ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

জামায়াতের প্রতিনিধি আবু বকর মোল্লাকে বের করে দেয়া হয়েছে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট থেকে বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার পরামর্শ

নিষিদ্ধ হচ্ছে জামায়াত

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২১ জুলাই ২০১৬

নিষিদ্ধ হচ্ছে জামায়াত

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ হতে চলেছে। এখন থেকে জামায়াতের কোন প্রতিনিধি দেশটির পার্লামেন্টে যেন প্রবেশ করতে না পারে যুক্তরাজ্য সরকার সে বিষয়ে উদ্যোগ নিচ্ছে। এদিকে জামায়াতে ইসলামীর ইউরোপের মুখপাত্র আবু বকর মোল্লাকে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। যুক্তরাজ্য পার্লামেন্টের নিম্ন কক্ষ হাউস অব কমন্সের অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের বাংলাদেশ বিষয়ক চেয়ার ও এমপি এ্যান মেইন জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে জামায়াতে ইসলামীর কোন প্রতিনিধি যেন যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে প্রবেশ করতে না পারেন সেটা তিনি নিশ্চিত করবেন। মঙ্গলবার হাউস অব কমন্সে বাংলাদেশ বিষয়ক বিতর্ক অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর ইউরোপের মুখপাত্র আবু বকর মোল্লাকে হাউস অব কমন্স থেকে বের করে দেয়ার রুলিং দিয়ে এমন মন্তব্য করেন তিনি। যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে ‘বাংলাদেশ-অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও রাজনৈতিক দলের ভূমিকা’ শীর্ষক এক বাংলাদেশ বিষয়ক বিতর্কের আয়োজন করা হয়। এতে বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. এইচ টি ইমাম, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, জাতীয় পার্টি নেতা ও পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম প্রমুখ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। বিতর্কে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রতিনিধিরা পরস্পরের প্রতি অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের মধ্যেই তাদের বক্তব্য শেষ করেন। এতে যৌথভাবে সভাপতিত্ব করেন যুক্তরাজ্য হাউস অব লর্ডসের সদস্য লর্ড কার্লাইল ও যুক্তরাজ্য হাউস অব কমন্সের বাংলাদেশ বিষয়ক অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের চেয়ার ও কনজারভেটিভ দলীয় এমপি এ্যান মেইন। বিতর্কে সায়মন ডানসাক এমপি, রিচার্ড ফুলার এমপি, এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আব্বাস ফয়েজ, হিউম্যান রাইট ওয়াচের ব্রাড এডামস প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধির বক্তব্য শেষে প্রশ্নোত্তরের সুযোগ দিলে জামায়াতে ইসলামীর ইউরোপীয় মুখপাত্র ব্যারিস্টার আবু বকর মোল্লা জামায়াতের পক্ষে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করেন। সে সময় ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম অনুষ্ঠানের চেয়ার এমপি এ্যান মেইনকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘জামায়াত এখানে আছে জানলে আমরা এই সেমিনারে যোগ দিতাম না।’ সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতারাও একযোগে জামায়াতের উপস্থিতির প্রতিবাদ জানাতে থাকলে এ্যান মেইন আবু বকর মোল্লাকে হাউস অব কমন্স ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু আবু বকর মোল্লা এটি গণতান্ত্রিক আচরণ নয়, এমন মন্তব্য করতে থাকলে এ্যান মেইন পার্লামেন্টের সিকিউরিটি অফিসারদের ডেকে আবু বকর মোল্লাকে সেখান থেকে বের করে দেন। সূত্র জানায়, লন্ডনের হাউস অব কমন্সে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তার কোন বক্তব্য দেয়ার কথা ছিল না। তবে প্রশ্নোত্তর পর্বের সুযোগ নিয়ে তিনি বক্তব্য প্রদান করায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। লন্ডনের পার্লামেন্টে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরা অবহিত করেন, জামায়াতে ইসলামী একটি সন্ত্রাসী দল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায়ে জামায়াতকে জঙ্গী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করেছে। তবে এমন একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গ ত্যাগ করতে বিএনপিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নও পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু বিএনপি জামায়াতকে ছেড়ে যাওয়া তো দূরের কথা বরং তারা জঙ্গীবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছে। আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদের বক্তব্য মিথ্যা বলে দাবি করেছিলেন আবু বকর মোল্লা। তখন আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিরা পার্লামেন্টকে জানান, সেখানে জামায়াত প্রতিনিধি থাকলে তারা বেরিয়ে যাবেন। এ সময় জামায়াত নেতা আবু বকর মোল্লাকে পার্লামেন্ট থেকে বের করে দেন এমপি এ্যান মেইন। আবু বকর মোল্লা পার্লামেন্ট থেকে বেরিয়ে আসার পর লন্ডনের সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিষয়ক বিতর্কে আমন্ত্রিত হয়েই পার্লামেন্টে গিয়েছিলেন। লর্ড কার্লাইল তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ও তাকে বক্তব্য দিতে দেয়া হবে বলেও জানানো হয়েছিল বলেও দাবি করেন তিনি। তবে লর্ড কার্লাইলের অতিথি তালিকায় অথবা বক্তব্য প্রদানকারীর তালিকায় তার নাম রয়েছে এমন প্রমাণপত্র সাংবাদিকরা দেখতে চাইলে তিনি তা দেখাতে পারেননি। ইউরোপে জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র হিসেবে ব্যারিস্টার আবু বকর মোল্লা কাজ করছেন। সিটিজেন মুভমেন্ট ও যুব কাউন্সিলের ব্যানারেও তিনি লন্ডন ও ইউরোপের বিভিন্ন শহরে জামায়াতের পক্ষ হয়ে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে এই বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে তিনি ইউরোপে লবিং অব্যাহত রেখেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে বাংলাদেশের জামায়াত নেতাদের বিচারিক হত্যা করা হচ্ছে বলেও তিনি বিভিন্ন সময়ে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়েছেন। জামায়াতে ইসলামীর লবিংয়েরই অংশ হিসেবে আবু বকর মোল্লা মঙ্গলবার ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উপস্থিত হয়েছিলেন। তবে আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রতিবাদের মুখে তাকে বের করে দেয়া হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টেও একাধিকবার আলোচনায় বিএনপিকে জামায়াতে ইসলামী ছাড়ার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক কমিটির প্রধান জিন ল্যাম্বার্ট বাংলাদেশে একাধিকবার সফরে এসে বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেই বৈঠকেও জামায়াতে ইসলামীকে সন্ত্রাসী ও জঙ্গী সংগঠন হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে বিএনপিকে দলটির সঙ্গ ত্যাগ করার জন্য পরামর্শ দেন। তবে বিএনপি ইউরোপীয় পার্লামেন্টের কোন পরামর্শ গ্রহণ করেনি। তারা তাদের পূর্বের অবস্থানেই রয়ে গেছে। এখন যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে বিএনপিকে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ত্যাগ করার জন্য নতুন করে বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এমপি এ্যান মেইন। এদিকে চলতি বছরের এপ্রিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ড. সারাহ সুয়ল ও সহকারী সেক্রেটারি এ্যালান বার্সিন বাংলাদেশ সফর করেন। সে সময় তাদের সঙ্গে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এক বৈঠক শেষে জানান, জামায়াতে ইসলামী যে সন্ত্রাসী সংগঠন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এখন সেটা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছে। যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্সে বিতর্ক শেষে পার্লামেন্টের বাইরে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম সাংবাদিকদের জানান, পার্লামেন্টে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে। অতীত ভুলে ভবিষ্যৎ উন্নয়নে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়েছে আমাদের। আমরা বলেছি অতীত মানে ১৯৭১, যেটা বাঙালী কখনও ভুলতে পারবে না। বাঙালীর চেতনার সঙ্গে মিশে আছে একাত্তর। সুতরাং আমাদের যেটাই করতে হবে, একাত্তরের চেতনাতেই করতে হবে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত রাজনৈতিক দল জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ত্যাগের বিভিন্ন মহলের পরামর্শের কথা উল্লেখ করে এইচটি ইমাম বলেন, আমরাও বার বার বলছি যুদ্ধাপরাধী দলের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে বিএনপি জনগণের কাতারে ফিরে আসুক। জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় বিএনপির জাতীয় ঐক্যের আহ্বানে কি সরকার সাড়া দেবে এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রীর রজিনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম বলেন, জঙ্গীবাদের মূল উৎস জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গীবাদ বিরোধী জাতীয় ঐক্যের সেøাগান দেয়া তো তামাশা ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা তো বলেছি যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে জনগণের কাতারে ফিরে না এলে বিএনপির সঙ্গে কোন ঐক্য হতে পারে না। বিএনপি কি জামায়াতের সঙ্গ ছাড়বেÑ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে বিএনপি প্রতিনিধি দলের নেতা আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমাদের ওপর এই দায় চাপানো কেন? সরকার জামায়াতের রাজনীতি বন্ধ ঘোষণা করলেই তো হয়। জামায়াত বন্ধ হয়ে গেলে তো আর আমাদের সঙ্গে থাকে না। উল্লেখ্য, হাউস অব কমন্সে বাংলাদেশ বিষয়ক বিতর্কের মূল অনুষ্ঠানের কোন তথ্য প্রকাশ করার নিয়ম না থাকায়, হাউস অব কমন্সের বাইরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেয়া বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে হাউস অব কমন্সের চাটহ্যাম হাউজ ল অনুসরণ করা হয়েছে।
×