ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রেজাউল করিম খোকন

প্রাত্যহিক জীবনে সুপারশপ

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২০ জুন ২০১৬

প্রাত্যহিক জীবনে সুপারশপ

সুপারশপ, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ধারণাটা পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে প্রথমে চালু হলেও এখন দুনিয়াজুড়ে বিভিন্ন দেশে মানুষের কেনাকাটার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে তা। খুব সহজে এক দোকানে, একই ছাদের নিচে নিত্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় পণ্য সামগ্রী কেনাকাটার জন্য বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ সুপারশপ, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরকে বেছে নিচ্ছেন অনায়সেই। আমেরিকা, ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বহু আগে থেকেই ক্রেতাসাধারণের প্রাত্যহিক অর্থনৈতিক কর্মকা-ে সুপারশপ, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। ওখানে সুপারশপ, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ছাড়া নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী কেনাকাটার কথা ভাবা যায় না বললেই চলে। প্রাত্যহিক জীবনযাপনে কেনাকাটাকে অনেকটাই সহজ, ঝঞ্চামুক্ত, নিরুপদ্রব, নিরাপদ, ঝুঁকিমুক্ত করেছে সুপারশপ, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ হলেও আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামো ক্রমেই নানা দুর্বলতা কাটিয়ে সবল হচ্ছে। আমাদের অর্থনীতিতে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে, বিভিন্ন সূচকে এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের অবস্থান উজ্জ্বল হচ্ছে। গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক কাঠামোতে চমকপ্রদ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নিত্য নতুন ধারণার উদ্ভব হচ্ছে অর্থনীতিতে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকা শহরসহ বন্দর নগরী চট্টগ্রাম এবং অন্য বড় বড় শহরে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ও সুপারশপের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি অন্যতম। আজকাল নাগরিক জীবন খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। মানুষের লাইফ স্টাইলে অনেক পরিবর্তন এসেছে। যার প্রভাব পড়েছে সবার নানা আচরণে। এভাবে অনেকের ক্রয় আচরণ বদলে গেছে। আজকাল মানুষের রুচি ও পছন্দে আধুনিকতা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী শ্রেণীর জীবনযাপনে পাশ্চাত্যের ছাপ পড়ছে। পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের মতো এখন বাংলাদেশের প্রধান শহরগুলোতে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাসহ বন্দরনগরী চট্টগ্রাম এ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, সুপারশপ, মেগাশপ চালু হয়েছে। এক দোকানে ঢুকে এখন ক্রেতা চাল, ডাল, তেল, লবণ, মরিচ থেকে শুরু করে মাছ, মাংস, ডিম, মুরগি, শাকসবজি, ফলমূল এমনকি কসমেটিকস, পোশাক-আশাক, জামা-কাপড়, ঘরের আসবাবপত্র , ক্রোকারিজ, আইসক্রিম, দুধ, মাখন, হিমায়িত খাদ্যদ্রব্য প্রভৃতি ইচ্ছেমতো কেনাকাটা করতে পারছেন অনায়সেই। সারা বাজার ঘুরে, এ দোকান সে দোকান থেকে যাচাই-বাছাই করে নিজের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করার প্রবণতা আমাদের এখানে অনেক আগে থেকেই লক্ষ্য করা যায়। এখনও অনেকেই সারাবাজার, প্রয়োজনে কয়েকটি বাজার ঘুরে দরদাম এবং পণ্যের গুণাগুণ যাচাই করে নিজের চাহিদা অনুযায়ী কেনাকাটা করেন। তবে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে কেউ কেউ এটাকে ঝামেলাপূর্ণ, সময়সাপেক্ষ, সঠিক মানের পণ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন। কম সময়ে, নিরাপদে, আরামদায়ক পরিবেশে, সঠিক মান ও ওজনের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয়ের জন্য আজকাল অনেকেই নিয়মিত ঢুঁ মারছেন শহরের বিভিন্ন সুপারশপের আউটলেটে। ক্রেতার সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় সাম্প্রতিক কয়েক বছরে নতুন নতুন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, মেগাশপ, সুপারশপ চালু হয়েছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় খুব সহজেই চোখে পড়ছে আগোরা, নন্দন, মীনা বাজার, স্বপ্ন, প্রিন্স বাজার প্রভৃতি সুপারশপ, মেগাশপের আউটলেট। প্রতিটিতেই ক্রেতা সমাগম লক্ষ্য করা যায় সকাল থেকে রাত অবধি। শহরের অভিজাত এলাকাগুলোতে একসময়ে সুপারশপ, মেগাশপ, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ক্রেতাদের চাহিদা ও সংখ্যা বিবেচনা করে নতুন আউটলেট খুলছে বিভিন্ন সুপারশপ, মেগাশপ। শহরের অভিজাত এলাকার সীমা ছাড়িয়ে এখন বিভিন্ন এলাকায় সুপারশপের বিস্তৃৃতি ঘটায় আমাদের অর্থনীতিতে নতুন একটি ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে। এখন ধনাঢ্য অভিজাত, উচ্চবিত্ত শ্রেণীর পাশাপাশি সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নারী-পুরুষ সুপারশপে কেনাকাটা করতে আসছেন। এটা আর বিলাসিতার পর্যায়ে নেই বর্তমানে। নাগরিক জীবনযাপনে প্রয়োজনীয় অনুসঙ্গ হয়ে উঠেছে সুপারশপগুলো। ক্রেতা পণ্য ক্রয় করেন ভোগ বা ব্যবহার করার জন্য। এক ক্রেতা জীবনে কত পণ্য ক্রয় করেন তার কোন হিসেব নেই। ক্রেতা কখনও নিজের জন্য পণ্য ক্রয় করেন আবার কখনও অপরের জন্য। যে কারণেই ক্রেতা পণ্যসামগ্রী ক্রয় করুক না কেন, তা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়। এখানে ক্রেতার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার যেমন সমন্বয় ঘটে ] তেমনটি বাজারজাতকারীও ক্রেতাকে তার পণ্য ক্রয়ে অনুপ্রাণিত করে, প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। ক্রেতা কখনও প্রভাবিত হয়। আবার কখনও হয় না। কারণ ক্রেতার ক্রয় আচরণ একটি জটিল ধারণা। একই ক্রেতা একই পণ্য ক্রয়ের সময় ভিন্ন আচরণ করে। তার এই আচরণের পেছনে আবার নানা ধরনের যুক্তি কাজ করে। আপাতদৃষ্টিতে ক্রেতার ক্রয় সিদ্ধান্তগুলোকে খুব সহজ মনে হলেও সেখানে অনেক চিন্তাভাবনার বিষয় জড়িত রয়েছে। ক্রেতা শুধু পণ্য নিয়ে ভাবে না। বরং একই সঙ্গে তার পারিপার্শ্বিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে বিবেচনা করেই একটি ক্রয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ক্রেতার এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াই ক্রয় আচরণের বহি:প্রকাশ ঘটায়। ক্রয় সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তারকারী উপাদানগুলোই ক্রেতার ক্রয় আচরণকে প্রভাবিত করে। এক ক্রেতা যখন একটি পণ্য ক্রয় করেন তখন তিনি কতগুলো বিষয়কে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেন। তার ভাবনার সঙ্গে যখন বিষয়গুলো মিলে যায় তখনই তিনি ক্রয় সিদ্ধান্তে উপনীত হন। এ বিষয়গুলোর মধ্যে পণ্যের মূল্য ও সহজপ্রাপ্যতা অন্যতম। এমন অনেক ক্রেতাই আছেন যারা পণ্যের মূল্যকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেন। মূল্যের সামান্য তারতম্য তাদের পণ্য থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এ ধরনের অবস্থায় পণ্যমূল্য ক্রেতার আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে। অনেক পণ্য আছে যেগুলো কেনার জন্য ক্রেতা বেশিদূর যেতে রাজি থাকেন না। সাবান, দিয়াশলাই, মোমবাতি, কোল্ড ড্রিংকস বা এ জাতীয় পণ্যগুলো ক্রেতারা সব সময় হাতের নাগালের মধ্য থেকে ক্রয় করতে চায়। এ ধরনের পণ্যগুলো হাতের কাছে না পেলে ক্রেতা বিরক্তি অনুভব করে। তাই সহজপ্রাপ্যতাও ক্রেতাদের ক্রয় আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে। আবার স্ট্যাটাসও ক্রেতার ক্রয় আচরণকে দারুণভাবে প্রভাবিত করতে পারে। অনেক ক্রেতাই আছেন যারা একটি নির্দিষ্ট স্ট্যাটাস বজায় রেখে চলাফেরা করেন। পণ্যটি যদি তার স্ট্যাটাসের সাথে মানানসই না হয় তাহলে সেই পণ্যের প্রতি ক্রেতার কোন আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় না। আজকাল অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেন। কারণ বাজারের বেশিরভাগ মাছেই ফরমালিন দিয়ে তরতাজা করে