ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ই-টেন্ডারিংয়ের আওতায় আসছে সরকারী সব খাত

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২৯ জুলাই ২০১৬

ই-টেন্ডারিংয়ের আওতায় আসছে সরকারী সব খাত

আনোয়ার রোজেন ॥ সরকারী ক্রয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে আগামী বছরের শুরুতেই সব খাতে ই- টেন্ডারিং চালু করতে কাজ করছে সরকার। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সব মন্ত্রণালয়, বিভাগে ই- টেন্ডারিং পদ্ধতি সম্পন্ন করতে সরকার থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যাতে ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে সব স্তরে ই-টেন্ডার চালু করা যায়। সেই লক্ষ্যে ২০০ টেরা-বাইট ধারণক্ষমতার ডাটা সেন্টার স্থাপনের কাজ শুরু করেছে সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট (সিপিটিইউ)। এটি বিদ্যমান মাত্র ছয় টেরা-বাইট ধারণক্ষমতার ডাটা-সেন্টারকে প্রতিস্থাপিত করবে। ফলে নতুন করে তিন লাখ ২৫ হাজার নিবন্ধিত দরদাতার (বিডার) তথ্য এতে সংরক্ষণ করা যাবে। জানা গেছে, তিন মাসের মধ্যে এটি নির্মাণ করা সম্ভব হবে। ডাটা সেন্টারটি চালু হলেই ই-টেন্ডারিংয়ের আওতায় আনা যাবে সব খাতকে। ফলে এক্ষেত্রে দুর্নীতি, অনিয়ম, সন্ত্রাস ও টেন্ডারবাজি ঠেকানো যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। একইসঙ্গে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে দরপত্রের প্রস্তাব, মূল্যায়ন, চুক্তি ব্যবস্থাপনা ও ই-পেমেন্টসহ সংশ্লিষ্ট কাজগুলো স্বল্প সময়ে, সহজে এবং সমন্বিতভাবে করা সম্ভব হবে। কমবে দরদাতাদের ভোগান্তি, বাড়বে সরকারের রাজস্ব। আর এর মধ্য দিয়ে অবসান ঘটবে প্রচলিত কাগজের দরপত্র যুগের। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রিফর্ম প্রজেক্ট টুয়ের (পিপিআরপি-টু) আওতায় সরকারী ক্রয় ব্যবস্থার আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। সে অনুযায়ী উন্নয়ন কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করা ও সরকারী অর্থ ব্যয়ে অধিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্যই পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয় ই-টেন্ডারিং ব্যবস্থা। ২০১১ সালের ২ জুন এ প্রক্রিয়ার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে এই কার্যক্রম বাস্তবায়নে সহযোগিতা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। প্রথম পর্যায়ে সরকারী চারটি সংস্থা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি), সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ), বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এবং বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে (বিআরইবি) পরীক্ষামূলকভাবে ই-টেন্ডারিং চালু করা হয়। এসব সংস্থায় সরকারী কেনাকাটার মোট প্রায় ৫০ শতাংশ সম্পন্ন হয়। পরীক্ষামূলক প্রকল্পের সফলতার পরই দেশের সব সরকারী অফিসকে ই-টেন্ডারিংয়ে যুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। সম্প্রতি প্রকল্পের আওতায় একটি নতুন ‘স্টেট অব দ্য আর্ট ডাটা সেন্টার’ নির্মাণের জন্য এক কোটি ডলার অতিরিক্ত ঋণ সহায়তা দিতে রাজি হয়েছে বিশ্বব্যাংক। এ প্রসঙ্গে সিপিটিইউর মহাপরিচালক ফারুক হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, মূল চুক্তিতে ডাটা সেন্টার নির্মাণের বিষয়টি ছিল না। বিদ্যমান ডাটা-সেন্টারের যে ধারণক্ষমতা তাতে সব খাতের ক্রয় কার্যক্রম অনলাইনে আনা সম্ভব নয়। তাই এজন্য নতুন করে চুক্তি করা হয়েছে। তিনি জানান, আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই স্থাপন করা হবে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ডাটা