ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ওরা জানেনা মে দিবসের মর্মবানী

প্রকাশিত: ২১:২৪, ১ মে ২০১৬

ওরা জানেনা মে দিবসের মর্মবানী

তাহমিন হক ববী, নীলফামারী॥ চীনের সাংহাই বা ধুলাবাড়ি হিসাবে এখন আখ্যায়িত হয়েছে বাংলাদেশের অষ্টম ব্যবসা বানিজ্য শহর নীলফামারীর সৈয়দপুর। এখানে ঘরে ঘরে মিনি কারখানা। সেসব কারখানার ঠকঠক, টুং টাং শব্দ চলে কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে এই শব্দ। ট্রাঙ্ক, বালতি, মোমবাতি, আগরবাতি, শোকেস, ফাইল কেবিনেট, সাবান, গুল, জর্দা, প্লাষ্টিকের কৌটা,বাইসাইকেল,রিক্সা, ভটভটি তৈরী করছে তারা। সবই হয় এখানে। খাদ্য তালিকায় বিস্কুট, চানাচুর, চকলেট,চিপস, পাঁপর তৈরি হচ্ছে। রেডিমেড ফার্নিচার, ফাউন্ড্রি কারখানাও রয়েছে। বেনারসী শাড়ি তৈরি, পোশাকে কারচুপি, চুমকি ও পাথর বসানোর কাজ চলে। আছে তৈরি পোষাকের ছোট ছোট কারখানাও। লেদ মেশিনে এমন সব ডাইস তৈরি হচ্ছে যা দেশের অন্য স্থানে করা সম্ভব নয়। এখানকার উৎপাদিত পণ্যের গুণগতমান অন্যান্য স্থানের চেয়ে অনেক ভাল বলে সুনাম রয়েছে। এ কারণে সৈয়দপুরকে অনেকে চীনের সাংহাই বা ধুলাবাড়ির সঙ্গে তুলনা করেন। সৈয়দপুরের অলিগলি, পাড়া-মহল্লায় ছড়িয়ে রয়েছে এসব কারখানা। এতে দিনে-রাতে কাজ করছেন হাজার হাজার শ্রমিক। এদের সাথে রয়েছে আবার ১০ হাজার শিশু শ্রমিক! এখানে তৈরি ট্রাঙ্ক উন্নতমানের হওয়ায় সেনাবাহিনীর জোয়ানরা শান্তি মিশনে যোগ দিতে যাওয়ার সময় বিদেশের মাটিতে নিয়ে যাচ্ছেন বলেও দাবি এর কারিগরদের। সৈয়দপুর শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই ভাল। বেকার যুবক যুবতীরা খারাপ কোন কাজে না থেকে সকলে এসব কাজে দিনরাত পরিশ্রম করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের চেস্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অনেকে হয়েছে স্বাবলম্বী। কিন্তু মজার বিষয় এসব শ্রমিকরা জানেনা আজ রবিবার মে দিবস পালনের মর্মবানী। কারন একটাই কাজ না করলে মজুরী মেলেনা। বসে থাকলে আয় হবেনা। মে দিবসে মালিকরা কাজ না করলে মজুরী দেবেনা। তাহলে মে দিবস কেন? এমন প্রশ্ন এসব শ্রমিকদের। তাই মে দিবসের মিছিল বা রং খেলার চেয়ে কাজ করে মজুরী বুজিয়ে নেয়া এর চেয়ে ঢের ভাল। সৈয়দপুর শহরের মিস্ত্রি পাড়ার একটি বালতি ফ্যাক্টরিতে কাজ করে আসিফ। তার বাড়ি উপজেলার বোতলাগাড়ী ইউনিয়নে। পিতা ইটভাঁটিতে কাজ করেন। আসিফকে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। বিনিময়ে তাকে প্রতিদিন তিনবেলা খাবার এবং সপ্তাহে মজুরি দেয়া হয় ৮৪ টাকা। এই বালতি ফ্যাক্টরির পাশের একটি বাক্স তৈরি কারখানায় কাজ করে গুড্ডু। সারাদিন কাজ করে তিনবেলা খাওয়ার পর তাকে দৈনিক ১০ টাকা মজুরি দেয়া হয়। সৈয়দপুর শহরের রেলওয়ে বাজারের বিভিন্ন হোটেলে কাজ করে মজিদ, হাবিব, জয়নাল, কাশেম ও মিঠু। এদের গড় বয়স ১২ থেকে ১৪ বছর। এরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে