পানামার প্রসিকিউটররা ‘পানামা পেপার্স’ নিয়ে ফৌজদারি তদন্ত শুরু করবেন। পানামা সিটিতে সোমবার স্টেট প্রসিকিউটরের দফতর বিশ্বের ধনী ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের জন্য বিদেশী কোম্পানি গড়ে তুলেছিল এমন এক ল ফার্ম সম্পর্কে ফাঁস হওয়া ব্যাপক তথ্য নিয়ে তদন্ত শুরু করবে বলে জানিয়েছেন। দফতরের এক বিবৃতিতে বলা হয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে ‘পানামা পেপারস’ নামে বর্ণিত তথ্যগুলো নিয়ে ফৌজদারি তদন্ত চালানো হবে। এদিকে, ‘পানামা পেপারস’ তথ্য ফাঁসের ঘটনায় বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক ক্ষমতাধররা এক ঝাঁকুনি খেয়েছেন। আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে এবং পাকিস্তানী নেতাদের সন্তানরা নিজেদের নির্দোষ বলে জোরালো কণ্ঠে দাবি জানাচ্ছেন। এদিকে, বিশ্বের ধনী ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের অবৈধ অর্থের পাহাড় গড়তে সহায়তাকারী ঐ ল ফার্ম মোওস্যাক ফনসেনা সম্পর্কিত গোপন নথি ফাঁসের পর বিভিন্ন দেশের সরকারও এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে। খবর এএফপি, বিবিসি ও অন্যান্য ওয়েবসাইটের।
প্রসিকিউটরের বিবৃতিতে বলা হয়, কী অপরাধ করা হয়েছে, কারা অপরাধ করেছে এবং এতে সম্ভাব্য কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তা নির্ণয় করতে তদন্ত চালানো হবে। মোওস্যাক ফনসেনা বলছে, এর সার্ভার থেকে ১ কোটি ১৫ লাখ দলিল ফাঁস হয়ে যাওয়া সীমিত হ্যাকিংয়েরই ফল এবং বাইরের কোন পক্ষই সেজন্য দায়ী বলে মনে হয়। ল ফার্মের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা র্যামন ফনসেকা বলেন, ঐ ফাঁসের ঘটনা পানামার ওপরই এক আঘাত, কারণ দেশটি এর আর্থিক সেবা খাতের ওপরই নির্ভরশীল। পানামার প্রেসিডেন্ট হুয়ান কার্লোস ভারেলা বলেন, তার দেশ ঐ কেলেঙ্কারিজনিত যে কোন তদন্তে যে কোন সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করবে। কিন্তু তিনি তার দেশের ভাবমূর্তি রক্ষার সংকল্পও ব্যক্ত করেন। অর্থ পাচার ও অন্যান্য গোপন লেনদেনের আস্তানা হিসেবে কুখ্যাতি মুছে দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে দেশটি ভাবমূর্তি উন্নত করছে। সেখানে বিদেশী কোম্পানিগুলো আপনিতেই অবৈধ নয়। কিন্তু অর্থ পাচার করতে বা অন্যান্য দেশের কর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সম্পদ গোপন করতে এসব কোম্পানিকে কাজে লাগানো যেতে পারে। গত ৪০ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি তাদের ক্ষমতাশালী মক্কেলদের কিভাবে অর্থ পাচারে সহযোগিতা করেছে, নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর এবং কর ফাঁকি দেয়ার পথ দেখিয়েছে, সেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে ফাঁস হয়ে যাওয়া নথিতে। ‘দ্য অস্ট্রেলিয়ান ট্যাক্স অফিস’ বলেছে, তারা নথিতে থাকা ৮শ’র বেশি ধনী নাগরিকের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। অস্ট্রিয়ার ফিন্যান্সিয়াল মার্কেট রেগুলেটরÑ এফএমএ তদন্ত শুরু করেছে। নেদারল্যান্ডস কর্তৃপক্ষও সেই দেশের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে। সুইডেনের ফিন্যান্সিয়াল সুপারভাইজরি অথরিটি (এফএসএ) তার দেশের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তথ্য যোগাড় করতে এরই মধ্যে