ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

অন্যের মুখাপেক্ষী নয় আত্মনির্ভরশীল হতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৯ মার্চ ২০১৬

অন্যের মুখাপেক্ষী নয় আত্মনির্ভরশীল হতে হবে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে আত্মনির্ভরশীল হতে নারীদের পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, ধর্মের নাম নিয়ে কখনও কাউকেই পিছনে ঠেলে দেয়া বা কূপম-ূকতায় ঠেলে দেয়ার সেই সুযোগ নেই। ধর্মের নামে নারীকে ‘কূপম-ূক’ করে রাখা যাবে না। আর আমাদের (নারী) কারও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলে চলবে না। নিজেদের ভাগ্য নিজেদের গড়তে হবে, নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হবে, আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলতে হবে। তবেই মর্যাদা পাওয়া যাবে। কেঁদে কেঁদে ফিরলে মর্যাদা কেউ হাতে তুলে দেয় না। বরং করুণা করবে। আর করুণা নিয়ে মেয়েরা বাঁচতে পারে না। আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০১৬ উপলক্ষে মঙ্গলবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের ইসলাম ধর্ম, এই ধর্মই একমাত্র ধর্ম যে ধর্মে একজন নারী প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ইসলাম ধর্মে নারীদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, স্বামীর সম্পদে যেমন তাদের অধিকার, পিতার সম্পদেও অধিকার, এই সম্পদের অধিকার একমাত্র ইসলাম ধর্মেই দেয়া আছে। নারীদের নিজেদের কর্মমর্যাদা ও আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠারও আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। ‘অধিকার মর্যাদায় নারী-পুরুষ সমান সমান’- প্রতিপাদ্য নিয়ে এ বছর পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মেয়েদের হাতে কাজ দিলে তারা অত্যন্ত সুনিপুণভাবে করে। দুর্নীতিতে মেয়েরা একটু কম জড়ায়। ছেলেরা একটু বেশি জড়ায়, এতে কোন সন্দেহ নেই। নারীদের আর অবহেলার সুযোগ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, সারা দেশে মেয়েরা তাঁদের ওপর অর্পিত কাজগুলো সুচারুভাবে করে যাচ্ছেন। যত বেশি সুযোগ সৃষ্টি করতে পারব, তত বেশি কাজ করার সুযোগ তারা পাবেন। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, একজন মেয়ে যদি সারা দিন কাজ করে আঁচলে বেঁধে কিছু টাকা নিয়ে আসেন, তাহলে সংসারে তার দাম থাকে। আর্থিকভাবে নিজেকে সচ্ছল করতে পারলে সংসার, সমাজ সবাই তাকে দাম দেয়। যুদ্ধ-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও নিয়োজিত থাকার দৃষ্টান্ত ইসলাম ধর্মে রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিবি খাদিজা যখন প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন, তিনি কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন, দেশ-বিদেশেও ঘুরতেন। কাজেই আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত রয়েছে। আমাদের ঘাবড়াবার কিছু নেই। তিনি বলেন, ইসলাম ধর্মের জন্য যে জেহাদ হয়েছে সেখানে প্রথম শহীদ একজন নারী। এছাড়া মহানবী (স.) এর সঙ্গে বিবি আয়েশা রণক্ষেত্রে যেতেন। তার পাশে পাশে থাকতেন, অনুপ্রেরণা দিতেন। এছাড়া ইসলাম ধর্মে নারীর ক্ষমতায়নে গৌরবের ইতিহাস রয়েছে সেকথা সব সময় সবার মনে রাখতে হবে। নারীদের নিজেদের কর্ম, মর্যাদা ও আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার আহ্বানও জানান তিনি। একটি সংসার সুখী রাখতে মেয়েদের অনেক দায়িত্ব থাকে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি সংসার সুখের করতে মেয়েদের অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়। আশা করি, আমার বোনেরা সেই দায়িত্ব পালন করবেন। কথায় তো আছে যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে। মেয়েরা সব পারে। ঘরে যেমন কাজ করতে পারে, বাইরেও কাজ করতে পারে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ একটি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হবে বলেও প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেন। উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশের লক্ষ্য পূরণে সমাজের সবার উন্নতির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, সকলেরই উন্নতি না হলে একটা দেশ কখনও উন্নত হতে পারে না। সমাজের একটি অংশকে অবহেলিত রেখে আরেকটি অংশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই নারীর ক্ষমতায়নে বঙ্গবন্ধুর নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সংবিধানে নারীর অধিকার সংরক্ষণের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা, মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোটা সুবিধা সংরক্ষণসহ নারীর উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। বিশ্বব্যাপী নারীদের পিছিয়ে থাকা ও নির্যাতিত হওয়ার উদাহরণ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারীরাই কিন্তু দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত। তারা মর্যাদা থেকে বঞ্চিত, কাজ করলেও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত। নানানভাবে তারা অবহেলিত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা যেখানে যুদ্ধ হয় সেখানে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী, শিশুরা। তারাই সব