠিক এই মুহূর্তে মতিঝিল এলাকাটি ঘুরে আসতে পারেন। খালে খুঁজতে হবে না। এখানে অনেকগুলো সরকারী কলোনি। প্রায় প্রতিটির সামনে খোলা জায়গা। অপেক্ষাকৃত নিচু জায়গায় জল জমেছে। আষাঢ়ের শুরু থেকেই এসব স্থানে ব্যাঙের সরব উপস্থিতি। তবে ব্যাঙের জাত-পাত বোঝা সাধারণের পক্ষে একটু কঠিন। বিষয়টির ওপর অত বেশি গবেষণা নেই। প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন এক্ষেত্রে সহায়ক। ফাউন্ডেশন থেকে বেশকিছু ব্যাঙের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়। যেমনÑ কোলা ব্যাঙ, কুনো ব্যাঙ, সবুজ ব্যাঙ, ঝিঁ ঝিঁ ব্যাঙ, কটকটি ব্যাঙ, চীনা ব্যাঙ, বড় লাউবিচি ব্যাঙ, কোপের আসাম ব্যাঙ, ভামো ব্যাঙ, ডোরা গেছো ব্যাঙ, লাল চোখা ব্যাঙ, লাল পা গেছো ব্যাঙ। আরও কত কত নাম! বাংলাদেশের মানুষের কাছে বিশেষ চেনাজানা কুনো ব্যাঙ। বাড়ির আশপাশে থাকে। মাটির ঘরের মেঝে ও অন্ধকার এদের পছন্দ। দিনে চুপটি করে বসে কাটায়। রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সরব হয়। কুনো ব্যাঙের উপরের অংশ বাদামী। ত্বক খসখসে। আঁচিলযুক্ত। পেটের দিকটা সাদা দেখতে। মাথা তুলনামূলক বড় ও চওড়া। স্ত্রী ব্যাঙ পুরুষের তুলনায় মোটা। এরা বেশিরভাগ সময়ই ডাঙায় থাকে। গড় আয়ু চার বছর। কোলা ব্যাঙও বেশ পরিচিত। এটিকে সোনা ব্যাঙ নামে ডাকা হয়। আকারে কোলা ব্যাঙ দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ। গায়ের রং ধূসর বাদামী কিংবা হলুদ দেখতে হয়। পায়ের গড়ন শক্ত হওয়ায় জলে ও স্থলে স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করতে পারে। কিছু ব্যাঙ বাড়তি সৌন্দর্যের কারণে নজর কারে। যেমন সবুজ ব্যাঙ। গাঢ় সবুজ রঙের বলেই সবুজ ব্যাঙ নাম। জলজ উদ্ভিদের সঙ্গে গায়ের রং মিলেমিশে যায়। তাই সহজে চোখে পড়ে না। সবুজ ব্যাঙের মাথা চ্যাপ্টা। চোখ মাথার বেশ কাছাকাছি দূরত্বে থাকে। এদের নাকের অগ্রভাগ থেকে একটি হলদে রেখা পিঠের মাঝ দিয়ে শরীরের শেষভাগ পর্যন্ত চলে গেছে। জীবনের বেশিরভাগ সময় পানিতে কাটায়। ঝিঁ ঝিঁ ব্যাঙ বাসাবাড়ি, ধানক্ষেত ও এর আশপাশে দেখা যায়। ভেজা মাটি বা অল্প পানিযুক্ত স্থানে থাকে। গায়ের রং ধূসর বাদামী। পিঠে আঁচিলযুক্ত। মাঝে মাঝে হালকা সবুজের ছোপ থাকে। ঝিঁ ঝিঁ ব্যাঙ আবার দিনরাত উভয় সময়ই চলাচল করে। ব্যাঙের অদ্ভুত আরেকটি নাম কটকটি। এ ব্যাঙ দেশের