সেন্টার। অক্টোবরের মধ্যে এটি পুরোপুরি কার্যকর করা সম্ভব হবে। আর লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ডিসেম্বরের মধ্যেই দেশের সব সরকারী সংস্থার ক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা ও অনলাইনে দরপত্র প্রক্রিয়াকরণ করা যাবে। সূত্র জানায়, পরীক্ষামূলক ই- টেন্ডারিংয়ের শুরু থেকে ২৫ জুলাই পর্যন্ত এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে ২১ হাজার ঠিকাদার যুক্ত হয়েছে। এসময়ে ৫৫ হাজারেরও বেশি সরকারী দরপত্র অনলাইনে প্রক্রিয়াজাত হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য পাঁচ দশমিক আট বিলিয়ন ডলার (প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা)। টেন্ডার প্রক্রিয়াকরণের সময় ৫১ দিন হতে কমিয়ে ২৯ দিনে আনা সম্ভব হয়েছে। নিবন্ধিত মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮১টি। ই-পেমেন্ট কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নিবন্ধিত হয়েছে ৪১টি ব্যাংক। সারাদেশে এসব ব্যাংকের দুইশয়ে বেশি শাখা ই-টেন্ডারিংয়ের জন্য ই-পেমেন্ট কাজ পরিচালনা করছে। সিপিটিইউ সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সবগুলো মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে ই-জিপির আওতায় আনার লক্ষ্যে ডাটা সেন্টার স্থাপনে ইতিমধ্যেই সিপিটিইউ এবং সিঙ্গাপুরভিত্তিক থাকরাল ইনফরমেশন সিস্টেমস প্রাইভেট লিমিটেডের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়েছে। চুক্তির আওতায় উচ্চ ক্ষমতার ওই ডাটা সেন্টারটি বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিএস) জাতীয় ডাটা সেন্টারে স্থাপন করা হবে। একই সঙ্গে এর মিরর ডাটা সেন্টার স্থাপন করা হবে সিপিটিইউ কার্যালয়ে। এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা হবে অধিকতর উন্নত এবং এর ধারণক্ষমতা হবে বর্তমান ডাটা সেন্টারের ১৮০ গুণ। ডাটা সেন্টারের আর্কাইভে সংরক্ষণ করা যাবে প্রায় আট দশমিক ছয় মিলিয়ন ( ৮০ লাখ ৬০ হাজার) টেন্ডার। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর রাজশ্রী এস পারালকার বলেন, সরকারী ক্রয় ব্যবস্থার সংস্কারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। এক্ষেত্রে শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, বিশ্বের মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্যও বাংলাদেশ উদাহরণ হতে পারে। ক্রয় ব্যবস্থার সংস্কারের ইতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়েছে। যে চারটি সংস্থায় এ পদ্ধতি অনুসৃত হচ্ছে সেখানকার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার হার ২৭ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা প্রকারান্তরে দারিদ্র বিমোচনের গতি তরান্বিত করছে। ভবিষ্যতে এই হার আরও দ্রুত বাড়বে। তিনি আরও জানান, বিশ্বব্যাংক সরকারী ক্রয়ের বিষয়ে পেশাগত সনদ ও প্রশিক্ষণে আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রাখবে। প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে ব্রিটেনভিত্তিক চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব প্রকিউরমেন্ট এ্যান্ড সাপ্লাই থেকে ৮৯ জন সরকারী কর্মকর্তা প্রফেশনাল ডিপ্লোমা ও ৮৪ জন কর্মকর্তা প্রকিউরমেন্ট বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেছেন। এছাড়া সরকারের প্রতিটি বিভাগে প্রকিউরমেন্ট বিষয়ে যাতে অন্তত একজন মাস্টার ট্রেনার থাকেন সে অনুযায়ী প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। বিভিন্ন পর্যায়ে ইতোমধ্যে দুই হাজার সাতশ’ জনকে প্রকিউরমেন্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে, যা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।
×