থেকে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। এ বিষয়ে সবাইকে আরও সচেতন হতে হবে। তিনি বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় তো বটেই, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের থেকেও এগিয়ে আছে। বাংলাদেশ বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে সরকার প্রধান, বিরোধী দলের নেতা, জাতীয় সংসদের স্পীকার, সংসদ উপনেতা চারজনই নারী। বাংলাদেশ আজকে বিশ্বে দৃষ্টান্ত। এই দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে আর কোন দেশ সৃষ্টি করতে পারেনি। তিনি বলেন, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ বা যারা সারা বিশে মোড়লগিরি করে বেড়ায় তারা কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন নারী সরকারপ্রধান নির্বাচিত করতে পারেনি। ভোটের অধিকার দিয়েছে অনেক পরে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী তিন বাহিনীতে নারীদের উপস্থিতি, জজকোর্টে নারী, নারী পাইলটসহ সাঁতার ও ভারোত্তলনে দুই নারীর স্বর্ণ জয়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা যখন মেয়েদের খেলাধুলা শুরু করলাম প্রমীলা ফুটবল। রাজশাহীতে তো খেলতেই পারলাম না। প্রচ- বাঁধা। এখন আর সে অবস্থা নেই। এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। সমাজে নারীদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সুযোগ সৃষ্টির কথা উল্লেখ করে সেগুলোকে কাজে লাগানোর আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো অনেক বেশি অগ্রগামী। সমাজের অর্ধেক নারীকে বাদ দিয়ে উন্নয়ন সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা যদি মানবদেহের কথা বলি, একটা অংশ পঙ্গু হলে চলাফেরা কত কষ্টকর সেটা সবাই উপলব্ধি করতে পারে। সে বিবেচনা করেই আমাদের সবাইকে চিন্তা করতে হবে, সমাজের সবাইকে এক সঙ্গে উন্নয়ন করতে হবে। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পরেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদেশে নারীর ক্ষমতায়নের সূচনা করেন। বঙ্গবন্ধু নারী-পুরুষের সমান অধিকারে বিশ্বাস করতেন। জাতীয় জীবনের সকলক্ষেত্রে নারীর সমানাধিকারের বিষয়টি তিনি সংবিধানের ১৯ এবং ২৮ অনুচ্ছেদে নিশ্চিত করেছেন। জাতির পিতা মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত মা-বোনদের ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাব এবং রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান, স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের পুনর্বাসন ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে ‘নারী পুনর্বাসন বোর্ড’ গঠন করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী এ সময় মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত মা-বোনদের কথা স্মরণ করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পরে মা-বোনেরা বিভিন্ন রোগ অসুখে ভুগছিল। বিদেশ থেকে ডাক্তার এনে বঙ্গবন্ধু তাদের চিকিৎসা করান। আমার মা (ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) একাত্তরের সেই নারীদের পরিচর্যা করেছিলেন। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে হানাদারদের হাতে নির্যাতিন মা-বোনেরা সুস্থ হওয়ার পর অনেকে পরিচয় দিতে চাইত না। তাদের অনেককেই তাদের পরিবারে আর গ্রহণ করা হয়নি। বিয়ের সময় বাবার নামের সমস্যা হতো-‘জাতির পিতা বলেছিলেন, লিখে দাও বাবার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। বাড়ি ৩২ নম্বর ধানম-ি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতি। পরমুখাপেক্ষী হয়ে আমরা বাঁচতে চাই না। আমাদের ভাগ্য আমরা নিজেরাই গড়ে তুলব। এজন্য প্রয়োজন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। তিনি বলেন, নারীকে জাতীয় উন্নয়নের মূলস্রোতে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলেই আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলতে পারব। বাংলাদেশ হবে বিশ্বের বুকে একটি সমৃদ্ধশালী, শান্তিপূর্ণ দেশ। তিনি বলেন, আমরা দেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গঠনের যে কর্মকা- বাস্তবায়ন করছি-এ সব কাজে পুরুষের পাশপাশি নারী সমাজও সমানতালে দায়িত্ব পালন করছেন। অনুষ্ঠানে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার ‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার হে বিধাতা?’ লাইনটি আবৃত্তি করে শেখ হাসিনা বলেন, কাঁদব না আমরা। আমাদের অধিকার আমরা নিজেরাই আদায় করে নেব। নিজেরাই অর্জন করব। এ আত্মবিশ্বাস নিয়ে চলতে হবে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’ এবং ‘সেদিন সুদূর নয়; যেদিন ধরণী পুরুষের সঙ্গে গাহিবে নারীরও জয়’ লাইনগুলো আবৃত্তি করে শুনান। নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন ইউএন ওমেন ইন বাংলাদেশের দেশীয় প্রতিনিধি ক্রিষ্টিন হান্টার। নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমা বেগম অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব ড. সুরাইয়া বেগমসহ মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দফতর এবং অধিদফতরের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, কূটনৈতিক মিশনের সদস্য, আন্তর্জাতিক সহযোগী সংগঠনের কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন।
×