ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

ছায়ানটের উৎসব এবার ৪৯ বছরে পা দেবে ;###;মঙ্গল শোভাযাত্রার মর্মবাণী ‘অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে’

সূর্যোদয়ের অপেক্ষা ॥ প্রভাতী, মঙ্গল শোভা যাত্রাসহ নানান আয়োজন সম্পন্ন

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৩ এপ্রিল ২০১৬

সূর্যোদয়ের অপেক্ষা ॥ প্রভাতী, মঙ্গল শোভা যাত্রাসহ নানান আয়োজন সম্পন্ন

মনোয়ার হোসেন ॥ এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ...। আসছে বৈশাখ। অসাম্প্রদায়িক বাঙালীর সবচেয়ে বড় উৎসব উদযাপনে প্রস্তুত গোটা দেশ। প্রাণে প্রাণে বইছে আনন্দ-উচ্ছ্বাস। এবারও বর্ণাঢ্য আয়োজন থাকবে রাজধানী শহরজুড়ে। বাঙালিত্বের গৌরব নিয়ে সামনে আসবে ছেলে-বুড়ো সকলে। উৎসবের আগেই উৎসবের বর্ণিল আবহটা অনুভব করা যাচ্ছে। ঢাকার প্রায় প্রতিটি অলিগলিতে উদযাপিত হবে পহেলা বৈশাখ। বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে প্রস্তুত হয়েছে পাড়ার তরুণরা। হিন্দু-মুসলমানের ব্যাপার নেই, সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাঙালী হয়েছে। বর্ষবরণ উৎসব আরও বর্ণাঢ্য আরও শিকড়ের করতে কাজ করছে দিনরাত। ঘরে ঘরেও চলছে প্রস্তুতি। যে যার মতো করে ঘর সাজাচ্ছেন। পোশাক কিনছেন। সবই বাঙালিয়ানাকে প্রাধান্য দিয়ে। জাতীয় আয়োজনগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে দৃশ্যমান চারুকলা অনুষদের প্রস্তুতি। লিচুতলার সবুজ চত্বরে মঙ্গল শোভাযাত্রার নানা অনুষঙ্গ। হাতি-ঘোড়া, ময়ূরপঙ্খী নাওসহ নান্দনিক সব শিল্প কাঠামো ইতোমধ্যে পূর্ণাঙ্গ রূপ পেয়েছে। এখন চলছে বাকি কাজ। অন্যদিকে রমনা বটমূলে বর্ষবরণের প্রভাতী অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে ছায়ানট। সে লক্ষ্যে ধানম-ির ছায়ানট ভবনে চলছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মহড়া। আজ বুধবার বিকেল ৪টায় মূল অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে চূড়ান্ত মহড়া। নববর্ষে শহরবাসীর নতুন পোশাকের চাহিদা মেটানোর দৃশ্য নজরে পড়েছে শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেট থেকে শুরু করে বসুন্ধরা শপিংমলসহ দেশীয় ফ্যাশন হাউসনির্ভর মার্কেটগুলোয়। মঙ্গলবারও এসব বিপণিবিতানে ছিল উৎসব উদযাপনে নতুন পোশাক সন্ধানীদের তুমুল ভিড়। এর বাইরে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা প্রস্তুত হচ্ছেন চিরায়ত হালখাতার হিসাব হালনাগাদের তৎপরতায়। এসব দৃশ্যের বাইরে ধাবমান রাজধানীতে চলছে বিভিন্ন সংগঠনের নববর্ষকে স্বাগত জানানোর নানামুখী প্রস্তুতি। সেই সুবাদে এখন রংময় হয়ে উঠেছে রাজধানীর শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গন। এছাড়া বর্ষবরণে ভুভুজেলার মতো উৎকট শব্দ উৎপাদনকারী যন্ত্র নিষিদ্ধ ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে সবাই। তবে সার্বিক নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিধিনিষেধ কিছুটা হলেও নিরাশ করেছে নববর্ষ উদযাপনকারীদের। কারণ বিকেল পাঁচটার পর উন্মুক্ত স্থানে নববর্ষের অনুষ্ঠান আয়োজনে আরোপ করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার রমনা পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিকেল ৪টার পর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। বিধিনিষেধ থাকলেও ধানম-ির রবীন্দ্র সরোবর কিংবা কলাবাগান মাঠে নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকায় এসব জায়গায় সন্ধ্যার কিছু সময় পর্যন্ত অনুষ্ঠান হবে। মিলনায়তনের ক্ষেত্রে থাকবে না কোন ধরনের বাধ্যবাধকতা। এছাড়া যে কোন ধরনের বৈশাখী মেলা সন্ধ্যার পরও চলবে। ছায়ানটের প্রভাতী বর্ষবরণ ॥ রাজধানীতে নববর্ষ উদযাপনের আনন্দযজ্ঞে প্রথমেই আসে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের কথা। পাকিস্তান আমলে ১৯৬৭ সালে প্রথম ঢাকায় সাংগঠনিকভাবে বাংলা নববর্ষ বরণ করেছিল সংগঠনটি। মহান মুক্তিযুদ্ধের কারণে ১৯৭১ সাল বাদে প্রতিবছর হয়ে আসা অনুষ্ঠানটি এবার পদার্পণ করেছে ৪৯ বছরে। এ বছর মানবতাকে বিষয় ধরে ১৪২৩ বঙ্গাব্দকে স্বাগত জানাবে ছায়ানট। গানে গানে উচ্চারিত হবে মানবতা ও শান্তির বাণী। হিংসা-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে গান-কবিতায় জানানো হবে প্রতিবাদ। অশুভকে দূরে ঠেলে বলা হবে কল্যাণের কথা। বরাবরের মতো সকাল সোয়া ৬টায় শুরু হবে অনুষ্ঠান। ভোরের রাগ আলাপ দিয়ে আবাহন করা হবে নববর্ষকে। যুগল কণ্ঠে গাইবেন সুস্মিতা দেবনাথ শুচি ও অভিজিৎ কু-ু। পুরো আয়োজনে থাকবে একক ও সম্মেলক সঙ্গীত, কবিতা আবৃত্তি ও পাঠ। সম্মেলক কণ্ঠে প্রথমে প্রভাতী গান ও পরে গাওয়া হবে মানবতার গান। গীত হবে রবীন্দ্র, নজরুল ও লালনসহ বাংলার বরেণ্য গীতিকবিদের গান। সম্মেলক কণ্ঠে পরিবেশিত রবীন্দ্র ও নজরুল সঙ্গীতের মধ্যে থাকবেÑ আমি ভয় করবো না, দুর্গম গিরি কান্তর মরু, আমি মারের সাগর পাড়ি দেব, ওই মহামানব আসে, আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে, বলো ভাই মাভৈ মাভৈ, টলমল পদভরে, আমরা তো উজ্জ্বল সূর্য, বাংলা ভূমির প্রেমে আমার প্রাণ হইল পাগল, বাংলা মার দুর্নিবার আমরা তরুণ দল প্রভৃতি। গাওয়া হবে মানবতার বার্তাবহ লালন সাঁইজির গান। পরিবেশিত হবেÑ সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে ও মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি শিরোনামের সঙ্গীত। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনার মাধ্যমে শেষ হবে এই প্রভাতী সঙ্গীতানুষ্ঠান। তার আগে শুভেচ্ছা কথনে অংশ নেবেন ছায়ানট সভাপতি ড. সন্্জীদা খাতুন। পুরো অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করবে বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতার। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা ॥ মানবতার মর্মবাণী ধারণ করে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার সেøাগান হচ্ছেÑ ‘অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে’। ছায়ানটের প্রভাতী গানের আসর শেষে নববর্ষে রাজধানীতে রং ছড়াবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা। মঙ্গলবার অনুষদ ঘুরে সরেজমিন দেখা যায়, শোভাযাত্রার কাঠামোর উপরিভাগের কাজ শেষ হয়েছে। নানা রকমের কাগজজুড়ে বের করা হয়েছে পূর্ণ অবয়ব। এখন চলছে রং ঢেলে বিষয় ফুটিয়ে তোলার তৎপরতা। চারুশিক্ষকদের নির্দেশনায় চারুশিক্ষার্থীরা রাতদিন কাজ করে যাচ্ছেন শোভাযাত্রার চূড়ান্ত রূপ দিতে। সাম্প্রতিক সময়ের বিবেচনায় শোভাযাত্রার শিল্প কাঠামোর ভাবনায় প্রধান বিষয় হয়েছে মা ও শিশুর মমতাময় সম্পর্ক। ক্রমবর্ধমান অবক্ষয়ের কারণে সামাজিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে মা ও সন্তানের মধুর সম্পর্কের বিষয়টি পেয়েছে শোভাযাত্রার মূল অনুষঙ্গের মর্যাদা। এ বছরের শোভাযাত্রায় সব মিলিয়ে থাকবে ৯টি শিল্প কাঠামো। সাম্প্রতিক শিশু নির্যাতনের প্রতিবাদী প্রকাশে টেপা পুতুলের আকৃতিতে গড়া হচ্ছে মা ও শিশুর কাঠামোটি। সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে থাকবে বিশাল আকৃতির হাতি। থাকবে সুদৃশ্য ময়ূরপঙ্খী নাও। নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি বিবেচিত হবে সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে। দুর্নীতি ও জঙ্গীবাদ রুখে দাঁড়ানোর প্রতীক হিসেবে থাকছে একরোখা ষাঁড়। এছাড়াও পরিবেশ সচেতনতাসহ নানা বিষয়কে ধারণ করে শোভাযাত্রার জন্য নির্মিত হচ্ছে গাছ ও পাখি এবং গরুর শিল্প কাঠামো। নববর্ষ উদযাপনে পোশাকের কেনাকাটা ॥ নববর্ষ উদযাপনে নানা আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে নগরজীবনে যুক্ত হয়েছে নতুন পোশাক। সেই সুবাদে নববর্ষ উদযাপনে এখন সরগরম বিভিন্ন মার্কেট ও শপিংমলের দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো। লাল-সাদার সঙ্গে বিচিত্র রংয়ে তৈরি হয়েছে নারী-শিশু ও পুরুষের বিভিন্ন নক্সার পোশাক। নারীর শাড়ি থেকে শুরু করে থ্রি-পিস, টু-পিস, পুরুষের পাঞ্জাবি, ফতুয়া কিংবা শিশুদের স্কার্ট, টপস বা পাঞ্জাবিতে বর্ণিলতার সঙ্গে ভর করেছে লোকজ নানা অনুষঙ্গ। মুসলমানদের ঈদ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজার বাইরে আমাদের বিক্রির একটি বড় উৎস হচ্ছে বাংলা নববর্ষ। সার্বজনীন এই উৎসবকে ঘিরে ক্রেতার কথা বিবেচনায় প্রতিটি ফ্যাশন হাউসই আলাদা করে পোশাক তৈরি করেছে। হাজারও কণ্ঠে বর্ষবরণ ॥ বিগত বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও নববর্ষে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হবে ‘সানসিল্ক হাজারও কণ্ঠে কোটি বাঙালীর বর্ষবরণÑ১৪২৩’। ভোর সাড়ে ৫টায় শুরু হবে অনুষ্ঠান। পহেলা বৈশাখের প্রথম প্রহরে এক হাজার শিল্পীর কণ্ঠে বর্ষবরণের গান পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু হবে মূল অনুষ্ঠানের কার্যক্রম। গোটা আয়োজন তত্ত্বাবধান করবেন জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। অনুষ্ঠানে সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশন করবেন দেশের গুণী ও বরেণ্য শিল্পীরা। পরিবেশনার পাশাপাশি অনুষ্ঠানস্থলে থাকবে বৈশাখী মেলার আয়োজন। পিঠা-পুলি, মাটির তৈরি তৈজস, বেত, কাঁথা, পিতল, পাটজাত পণ্যসহ রকমারি ও ঐতিহ্যসমৃদ্ধ নানা অনুষঙ্গে সুসজ্জিত থাকবে মেলার স্টলগুলো। চ্যানেল আই ও সুরের ধারার যৌথ এ আয়োজনে এবারের উৎসবের পৃষ্ঠপোষক হয়েছে ইউনিলিভারের ব্র্যান্ড সানসিল্ক। অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করবে চ্যানেল আই। এছাড়া একই স্থানে ১৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হবে চৈত্রসংক্রান্তি উৎসব। বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ করে নেয়ার এ আয়োজনটি শুরু হবে ওই দিন সন্ধ্যা ৬টায়। চলবে রাত ১২টা ৫ মিনিট পর্যন্ত। এ উৎসবের পরিকল্পনা করেছেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। সুরের ধারা ও চ্যানেল আইয়ের যৌথ আয়োজনের অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করবে চ্যানেল আই। ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী ॥ প্রতিবছরে মতো এবারও শিশুপার্কের সামনের ভাসানী সড়কে সকাল থেকেই নানা আয়োজনে বর্ষবরণের প্রস্তুতি নিয়েছে ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী। সকাল সাড়ে ৭টায় শুরু হওয়া এ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। অনুষ্ঠানে ঋষিজের পক্ষ থেকে ড. নুজহাত চৌধুরী, কবি রাজু আলিমসহ চার গুণীজনকে সংবর্ধনা দেয়া হবে। পরিবেশিত হবে একক দলীয় সঙ্গীত। থাকবে কবিতা পাঠ। রবীন্দ্র সরোবরে জোটের নববর্ষ ॥ পহেলা বৈশাখ ধানম-ির রবীন্দ্র সরোবরে অনুষ্ঠিত হবে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নববর্ষ অনুষ্ঠান। বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে শুরু হওয়া আয়োজনটি চলবে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত। থাকবে গান, কবিতা ও নাচে সাজানো সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। অন্যান্য আয়োজন ॥ এছাড়া শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের নববর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানমালা এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি।
×