সর্বত্রই দেখা যায়। সাধারণত ডোবা-নালা, খাল-বিলে ভাসমান অবস্থায় থাকে। জীবনের পুরো সময় পানিতে কাটায়। গায়ের রং বাদামী কিংবা ধূসর। দেহে ছোট ছোট আঁচিল। এটিও দিন ও রাতে সমান কর্মচঞ্চল। বর্ষকালে ঝাঁকবেঁধে চলে। চীনা ব্যাঙ দেখতে লালচে কিংবা ধূসর জলপাই রঙের। দুই চোখের মাঝামাঝি জায়গা থেকে শুরু হয়ে একটি কালচে রেখা দেহের পেছনের দিকে চলে গেছে। দেহ মসৃণ ত্বক দ্বারা আবৃত। পেটের দিক হলদে সাদা। চীনা ব্যাঙ লম্বায় প্রায় ২৫ মিলিমিটার। সাধারণত স্যাঁতসেঁতে জমি, ভেজা ঘাস, পাতার স্তূপ এবং জলাধারের নিকটবর্তী জায়গায় বিচরণ করে। ফাউন্ডেশনের গবেষণামতে, বড় লাউবিচি ব্যাঙ বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে মিশ্র চিরসবুজ বন এবং শালবনে দেখা যায়। এরা দেখতে লালচে বাদামী রঙের হয়। দেহের দু’পাশে কালো রঙের ছোপ ছোপ দাগ থাকে। দেহের দৈর্ঘ্য ৩০ থেকে ৪৫ মিলিমিটার। সাধারণত গর্তে থাকতে পছন্দ করে। পাহাড়ী ছড়ার ধারে কিংবা পানিতেও বিচরণ করে। কোপের আসাম ব্যাঙ শালবন ও পাহাড়ী চিরসবুজ বনে বিচরণ করে। মানব বসতির আশপাশে দেখা যায় না। এরা দেখতে গাঢ় বাদামী রঙের। পিঠে বিন্দু বিন্দু কালো দাগ থাকে। দিনের বেলায় জলাশয় কিংবা জলাশয়ের আশপাশের সিক্ত জায়গায় অবস্থান নেয়। খড়কুটোর আড়ালে থাকে। সন্ধ্যার পর খাবারের সন্ধানে বের হয়। দুর্লভ ব্যাঙগুলোর মধ্যে বলতে হয় ভামো ব্যাঙের কথা। চিরসবুজ বনে অল্প সংখ্যায় দেখা যায়। দেহের দৈর্ঘ্য ৫০ থেকে ৮০ মিলিমিটার। পিঠের রং উজ্জ্বল সবুজ কিংবা জলপাই রঙের হয়। পেটের দিক সাদা। পিঠের দু’পাশে চোখের পেছন থেকে দেহের পশ্চাৎ প্রান্ত পর্যন্ত লম্বালম্বি সোনালি রঙের দুটি ভাঁজ দেখা যায়। চোখের পেছনে বেশ বড় আকারের টিম্পেনাম রয়েছে, যা শ্রবণেন্দ্রিয়ের কাজ করে। ডোরা গেছো ব্যাঙ গাছেই থাকে। গায়ের রং হলদে বাদামী। পিঠের উপরে হালকা কালো রঙের তিনটি ডোরা সহজে চোখে পড়ে। দেহ বেশ সরু। লাল চোখা ব্যাঙের চোখের উপরের অংশ গাঢ় কমলা বা লাল রঙের হয়। পাহাড়ী অঞ্চলের ছড়ায় দেখা যায়। দেহ ধূসর কিংবা কালচে। লাল পা গেছো ব্যাঙ দেখতে জলপাই সবুজ। পেটের দিকে হলুদ। সব মিলিয়ে বিচিত্র ব্যাঙরাজ্য। এ রাজ্যের প্রায় সবাই এখন বর্ষা উৎসবে মেতেছে। ব্যাঙ এবং বর্ষার এ যুগল উৎসব প্রকৃতির বিরল সৌন্দর্যকে তুলে ধরছে। এ সৌন্দর্য অটুট থাক। উপভোগ্য হোক আরও।
×