ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

২৫০০০ গাছ কাটা হবে! ॥ লাউয়াছড়া সংরক্ষিত উদ্যান নিয়ে রেলওয়ে

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২২ জুন ২০১৬

২৫০০০ গাছ কাটা হবে! ॥ লাউয়াছড়া সংরক্ষিত উদ্যান নিয়ে রেলওয়ে

মশিউর রহমান খান ॥ ঢাকা থেকে সিলেট রুটে যাত্রীসেবা বাড়াতে ট্রেন চলাচল নির্বিঘœ করতে ও বিভিন্ন দুর্ঘটনা এড়াতে মৌলভীবাজার জেলার লাউয়াছড়া সংরক্ষিত জাতীয় উদ্যানের প্রায় ২৫ হাজার গাছ কেটে ফেলতে চায় বাংলাদেশ রেলওয়ে। বন বিভাগের জরিপ অনুযায়ী, এসব গাছের বয়স ৫ বছর থেকে শুরু করে শতবর্ষী কিংবা তার অধিক। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এসব গাছ কাটতে বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগে চিঠি দিয়েছে। উদ্যান এলাকার রেললাইনের উভয়পাশের প্রায় ৫ কিলোমিটার বন এলাকার ন্যূনতম ৫০ ফুট পর্যন্ত গাছ কাটতে হবে। অপরদিকে বন বিভাগ এসব গাছ কোনক্রমেই কাটতে রাজি নয়। তাদের মতে, লাউয়াছড়া বন সরকার ঘোষিত সংরক্ষিত এলাকা। এ বনাঞ্চল থেকে যে কোনো ধরনের গাছ কাটা ও অপসারণ নিষিদ্ধ। প্রয়োজনে বন বিভাগের এলাকায় নির্মিত রেললাইন সরিয়ে অন্যত্র নির্মাণ করা হোক তবু কোনক্রমেই এসব গাছ কাটতে দেয়া যাবে না। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, এসব গাছ কাটা হলে বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে, যা কোনক্রমেই পূরণ করা সম্ভব হবে না। এ নিয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের মাঝে চিঠি চালাচালি শুরু হয়েছে। বন বিভাগের উত্তরে রেল কর্তৃপক্ষও বন বিভাগকে এসব গাছ কাটতে সাত কর্মদিবস নির্ধারণ করে দিয়েছে। অন্যথায় রেল কর্তৃপক্ষ নিজেরাই এসব গাছ কাটতে শুরু করবে বলে বন বিভাগকে জানিয়ে দিয়েছে। সর্বশেষ তথ্যমতে, রেল কর্তৃপক্ষ সাত কর্মদিবস পার হয়ে গেলেও গাছ কাটা শুরু করেনি। সংরক্ষিত বনের মধ্য দিয়ে যাওয়া রেললাইনের দুই পাশের গাছগুলো বহু পুরনো হলেও এতদিন এসব গাছ নিয়ে তেমন সমস্যা না হলেও গত কয়েক মাসে সৃষ্ট কয়েকটি ঝড়ে রেললাইনের ওপর গাছ পড়ে যাওয়ায় কয়েক দফায় ঢাকা-সিলেট রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে যাত্রীদের দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। পরে গাছ কেটে লাইন ঠিক করে পুনরায় ট্রেন চালু করতে হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে রেল কর্তৃপক্ষ রেললাইনের দুপাশের সকল ঝুঁকিপূর্ণ ছোটবড় ২৫ হাজার গাছ কেটে ফেলতে চাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া বনের ভেতর ঢাকা-সিলেট রেললাইনের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকা অবস্থিত। এ রেললাইনের দুই পাশে ছোটবড় প্রায় ২৫ হাজার গাছ রয়েছে । বর্ষা মৌসুমে ঝড়ে অনেক সময় এসব গাছ উপড়ে রেললাইনের ওপর পড়ে। এতে ট্রেন চলাচলে বিঘœ সৃষ্টির পাশাপাশি প্রায়ই নানা দুর্ঘটনা ঘটে। রেল কর্তৃপক্ষ এ জাতীয় দুর্ঘটনা এড়াতে ও ট্রেন চলাচল নির্বিঘœ করতে এসব গাছ কেটে ফেলতে চিঠি দিয়েছে। তবে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের আশঙ্কা সংরক্ষিত এ বনাঞ্চলের এই বিপুলসংখ্যক গাছ কাটা পড়লে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। তাদের