ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

রিজার্ভ চুরির কলকাঠি নাড়া হয়েছে চীন থেকে

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৩ এপ্রিল ২০১৬

রিজার্ভ চুরির কলকাঠি নাড়া হয়েছে চীন থেকে

রহিম শেখ ॥ ফিলিপিন্স নয়, বাংলাদেশের রিজার্ভের অর্থ হ্যাকিংয়ে পুরো কলকাঠি নাড়া হয়েছে চীন থেকেই। চীনা বংশোদ্ভূত কয়েকজন ফিলিপিনো এ ঘটনার হোতা হলেও নীলনক্সাটি হয়েছে চীনেই এবং সেখান থেকেই তা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। ইতোমধ্যে ফিলিপিন্সের সিনেট শুনানিতে ক্যাসিনো ব্যবসায়ী কিম অং জানিয়েছেন, চুরির অর্থ রিজাল ব্যাংকে নিয়ে আসেন দুই চীনা ব্যবসায়ী- শুহুয়া গাউ ও দিং ঝিজে। এই দুই চীনা নাগরিক বাংলাদেশেও এসেছিলেন বলে ধারণা করছে সিআইডি। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ্যাকাউন্ট থেকে ফিলিপিন্সের মাধ্যমে পাচার হওয়া অর্থের একাংশ ফেরত নিতে শনিবার ম্যানিলার উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা। সেখানে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি এ ঘটনায় চলমান সিনেট তদন্তেও অংশ নেবেন বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে। আজ রবিবার বা আগামীকাল সোমবার সিআইডির সদস্যরা রওনা হতে পারেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। জানা গেছে, কিছু ফিলিপিনো নাগরিক হয়ত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার লোপাটের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এ চুরি ফিলিপিন্স থেকে ঘটেনি। ঘটেছে চীন থেকে। ফিলিপিন্স সিনেটের প্রো-টেমেপার রালফ রেক্টো সম্প্রতি এ মন্তব্য করেন। ইতোমধ্যে ফিলিপিন্সের সিনেট শুনানিতে ক্যাসিনো ব্যবসায়ী কিম অং জানিয়েছেন, চুরির অর্থ রিজাল ব্যাংকে নিয়ে আসেন দুই চীনা ব্যবসায়ী- শুহুয়া গাউ ও দিং ঝিজে। এই দুই চীনা বাংলাদেশেও এসেছিলেন বলে ধারণা বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি)। এদের কেউ গত দুই বছরে বাংলাদেশে এসেছিল কি-না ইমিগ্রেশন বিভাগ তা খতিয়ে দেখছে। সিআইডির উর্ধতন এক কর্মকর্তা জানান, টাকা চুরির বিষয়টি দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা করে করা হয়েছে। এ কারণে হ্যাকার চক্রের সদস্যরা নাম ও পাসপোর্ট পাল্টে বাংলাদেশে আসতে পারে বলে তারা ধারণা করছেন। এজন্য অভিযুক্তদের ছবি দেখেও তাদের ঢাকায় আসার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা চলছে বলে সিআইডির এক কর্মকর্তা জানান। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ্যাকাউন্ট থেকে ফিলিপিন্সের মাধ্যমে পাচার হওয়া অর্থের একাংশ ফেরত নিতে শনিবার ম্যানিলার উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছেন বাংলাদেশের তদন্তকারী এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিরা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের যুগ্ম পরিচালক আবদুর রউফ ও এ্যাকাউন্ট এ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টের ডিজিএম জাকির হোসেন শনিবার ফিলিপিন্সের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। তারা সেখানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জন গোমেজের সঙ্গে মিলে সিনেট কমিটি ও তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য দেয়া-নেয়া করবেন এবং সিনেট শুনানিতে অংশ নেবেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিআইডির এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, ফিলিপিন্স ও শ্রীলঙ্কা যাওয়ার বিষয়ে এখনও দিনক্ষণ ঠিক হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জিও (আদেশ) এবং অর্থছাড় হলেই ওই দুই দেশের উদ্দেশে সিআইডি সদস্যরা রওনা দেবেন। আমরা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি। তবে অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, সোমবার বা মঙ্গলবার সিআইডির একটি দল ফিলিপিন্সের উদ্দেশে রওনা দিতে পারে। এর আগে ফিলিপিন্সে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত জন গোমেজ দেশটির গণমাধ্যমে বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তারা ৩ এপ্রিল ফিলিপিন্সে পৌঁছবেন। এরপর রিজার্ভ চুরির ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব পাওয়া সিআইডির সদস্যরা একই উদ্দেশে ৪ এপ্রিল সেখানে