রাখা হয় বলে ক্রেতাদের মনে ধারণাটি বদ্ধমূল হয়ে যাওয়ায় তারা ফরমালিনমুক্ত মাছ কিনতে এখন সুপারশপমুখী হচ্ছেন। কারণ এখানে ফরমালিনমুক্ত মাছ ও অন্যান্য পণ্য ভেজালমুক্ত হওয়ার ব্যাপারে গ্যারান্টি দেয়া হয়। যার ওপর আস্থা রেখেই এখন ক্রেতা ঝুঁকিমুক্ত কেনাকাটার জন্য সুপারশপে যাচ্ছেন। সুপারশপ, মেগাশপগুলোতে নির্বিঘেœ কম সময়ে রুচিমাফিক মানসম্মত পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে যে চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি করেছে তা আগে ছিল না। ফলে সুপারশপ, মেগাশপ, আধুনিক নাগরিক জীবনে গুরত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ হয়ে উঠেছে। এর ফলে বাজার করাটা ক্লান্তিকর, বিরক্তিকর কাজ বলে বিবেচিত হচ্ছে না সামর্থ্যবান ক্রেতা শ্রেণীর কাছে। পকেট ভর্তি টাকা নিয়েও যেতে হচ্ছে না বাজার করতে। কারণ সুপারশপ, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, মেগাশপগুলোতে ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে সহজেই নিরাপদে কেনাকাটা সারতে পারছেন ক্রেতারা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে, সাজানো গোছানো অবস্থায় রাখা নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী যাচাই-বাছাই করে পছন্দনীয় জিনিসটি কেনাটা বেশ উপভোগ করছেন বেশিরভাগ ক্রেতা। এখানে মাছ-মাংস, মুরগি, দুধ, ডিম থেকে শুরু“ করে টাটকা শাক-সবজি সবই পাওয়া যায়। সরাসরি গ্রামের উৎপাদক কৃষকদের কাছ থেকে সুপারশপগুলো কৃষিজাত পণ্য সংগ্রহ করে বাজারজাত করছে। এক্ষেত্রে পচা, বাসি নিম্নমানের সামগ্রী বিক্রির কোন সুযোগ নেই। গ্রামের বিভিন্ন কৃষি খামার, মৎস্য খামার, পোলট্রি, ডেইরি ফার্মের উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী সরাসরি সুপারশপগুলোতে বিক্রির মাধ্যমে ভোক্তাদের কাছে তরতাজা টাটকা জিনিস পৌঁছানোর যে চমৎকার চেইন সৃষ্টি হয়েছে তা আমাদের গ্রামীণ তথা কৃষি অর্থনীতিতে নবজাগরণের সৃষ্টি করেছে। মধ্যস্বত্ব¡ভোগীদের খপ্পরে পড়ে গ্রামের কৃষক তার উৎপাদিত কৃষি পণ্যের উপযুক্ত মূল্য থেকে বঞ্চিত হন। সুপারশপগুলো সরাসরি গ্রামের কৃষক, মৎস্য খামারি, পোলট্রি ফার্মের মালিকদের কাছ থেকে পণ্য সামগ্রী কিনে এনে বিক্রি করায় কৃষকদের অনেকেই উপযুক্ত মূল্য প্রাপ্তির আশায় সেখানে তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য সরবরাহে বিশেষভাবে উৎসাহী হচ্ছেন। এর মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে শহুরে অর্থনৈতিক কাঠামোর চমৎকার মেলবন্ধন গড়ে উঠেছে। সাধারণত কৃষিজ পচনশীল পণ্য যেমন মাছ, শাকসবজি, দুধ, ফলমূল প্রভৃতি সংরক্ষণ সুবিধার অভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর। সুপারশপ, মেগাশপগুলো গ্রামীণ জনপদ এবং সরাসরি উৎপাদন উৎস থেকে এসব পণ্য সামগ্রী বাজারজাতকরণের জন্য সংগ্রহের পর নিজস্ব উদ্যোগে উপযুক্ত পরিবেশে এসব সংরক্ষণ করে থাকে। ফলে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়পক্ষই লাভবান হচ্ছেন এর মাধ্যমে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর চমৎকার অনুকূল প্রভাব পড়তে শুরু“ করেছে। সাধারণ বাজারের দোকান থেকে আজকাল বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী কিনে ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হওয়ায় ক্রেতারা অপেক্ষাকৃত নিরাপদে ঝুঁকিমুক্তভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয়ের ক্ষেত্রে সুপারশপ, মেগাশপগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। কারণ এক্ষেত্রে ভেজাল, নিম্নমানের, মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য কিনে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা অনেক কম। এখন নাগরিক জীবনে সময়ের মূল্য অনেক বেশি। সবাই সময়ের উপযুক্ত ব্যবহারে সচেষ্ট। সুপারশপে বাজার করতে ক্রেতাদের খুব বেশি সময় লাগেনা, এর ফলে শহরের কর্মব্যস্ত জীবনে কেনাকাটা অনেক সময় সাশ্রয়ী হয়েছে। আজকাল পুরুষদের চেয়ে এখানে কেনাকাটা করতে নারীদের ভিড় বেশি লক্ষ্য করা যায়। লেখক : ব্যাংকার, কলামিস্ট
×