মজুরি পায় ৩০ থেকে ৪০ টাকা। এই টাকা তাদের বাবা-মায়েরসংসারে ব্যয় হয়। এদের মধ্যে কারও বাবা, আবার কারও মা নেই। ফলে বাঁচার অবলম্বন হিসেবে এই শিশুরাই হাল ধরেছে সংসারের। এই শহরের নিয়াতমপুরে হালকা প্রকৌশল শিল্পে কাজ করে আরমান। ভোর থেকে রাত অবধি সে লোহা লক্করের কাজ করে। অথচ কাজ শেষে তার মজুরি মেলে মাত্র ৩০ টাকা। বাঁশবাড়ি এলাকার একটি গুল ফ্যাক্টরীতে কাজ করে ওয়াসিম। সকালে মায়ের সঙ্গে সে গুল ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে আসে। এখানে সে ডিব্বায় গুল ভরা ও লেবেল লাগানোর কাজ করে। কাজ শেষে তার মায়ের হাতে ৬০ টাকা দেয়া হয়। এ কাজে গুলের গুঁড়া নাকে চোখে লেগে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। কষ্ট হলেও সহ্য করেই তাকে কাজ করতে হয়। তামাক কারখানায় কর্মরত শ্রমিকরা জানে না তাদের ভবিষ্যৎ কী? প্রতিদিন যে তারা একটু একটু করে মৃত্যুর মুখে ধাবিত হচ্ছে তাদের ন্যূনতম ধারণা। একই অবস্থা অন্য গুল ফ্যাক্টরিগুলোতেও। সৈয়দপুর শহরে ছোট-বড় মিলে ৫০টির বেশি গুল ফ্যাক্টরি রয়েছে। তবে বড় গুল ফ্যাক্টরি রয়েছে ৫টি। এগুলো হলো- তারেক, খালেদ, শাকিব, ওয়ান স্টার ও নিউ স্টার গুল ফ্যাক্টরি। কিন্তু শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নে মালিকদের নেই কোনো চিন্ত-ভাবনা বা পরিকল্পনা। অল্প আয়ের মানুষ বসবাস করে এমন আবাসিক এলাকায় গুল ফ্যাক্টরিগুলো গড়ে তোলা হয়েছে। বেসরকারী জরিপে জানা যায়, সৈয়দপুরে বিভিন্ন মিল, শিল্প, কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে জড়িত শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ১০ হাজার। তবে অভাব-অনটনে এর সংখ্যা প্রতিবছর ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে, বহু নারী-পুরুষ ও শিশু শ্রমিক চুক্তিভিত্তিতে বা দৈনিক হাজিরায় কাজ করছে। ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টিও একটি বড় অগ্রগতি। ঝুট কাপড়ে তৈরি পোষাকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গার্মেন্টস কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব পোশাক এখন যাচ্ছে ভারত, নেপাল ও ভুটানে। শহরের বাঁশবাড়ি, সাহেবপাড়া, উত্তরা আবাসন, নতুন বাবুপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া, মুন্সিপাড়া, পুরাতন বাবুপাড়া, হাওয়ালপাড়া, গোলাহাট, ঘোড়াঘাট, এলাকায় গড়ে ওঠা এসব কারখানা। শহরের গোলাহাট, নতুন বাবুপাড়াসহ বিভিন্ন অলগলিতে ৫০টির বেশি আগরবাতি ও মোমবাতির কারখানা রয়েছে। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোররা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে এসব কাজ করছেন। হাতে ও মেশিনে আগরবাতিতে মসলা লাগিয়ে রোদে শুকিয়ে দেওয়া হয় সৈয়দপুর থেকে। এরপর বড় বড় নামি-দামি কোম্পানিগুলো এসব আগরবাতি পছন্দমত সুগন্ধি ব্যবহার করে বাজারজাত করে।
×