যাবেন। রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন, তদন্তের সমন্বয়ের কাজে প্রথমে ফিলিপিন্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দেশটির এন্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিলের (এএমএলসি) কার্যালয়ে যাবেন সিআইডি সদস্যরা। ক্যাসিনোতে যাওয়া অর্থ ফেরত পাওয়ার বিষয়ে এএমএলসি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবেন তারা। পাশাপাশি নিজস্ব তদন্ত কার্যক্রমও পরিচালনা করবে সিআইডি। চুরি যাওয়া অর্থ কিভাবে ফিলিপিন্সে ঢুকল এবং কারা এ ঘটনায় জড়িত সে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে সিআইডি তদন্ত করবে। এছাড়া সিআইডি সদস্যরা মঙ্গলবার সিনেটের ব্লু রিবন কমিটিতে অনুষ্ঠেয় শুনানিতেও অংশ নেবেন। টাকার উৎস জানাতে চান না কিম ॥ ফিলিপিন্সের ক্যাসিনো বস কিম অং বললেন, আমার এ্যাকাউন্টে কোথা থেকে টাকা এসেছে তা আমার কাছে জানতে চাইবেন না। তিনি বলেন, ক্যাসিনোতে আমরা সব সময়ই একটা কথা বলে থাকি। তা হলো- কথার আগে তোমার টাকা দেখাও। এক সাক্ষাতকারে এসব কথা বলেছেন বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, ওই টাকার উৎস? জবাবে কিম অং বলেন, এ কথা জিজ্ঞেস করবেন না। এটা অপমানজনক। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের রাজকোষ চুরিতে বহুল আলোচিত নাম কিম অং। ইতিমধ্যে সিনেট ব্লু রিবন কমিটির শুনানিতে তিনি এ দুর্নীতি থেকে তার ভাগে পাওয়া অর্থের বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। এ সময়ে তিনি দু’জন চীনা নাগরিকের নাম প্রকাশ করলেও তাদের এখনও গ্রেফতার করা হয়নি। তারা এখন ফিলিপিন্সের ভিতরে অবস্থান করছেন কিনা তাও নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। কিম অং কিভাবে ক্যাসিনো বসে পরিণত হয়েছেন তা নিজেই বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ফিলিপিন্সে শক্তিধর সব রাজনীতিবিদদের সঙ্গে রয়েছে তার সখ্য। তার মধ্যে দু’জন আছেন এর আগে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী। কিম অং বলেছেন, শৈশবেই হংকং থেকে তিনি ফিলিপিন্সে পাড়ি জমান। এখানে এসেই আস্তে আস্তে ধনী হতে থাকেন। বাড়ে তার বন্ধুবান্ধব। তিনি বলেছেন, তার বয়স যখন ১১ বছর তখনই তার মা তাকে নিয়ে যান ফিলিপিন্সের রাজধানী ম্যানিলায়। এখনও তার রয়েছে চীনা পাসপোর্ট। কিম অং বলেছেন, তার আসল নাম হলো কাম সিন অং। বসবাস করেন পিতার সঙ্গে ম্যানিলায়। সেখানে তার পিতা এক ধনী আত্মীয়ের তামাক কোম্পানিতে চাকরি করতেন। কলেজের পড়া বাদ দেয়ার পর সেখানে কাজ করেছেন কিম অং-ও। তার এক আত্মীয়র মালিকানাধীন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। এরপর কিম অং টি-শার্ট কারখানা খোলেন। ম্যানিলায় খোলেন বেশ কিছু রেস্তরাঁ। এ সময়ে তার বন্ধু-বান্ধবের পরিধির বিস্তার লাভ করে। অংশীদারদের নিয়ে তিনি সংগ্রহ করেন ১০০ কোটি পেসো। তা দিয়ে দাঁড় করান ইস্টার্ন হাওয়াই লেইজার কোম্পানি। এখানে এখন কাজ করে স্থানীয় কমপক্ষে এক হাজার স্টাফ। এর বাইরে রয়েছেন ৩০০ চীনা নাগরিক। তারা টেলিফোনে জুয়াড়িদের বাজি গ্রহণ করেন। প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেম হ্যাকড করে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ্যাকাউন্ট থেকে হ্যাকাররা ১০০ মিলিয়ন অর্থ চুরি করে। সেখান থেকে ২০ মিলিয়ন যায় শ্রীলঙ্কায়। আর ৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ফিলিপিন্সে পাঠানো হয়। তা সেখানকার একটি ব্যাংকের মাধ্যমে ফিলিপিনো পেসোতে রূপান্তরের পর দুটি ক্যাসিনোতে পাঠানো হয়। হ্যাকাররা অর্থ স্থানান্তরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভে ৩৫টি ভুয়া অনুরোধ পাঠায়। এর মধ্যে ৪টি অনুরোধের অর্থ ঠিকমতো স্থানান্তর হয় ফিলিপিন্সে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ থেকে ২০ মিলিয়ন ডলারের ওই অর্থ শ্রীলঙ্কায় পৌঁছায় ডয়চে ব্যাংকের হাত ঘুরে। তাদেরই সন্দেহের কারণে শেষ পর্যন্ত শালিকা ফাউন্ডেশনের এ্যাকাউন্টে যাওয়া ওই অর্থ আটকে যায়। ওই অর্থ স্থানান্তরের অনুরোধে প্রাপকের জায়গায় ‘ফাউন্ডেশন’ বানান ভুল থাকায় ডয়চে ব্যাংক বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছিল। আর এর মাধ্যমেই বেরিয়ে আসে, অর্থ স্থানান্তরের অনুরোধটি ছিল ভুয়া। আর তাতে বাকি ৩০টি অনুরোধ আটকে যায়। ফাঁস হয়, বিশ্বের আলোচিত এক সাইবার ডাকাতির ঘটনা।
×