এম শাহজাহান ॥ শ্রমিকদের জন্য শতভাগ নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরিতে দেশে ‘গ্রিন গার্মেন্টস’ পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের কার্যক্রম জোরেশোরে শুরু হয়েছে। পরিবেশবান্ধব করা হচ্ছে পোশাক কারখানা। রূপকল্প-২১ অনুযায়ী আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে পোশাক খাতের প্রায় সব কারখানাকে গ্রিন গার্মেন্টসে রূপান্তর করার উদ্যোগ রয়েছে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের যে বির্তক রয়েছে, সেটির অবসান হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, বিশ্ব রফতানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকার পরও শুধু নিরাপদ কর্মপরিবেশ ইস্যুতে পোশাক শিল্প খাত নেতিবাচক ভাবমূর্তির মধ্য থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়নি। বিশেষ করে রানা প্লাজা ধস এবং তাজরিন ফ্যাশনে ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনায় প্রায় সহস্রাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর পর চরম ভাবমূর্তি সঙ্কটের মধ্যে পড়ে বাংলাদেশ। পণ্য রফতানিতে যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি বা শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা বাতিল করে দেয়। এছাড়া ক্রেতারা এ দেশ থেকে অর্ডার বাতিল করে পণ্য না নেয়ার হুমকি দিতে থাকে। পাশাপাশি শ্রম অধিকার বাস্তবায়ন এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরিতে চাপ দিতে থাকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। পুরো বিষয়টির দিকে নজর রাখে ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রেতা জোট এ্যাকর্ড এবং এ্যালায়েন্স। একই সঙ্গে শ্রম অধিকার রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দফতর ইউএসটিআর বাংলাদেশ এ্যাকশন প্ল্যান নামে ১৬টি শর্ত জুড়ে দেয়। শ্রম অধিকার নিশ্চিতে এই ১৬টি শর্ত পূরণ করতে সামর্থ্য হয়েছে বাংলাদেশ। যদিও যুক্তরাষ্ট্র আরও অগ্রগতির কথা বলে এখনও জিএসপি সুবিধার বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখেছে।
তারপরও থেমে নেই উদ্যোক্তারা। ইতোমধ্যে পোশাক শিল্পের ভবিষ্যত চিন্তা করে মুন্সীগঞ্জের বাউশিয়ায় গার্মেন্টস পল্লী তৈরি করছে সরকার। দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলোতেও গার্মেন্টস শিল্প সরিয়ে নিতে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। আর ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, ময়মনসিংহসহ অন্যান্য এলাকায় অবস্থিত কারখানাগুলোকে গ্রিন গার্মেন্টসে রূপান্তরের কাজ শুরু হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি ফেরদৌস পারভেজ বিভন জনকণ্ঠকে বলেন, নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং পরিবেশবান্ধব কারখানা গড়ে তুলতে দেশে গ্রিন গার্মেন্টস করার পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে চলছে। রূপকল্প-২১ বাস্তবায়নে ২০২১ সালের মধ্যে এ শিল্পের রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ বিলিয়ন ডলার। এটি অর্জন করতে হলে গ্রিন গার্মেন্টস করতেই হবে। তিনি বলেন, পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা এখন গ্রিন গার্মেন্টস করছেন। এজন্য তাদের নতুন করে বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। শ্রম অধিকার রক্ষা এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরিতে বিদেশী ক্রেতাগোষ্ঠীর চাপ রয়েছে। এছাড়া রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর এখন সরকারীভাবেও এটা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া হয়েছে। তাই ব্যবসা করতে হলে গ্রিন গার্মেন্টস করতেই হবে।
গ্রিন গার্মেন্টস কেন প্রয়োজন ॥ শুধু নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও পরিবেশবান্ধব কারখানা তৈরিই নয়, উন্নতমানের পণ্য তৈরিতেও গ্রিন গার্মেন্টসের প্রয়োজন রয়েছে। এসব কারখানা পরিবেশ রক্ষায় নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকে। কারখানায় এমনভাবে সৌরবিদ্যুত ব্যবহার করা হয়, যাতে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত কম বিদ্যুত ব্যবহার করতে হয়। সূর্যের আলো ব্যবহারের মাধ্যমে দিনে কারখানার বেশিরভাগ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়ে থাকে। বিশ্বমানের বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) থাকতে হবে কারখানাটিতে। এছাড়া ইটিপিতে পরিশোধিত পানি পুনরায় ব্যবহার করা যায়। শ্রমিকদের চলাচলের জন্য থাকতে হবে প্রশস্ত করিডর। একসঙ্গে ৮শ’ থেকে এক হাজার শ্রমিকের খাওয়ার জন্যও জায়গা থাকতে হবে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখার মতো ব্যবস্থাও থাকে এসব কারখানায়। অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়াতে গার্মেন্টসের পাশে খালি জায়গায় বনায়ন কর্মসূচী গ্রহণ, অগ্নি নিরাপত্তায় পর্যাপ্ত সরঞ্জামাদি ও পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হয় গ্রিন গার্মেন্টসে।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত দেড় শ’ থেকে ২শ’ কারখানা গ্রিন গার্মেন্টসে রূপান্তর করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এবিএ গ্রুপ, ভিয়েলাটেক্স, ডিবিএল ও এনভয় গ্রুপ তাদের ক্ষতিকারক নির্গমন কমিয়ে, বিদ্যুত ব্যবহারে দক্ষতা বাড়িয়ে, উপজাত পদার্থ পুনর্ব্যবহার করে, পানির ব্যবহার কমিয়ে ও সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে গ্রিন গার্মেন্টস গড়ে তোলার মর্যাদা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া এখন আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা অনুযায়ী এ ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নিচ্ছেন অন্য উদ্যোক্তারাও। গ্রিন গার্মেন্টস খাত গড়ে তুলতে বড় আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোও যারা বাংলাদেশ থেকে পণ্য কেনে, তারাও বাংলাদেশের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে এ্যাডিডাস, বেনেটন, বারবেরি, সিএ্যান্ডএ, এসপ্রিট, জি-স্টার, গ্যাপ, এইচএ্যান্ডএম, জ্যাক ওলফস্কিন, লিভাই স্টস, এল ব্র্যান্ডস, লি নিং, এমএ্যান্ডএস, নিউ ব্যালেন্স এ্যাথলেটিক সু, নাইকি, পুমা এবং পিভিএইচ অন্যতম। এসব প্রতিষ্ঠান আগামী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের গার্মেন্টস এবং পাদুকা শিল্পকারখানাগুলকে ক্ষতিকারক রাসায়নিকমুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
এদিকে, গ্রিন গার্মেন্টস খাত গড়ে তোলার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে বিনিয়োগ করার প্রস্তাব দিয়েছে কানাডা। কানাডার বিনিয়োগ আসার পর দেশে গার্মেন্টস শিল্পে বড় ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।