ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

জ্বালানি তেলের দাম কমলেও পরিবহন ভাড়া কমে না

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২৬ এপ্রিল ২০১৬

জ্বালানি তেলের দাম কমলেও পরিবহন ভাড়া কমে না

রাজন ভট্টাচার্য ॥ গত দুই যুগে তিনবারের বেশি জ্বালানি তেলের দাম কমলেও পরিবহন ভাড়া কমেনি। তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাড়া বেড়েছে অন্তত পাঁচবার। কোন কোন ক্ষেত্রে সরকার ভাড়া কমানোর সিদ্ধান্ত নিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। যাত্রীদের পকেট থেকে গেছে বাড়তি অর্থ। এবারও কমেছে জ্বালানি তেলের দাম। সরকারী ঘোষণা অনুযায়ী আরও দু’দফা তেলের দাম কমানোর কথা রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে গণপরিবহনের ভাড়া কমানোর দাবি উঠেছে সব মহল থেকেই। পরিবহন মালিকরা এ ব্যাপারে খুব একটা আন্তরিক নন। তবে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ভাড়া কমানোর বিষয়ে একমত। এদিকে হ্রাসকৃত জ্বালানি তেলের মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে গণপরিবহনের ভাড়া কমানোর দাবি জানিয়েছে ‘বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি’। সব মিলিয়ে প্রশ্ন ওঠেছেÑ তেলের দাম কমার পর গণপরিবহনে ভাড়া কমবে তো? ২৬ বছরে ভাড়া বেড়েছে পাঁচগুণ ॥ পরিসংখ্যান বলছে, গেল ২৬ বছরে বাস ও মিনিবাসের ভাড়া বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ। মূলত ডিজেলের দাম বাড়ানোর কারণেই বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এ সময়ে ডিজেলের দামও বেড়েছে চারগুণ। ১৯৯০ সালে ডিজেলের দাম ছিল প্রতি লিটার ১৭ টাকা। ওই সময় বাসভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ছিল ৩২ পয়সা। এখন ডিজেলের দাম প্রতি লিটার ৬৫ টাকার বেশি। আর বাসভাড়া হয়েছে ১ টাকা ৪৫ পয়সা। বর্তমানে দেশের ৬০ ভাগ যানবাহন ডিজেল ও অকটেনে চালিত। এই হিসাবে দ্রুত সময়ে গণপরিবহনে ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করার দাবি সব মহলের। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অনেক বেশি আদায় করা হচ্ছে যাত্রীদের কাছ থেকে। এছাড়া পাঁচ টাকা জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলে ১০ টাকা ভাড়া বাড়ানো হয়। আর পাঁচ টাকা তেলের দাম কমানো হলে ভাড়া কমে দুই টাকা। গেল ২৬ বছরে যতবার ভাড়া কমানো হয়েছে এর একবারও যাত্রীরা সুফল পাননি। প্রকৃত অর্থে ভাড়া কমানোর বিষয়টি ছিল কাগজে-কলমে। এতে লাভবান হয়েছে পরিবহন মালিকরাই। নীরবে পকেট কাটা গেছে যাত্রীদের। তাছাড়া ভাড়া কমানোর পর তা কার্যকর করতে কখনই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় আন্তরিক ভূমিকা পালন করেনি। ডিজেলের মূল্য লিটারপ্রতি ২০ টাকা হওয়ার পর ২০০৩ সালের ৯ মার্চ প্রতি কিলোমিটার বাসভাড়া বেড়ে দাঁড়ায় ৭২ পয়সা। ডিজেলের মূল্য লিটারপ্রতি ২৬ টাকা হওয়ার পর ২০০৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর বাসভাড়া বাড়িয়ে প্রতি কিলোমিটার ৮০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। ২০০৮ সালে জুলাই মাসে জ্বালানি তেলের লিটারপ্রতি দাম হয় ৫৫ টাকা। তখন ফেরি ভাড়া বাদে কিলোমিটারপ্রতি বাসভাড়া হয় এক টাকা পাঁচ পয়সা। একই বছরে তেলের দাম কমে লিটারপ্রতি হয় ৪৮ টাকা। তখন কোন ব্যয় বিশ্লেষণ না করেই লিটারপ্রতি সাত টাকা তেলের দাম কম হওয়ায় কিলোমিটার প্রতি সাত পয়সা ভাড়া কমানো হয়, যা যথাযথ কার্যকর হয়নি। ২০০৯ সালে জ্বালানি তেলের দাম আরেক দফা কমে লিটারপ্রতি দাঁড়ায় ৪৪ টাকা। তখন চার পয়সা ভাড়া কমানো হয়। ২০১১ সালে লিটারপ্রতি তেলের দাম ৪৬ টাকা হওয়ায় প্রতি কিলোমিটারে বাসভাড়া এক টাকা ১৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। একই বছরে আরেক দফা বাড়ে তেলের দাম। ২০১২ সালে ফের তেলের দাম বেড়ে লিটারপ্রতি হয় ৬১ টাকা। তখন কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া হয় এক টাকা ৩৫ পয়সা। এরপর ২০১৩ সালে তেলের দাম বৃদ্ধির পর আন্তঃজেলায় কিলোমিটারপ্রতি বাসভাড়া এক টাকা ৪৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেছেন, তেলের দাম কমলেও অন্য সবকিছুর দাম অনেক বেড়েছে। তাই দাম কমলে ভাড়া কমবেÑ সেটা বলা যাচ্ছে না। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ২৪টি বিষয়ের ওপর আলোচনা করে ভাড়া কমানো ও বাড়ানোর বিষয়টি নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে জ্বালনি তেলের সংশ্লিষ্টতাই বেশি। কারণ বাস চালানোর জন্য তেল খাতেই সবচেয়ে বেশি ব্যয়। এখন তেলের দাম কমলেও বাকি ২৩টি বিষয় আগের মতোই। অর্থাৎ বাড়তি। সেই সঙ্গে স্টাফদের বেতনও বেড়েছে। তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী সবকিছুর সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতিবছর দূরপাল্লার বাসভাড়া নির্ধারণের কথা আছে। কিন্তু তা হচ্ছে না। আমরা চিন্তা করেছিলাম মালিক সমিতির পক্ষ থেকে ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠাব। এখন তেলের দাম কমায় তা এখন হচ্ছে না। তেলের দাম কমানোর কারণে মালিকরা আশাকরি অন্যান্য ব্যয় পুষিয়ে নিতে পারবেন। তিনি বলেন, এখন আলোচনা করে ভাড়া কমানো বাড়ানোর বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেব। তবে ট্রাকের ভাড়া কমবে কিনাÑ এ বিষয়টি আমাদের এখতিয়ারভুক্ত নয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি। পরিবহন সেক্টর নিয়ে কাজ করছে এরকম বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণা বলছে, ডিজেল বাসের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ জ্বালানির চাহিদা রয়েছে, তার শতকরা ৪৫ ভাগই পরিবহন খাতের। বিআরটিএ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বাসভাড়া প্রতি কিলোমিটারের জন্য ৩২ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। ওই সময় ডিজেলের দাম ছিল প্রতি লিটার ১৭ টাকা। তেলের দাম বাড়ার কারণে এরপর ৯ বার বাসভাড়া বাড়িয়ে ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি সর্বশেষ প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ১ টাকা ৪৫ পয়সা করা হয়। এ সময় তেলের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৬৫ টাকায়। ভাড়া কমানোর দাবি যাত্রী কল্যাণ সমিতির ॥ গণপরিবহনে ভাড়া কমানোর দাবি জানিয়ে গণমাধ্যমে পাঠানো প্রেরিত এক বিবৃৃতিতে সংগঠনের চেয়ারম্যান শরীফ রফিক-উজ-জামান ও মহাসচিব মোঃ মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গণপরিবহনগুলো যাত্রী সাধারণের কাছ থেকে বর্ধিত ভাড়া আদায় করে থাকে। তবে রবিবার রাতে জ্বালানি তেলের মূল্য কমানো হলেও দেশের কোন গণপরিবহনে ভাড়া ১ পয়সাও কমানো হয়নি। সংগঠনের পক্ষ থেকে গণপরিবহনের ভাড়া কমানোর জন্য জরুরীভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি জোর দাবি জানানো হয়। হানিফ পরিবহনের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন বলেন, জ্বালানির দাম কমেছে কি-না বিষয়টি আমার জানা নেই। আর পরিবহন ভাড়া কমানো হবে কি-না এ সম্পর্কে এখন কিছুই বলতে পারছি না। তাছাড়া পরিবহন ভাড়া তো শুধু তেলের ওপর নির্ভর করে না। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন (বিআরটিসি) চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, সরকার যদি ভাড়া কমানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে বিআরটিসির ভাড়া কমানো হবে। তাছাড়া সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও কম ভাড়া নেয় বিআরটিসি বাসগুলো।
×