লুক্সেবার্গ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। ফ্রান্স ফাঁস হওয়া নথির মূল কাগজপত্রের ভিত্তিতে নিজস্বভাবে তদন্ত পরিচালনার উদ্যোগ নিচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) এবং বিশ্বের আরও এক শ’র বেশি গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা এ নথি ফাঁস করেছেন। কর ফাঁকি দিয়ে গোপন সম্পদের পাহাড় গড়া ব্যক্তিদের দলে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের বন্ধু থেকে শুরু করে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের স্বজন এবং আইসল্যান্ড, পাকিস্তান ও ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্টরা আছেন বলে জানিয়েছেন নথি হাতে পাওয়া সাংবাদিকরা। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, ‘ওই নথিতে যা পাওয়া গেছে তার কিছুই বস্তুগত নয় এবং নতুন নয়।
এ বিষয়ে কোন ধরনের তদন্তের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে পেসকভ বলেন, এই নথির পেছনে সাংবাদিকদের যে দলটি রয়েছে তাদের অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কর্মকর্তা। প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের মুখপাত্র বলেন, ডেভিড ক্যামেরনের প্রয়াত বাবা ইয়ান ক্যামেরনের বিদেশী কোম্পানির আড়ালে সম্পদের তথ্য গোপন রাখার যে তথ্য উঠে এসেছে সেটা তার ‘ব্যক্তিগত বিষয়।’ বিদেশী কোম্পানির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের ছেলে ও মেয়ের অবৈধ কিছু করার বিষয়টি বাতিল করে দিয়েছে পাকিস্তান। মোওস্যাক ফনসেকা তার ধনকুবের ক্লায়েন্টদের অর্থ গোপন রাখার উপায় দেখিয়ে দিত বলেও প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। তবে এক বিবৃতিতে এ অভিযোগ ‘সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য ও মিথ্যা’ বলে বর্ণনা করেছে পানামার প্রতিষ্ঠানটি। দলিলে দেখা যায়, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের চার সপ্তাহের মধ্যে তিনজন মারিয়াম সাফদাও, হাসান নওয়াজ ও হোসেইন নওয়াজ শরীফ লন্ডনে সম্পত্তি কিনতে নামমাত্র কোম্পানিগুলোকে কাজে লাগান।
হোসেইন নওয়াজ শরীফ জিও টিভিকে বলেন, ঐসব এ্যাপার্টমেন্ট আমাদের এবং ঐসব দেশী কোম্পানিও আমাদের। এতে অন্যায়ের কিছু নেই এবং আমি কখনও সেগুলো গোপন করিনি। চীনা কর্তৃপক্ষ পানামা পেপারস নামে ফাঁস হওয়া দলিলপত্র পোস্ট করেছে এমন সব সামাজিক মাধ্যমের ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করেছে বলে মনে হয়। দলিলপত্রে কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ নিয়েছিলেন এমন কয়েক ধনী চীনা ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়। তাদের মধ্যে প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের বড় বোনের স্বামী দেং জিয়াগুইও ছিলেন। ঐ বিষয়ে সিনা উইবো ও ওয়েচাতের মতো নেটওয়ার্কগুলোতে পোস্ট করা শত শত দলিল সোমবার সকাল থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। পানামা পেপারসে দেখা যায়, ২০০৯ সালে দেং দুটি বিদেশী কোম্পানির মালিক হন। শি তখন রাজনীতিতে উদীয়মান ছিলেন। ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস, জার্মান পত্রিকা সুডডয়েচ জেইটুং এবং বিবিসিসহ বিশ্বের কয়েকটি বার্তা সংস্থা রবিবার ঐ দলিলপত্র প্রকাশ করে। এর আগে এক বছর ধরে অনুসন্ধান চালানো হয়।