মতে, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান সরকার ঘোষিত সংরক্ষিত এলাকা। এ বনাঞ্চল থেকে যে কোন ধরনের গাছ কাটা ও অপসারণ নিষিদ্ধ। পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনও বনের ভেতর থেকে বিদ্যমান রেললাইন অপসারণের দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের মতে, বনের মধ্য দিয়ে ট্রেন চলাচলের কারণে বনের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যে বিরূপ প্রভাব পড়ে। নিভৃতচারী বিভিন্ন প্রাণীর স্বাভাবিক জীবনচক্র ও আবাসস্থলের ওপর এর প্রভাব মারাত্মক হতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে এর বিরোধিতা করা হলেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এখন উল্টো রেল চলাচল নির্বিঘœ করার অজুহাতে ২৫ হাজারের বেশি গাছ কাটার কথা বলা হচ্ছে। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, গত ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ রেলওয়ে ঢাকার বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ মোঃ আরমান হোসেন মোলবীবাজার জেলা বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগে একটি চিঠি দেন। এতে বলা হয়, ঢাকা-সিলেট রেললাইনের শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সেকশনের ২৯৩/১ থেকে ২৯৮/১ কিলোমিটারের পাহাড়ি এলাকায় ঝড়-বৃষ্টিতে গাছ উপড়ে ও ভেঙ্গে রেললাইনের ওপর পড়ছে। এতে যে কোন সময় দুর্ঘটনা ও যাত্রীসাধারণের প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া ২০১৫ সালের ২১ এপ্রিল রাতে ঝড়ে ৩০-৩৫টি গাছ রেললাইনের ওপর ভেঙ্গে পড়ে। এতে ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়। এছাড়া চলতি বছরের ৭ এপ্রিল রাতে ঝড়ে আরও ৩০ টির মতো গাছ রেললাইনের ওপর পড়ে। এতে উপবন এক্সপ্রেসের ইঞ্জিনের একটি হেডলাইট ভেঙ্গে যায় ও ট্রেনটি আটকা পড়ে। এ অবস্থায় উদ্যান এলাকার রেললাইনের উভয়পাশের ন্যূনতম ৫০ ফুট পর্যন্ত গাছ কাটতে হবে। একইভাবে রেললাইনের রশিদপুর-সাতগাঁও বিভাগের ২৭১/২ থেকে ২৭৯/৭ কিলোমিটার পর্যন্ত উভয় পাশের গাছও কাটতে হবে। না হলে পরবর্তী সময়ে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে ‘দ্য রেলওয়েজ এ্যাক্ট-১৮৯০’র ১২৮ ধারা মোতাবেক পদক্ষেপ নেয়া হবে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের এ চিঠির জবাবে গত ১২ মে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ এর বিপরীতে চিঠি দেয়। বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মিহির কুমার দে স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া উদ্যানটি ১৬৭ প্রজাতির বৃক্ষ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ীসহ অসংখ্য বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল। এর ভেতরে শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সেকশনের রেললাইনের ২৯৩/১ থেকে ২৯৮/১-এ পাঁচ কিলোমিটার এলাকার উভয়পাশে ৫০ ফুট এলাকার মধ্যে জরিপে দেখা গেছে, এখানে পাঁচ বছর থেকে শতবর্ষী ও তার অধিক বয়সী ২৫ হাজারের বেশি গাছ আছে। এছাড়া এ এলাকার প্রতি বর্গমিটারে আছে ২০টি করে চারাগাছ ও অন্যান্য লতাপাতা- ঝোপঝাড়। এসব স্থানে বিভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য বন্যপ্রাণী বাস করে। এসব গাছ কাটা হলে বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। এ চিঠির প্রত্যুত্তরে ১৮ মে রেলওয়ে থেকে বন কর্মকর্তাকে আরেকটি চিঠি দেয়া হয়। এতে বলা হয়, রেলপথের উভয়পাশের গাছ কাটার অনুরোধ জানানো হলেও এ বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে গাছগুলো না কাটলে রেলওয়ে আইন অনুযায়ী রেল কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে। তবে গতকাল পর্যন্ত রেলওয়ের পক্ষ থেকে গাছ কাটার কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বন ও পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু জনকণ্ঠকে বলেন, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ট্রেন চলাচলের সুবিধার্থে মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া সংরক্ষিত জাতীয় উদ্যানের ভেতরে রেললাইনের দুপাশে প্রায় ২৫ হাজার গাছ কাটার জন্য চিঠি দিয়েছে বলে জানতে পেরেছি। কিন্তু এটি একটি সরকার ঘোষিত সংরক্ষিত বন। তাই নিয়মানুযায়ী ইচ্ছে করলেও ৫ বছর থেকে শতবর্ষী হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলা সম্ভব নয়। রেলওয়ের চিঠিটি নিয়মানুযায়ী আমার কাছে এলে আমি তা চূড়ান্ত যাছাই বাছাই শেষে প্রয়োজনে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠাব। অনুমতি সাপেক্ষে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে, যা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার বটে। এছাড়া পরিবেশবন্ধু বনের এসব গাছ কাটার ক্ষমতা আমার নেই, এমনকি রেল কর্তৃপক্ষেরও নেই। এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা সংরক্ষিত বন ছাড়াও সকল বনের পরিবেশ ও বৈচিত্র্য রক্ষার পক্ষে কাজ করি। ট্রেন চলাচল নির্বিঘœ করতে ও বিভিন্ন দুর্ঘটনা এড়াতে মৌলভীবাজার জেলার লাউয়াছড়া সংরক্ষিত জাতীয় উদ্যানের ভেতর প্রায় ৫ কিলোমিটার এলাকায় রেললাইনের সীমানার দুপাশের ৫০ ফটের মধ্যে অবস্থিত প্রায় ২৫ হাজার গাছ কেটে ফেলা প্রয়োজন। যাত্রাপথে চলাচল নিশ্চিত ও নিরাপদ করতেই এসব গাছ কাটতে বন বিভাগকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এসব গাছ কাটা হলে নির্দিষ্ট সীমানায় প্রয়োজনে আরও ৩ গুণ বেশি গাছ লাগানো হবে। মূলত রেলপথ দিয়ে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে গিয়ে এসব গাছ সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামন্য ঝড়েই রেললাইনের ওপর বড় বড় গাছ ভেঙ্গে পড়ে। ফলে এ রুটে মাঝে মাঝে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরিবেশ রক্ষায় বন বিভাগকে অবশ্যই গাছ লাগাতে হবে কিন্তু কোনক্রমেই রেললাইনের দুপাশের ৫০ ফুটের মধ্যে নয়। রেলের জমিতে যেদিক দিয়ে ট্রেন চলাচল করে বন বিভাগকে সেখানেই কেন গাছ লাগাতে হবে। ৫ বছর থেকে শতবর্ষী এসব গাছ কাটতে হবে এ বিষয়ে মহাপরিচালক বলেন, রেললাইন এসব গাছ লাগানোর আগেই নির্মাণ করা হয়েছে। এ রুটটির নির্মাণের বয়স কয়েকশ’ বছর। বিষয়টি দ্রুত সমাধানের জন্য বন বিভাগের কাছে কয়েক দফা চিঠি দেয়া হয়েছে। তাদের সঙ্গে আলোচনা করেই গাছ কাটার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তারা কোন সিদ্ধান্ত না নিলে পরবর্তী সময় কোন দুর্ঘটনা ঘটলে ‘দ্য রেলওয়েজ এ্যাক্ট- ১৮৯০’র ১২৮ ধারা মোতাবেক পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।
×