ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পান্থ আফজাল

কল্যাণের জন্যে উদ্যমী তারুণ্য

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ১ মার্চ ২০১৬

কল্যাণের জন্যে উদ্যমী তারুণ্য

অভিনব এ কর্মসূচী পালনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন স্তরের সামাজিক সচেতন মানুষ, সংগঠন আর প্রতিষ্ঠানে গুঞ্জন শুরু হয় এই প্রকৃতির সচেতন সংগঠন নিয়ে। একে একে সর্বস্থরের মানুষের সাধুবাদে সিক্ত হয় এই সংগঠন আর এর উদ্যমী কর্মীগণ। সকলের মাঝে নতুন করে আবারও প্রকাশ পায় এই ছোট্ট সামাজিক সংগঠনের। দুর্নীতি, মাদক ও অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে মাত্র ১১ জন সদস্য নিয়ে অপরূপ শহর রাজবাড়ীর উপজেলা গোয়ালন্দে ২০১০ সালে জন্ম হয় তারুণ্যদীপ্ত এই সামাজিক সংগঠনের। সামাজিক দায়বদ্ধতা, প্রকৃতির প্রতি অকৃতিম ভালবাসা আর অফুরন্ত মানবতাবোধ মন্ত্রে বলিয়ান একদল স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র সূচনালগ্ন থেকেই একে একে করে চলছে ভিন্নধর্মী সব সামাজিক কর্মকা । ‘একজ জাগরণে’ বা ‘এসো কল্যাণের জন্যে’- নামটা নিশ্চয়ই সকলের নিকট একটু ভিন্ন, একটু ভাললাগার। সুন্দর এই নাম এই সংগঠনের নিকট প্রেরণার, নতুন কিছু করে দেখনোর। আর ‘জাগরণের আলোয় উজ্জীবিত হোক সমাজ’ মূলমন্ত্রে উদীপ্ত তারুণ্যের এই সংগঠন ‘একজ জাগরণে’ এর সমস্ত ভিন্নধর্মী সামাজিক কাজ পরিচালিত হয় দলের কা ারি সুজন সরওয়ার এর অক্লান্ত চেষ্টা আর পরিশ্রমে। সামাজিক এই সংগঠন চালাতে এই সংগঠনের সবার রয়েছে আলাদা চিন্তা আর চেতনা। দলের প্রতিষ্ঠাতা সুজন সরওয়ার কথায় কথায় বলেন, ‘আমরা কখনও বাইরের কারও কাছ থেকে অর্থ আদায় বা চাঁদা তুলি না। সব অর্থই নিজেরা দিয়ে থাকি। এ ছাড়া কোন অনুষ্ঠানেই কাউকে প্রধান বা বিশেষ অতিথি করা হয় না।’ সামাজিক এই সংগঠন পাখি শিকারীদের রোধ করতে বিভিন্ন সময়ে করে থাকে ভিন্ন ধরনের প্রতিবাদ। সংগঠনের সদস্যদের একজন জাবের বলেন, ‘গোয়ালন্দ একটি নদীবেষ্টিত এলাকা। শীত মৌসুমে যে নদীগুলো শুকিয়ে অনেকটা বিলে রূপান্তরিত হয়। আর সেই বিলই হয়ে ওঠে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন প্রজাতির পাখির অভয়ারণ্য। শিকারীসহ বিভিন্ন কারণে বিগত বছরে তুলনায় এ স্থানে পাখির সংখ্যা কমে গেছে। পানকৌড়িসহ পাখিদের বসবাসের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরী। জলজ এসব পাখি জাতীয় প্রাণী নিরাপদ আশ্রয় পেলে সেখানে বসবাস শুরু করে। এদের আবাসস্থল রক্ষা করলে জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাবে। গাছের প্রতি বিস্ময়কর ভালবাসার উদাহরণ চোখে পড়ে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ বাজার রেলস্টেশন চত্বরে। সামাজিক সংগঠন ‘একজ জাগরণে’ এলাকার সৌন্দর্য বর্ধনে ২০১১ সালে গোয়ালন্দ বাজার স্টেশন পার্শ্ববর্তী এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কৃষ্ণচূঁড়া গাছের চারা রোপণ করে। তারা গোয়ালন্দ পৌর এলাকার বিভিন্ন সড়ক, বাজার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৪ বছর আগে ৩ হাজার কৃষ্ণচূড়া গাছ রোপণ করে। কৃষ্ণচূড়াগুলোতে প্রতি বছর ফুল ফুটতে শুরু করে। কিন্তু মানুষের নির্মমতার শিকার হয়ে এ গাছগুলো বেড়ে ওঠা কঠিন হয়ে যায়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ব্যানার-ফেস্টুন, বিভিন্ন কোম্পানির বিজ্ঞাপন ঝোলাতে এক একটি গাছে অসংখ্য বড় বড় পেরেক ঠোকা হয়। তাই বাধ্য হয়ে এই সংগঠন এ ধরনের প্রতীকী প্রতিবাদ জানায়, যা একসময় সবার মাঝে আলোচনার জন্ম দেয়। তরুণদের নিয়ে বিভিন্ন চমকপ্রদ নামে টিম গঠন করে এই সংগঠন আয়োজন করে থাকে ক্রিকেট টুর্নামেন্টের। এলাকার প্রত্যেক তরুণ ও যুবকের ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস তৈরি করতে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাগ্রত করতে, দেশপ্রেম, বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে কয়েক বছর ধরে এই সামাজিক সংগঠন ফুটবল ও ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করে আসছে। সংগঠনের সকল সদস্যদের নিয়ে সাতটি দলে ভাগ করে তারপর প্রত্যেক দলের নামকরণ করা হয় যথাক্রমে মাদকবিরোধী, ইভ টিজিং-বিরোধী, দুর্নীতিবিরোধী, অপসংস্কৃতিবিরোধী, বইপ্রেমী, প্রকৃতিপ্রেমী ও অসাম্প্রদায়িক মুক্তমনা একাদশ। আর খেলা শুরুর আগে খেলোয়াড়দের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দেশপ্রেম এবং টুর্নামেন্টের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে শপথবাক্য পাঠ করানোও হয়ে থাকে। ভিন্ন ধর্মী কর্মকাে র মধ্যে এই সংগঠন একসময় বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে সর্বত্র বিভিন্ন দেশের পতাকা উত্তোলন বন্ধ রাখা এবং নিয়ম-নীতি না মেনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও অবমাননার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে উপজেলা প্রশাসন অফিসে দিয়েছিল স্মারকলিপি। জাতীয় পতাকার মর্যাদা অক্ষুণœ রাখার দাবিতে তারা করেছে পতাকা শোভাযাত্রা। এই সংগঠন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার দেওয়া উপহার নিয়েও কাজ করেছে। এ্যালুমিনিয়াম, তৈজসপত্র ও প্লাস্টিক সামগ্রী উপহারের পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের বইয়ের প্রতি ঝোঁক বাড়াতে গত কয়েক বছর ধরে বই দেয়ার জন্য গোয়ালন্দ উপজেলার প্রতিটি স্কুল-কলেজের প্রধান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এমনকি শিক্ষামন্ত্রীর কাছেও লিখিতভাবে আবেদন জানিয়েছে ‘একজ’। ফলও হাতেনাতে পেয়েছে তারা। আবেদনের পর অনেক প্রতিষ্ঠান কয়েক বছর ধরে উপহার হিসেবে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিতে শুরু করেছে। ‘কবিতায় জাগ্রত হোক মানবতার জয়গান’ সেøাগানে হাজারের মঙ্গল প্রদ্বীপ জ্বালিয়ে এবং সংস্কৃতি অঙ্গনের শিল্পীদের সমবেত জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার সঠিক চর্চার প্রয়াসে গত কয়েক বছর ধরে এই সংগঠন আয়োজন করে আসছে কবিতা উৎসবের। মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে প্রতিবছর ২২ ফেব্রুয়ারিতে সন্ধ্যায় গোয়ালন্দ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন আনছার ক্লাব চত্বরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে আয়োজিত হয়ে থাকে এই কবিতা উৎসবের। শুভ সূচনা করে গোয়ালন্দ। এই কবিতা উৎসবে বরাবরই আমন্ত্রণ জানানো হয়ে থাকে রাজবাড়ীর প্রিয়তমেষু আবৃত্তি নিকেতন, রাজবাড়ী আবৃত্তি পরিষদ, মাগুরার কণ্ঠবীথি, মাদারীপুরের উদ্ভাস, মাত্রা, গোপালগঞ্জের আবৃত্তি আড্ডা, ফরিদপুরের অংকুর, ফরিদপুর আবৃত্তি সংসদ এবং স্থানিয় গোয়ালন্দের একজ আবৃত্তি সংগঠন এবং একঝাক তরুণ আবৃত্তিকারদের। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত অনুষ্ঠিত কবিতা উৎসবে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার শত শত মানুষ উপস্থিত থেকে উৎসব উপভোগ করে থাকে। গত বছর ‘দেশ নির্মাণে স্বেচ্ছাশ্রম’ এই সেøাগানে ব্রত হয়ে দক্ষিণ দৌলতদিয়া তোরাপ শেখেরপাড়া গ্রামের মোল্লার চালা থেকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক পর্যন্ত আধা কিলোমিটারের রাস্তাটি স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে নির্মাণে স্থানীয় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রদের সংগঠন ‘একজ’-এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে অংশ নেয় এলাকার বিভিন্ন বয়সের কয়েকশ মানুষ। সকাল থেকে মাটি কেটে রাস্তা নির্মাণে নেমে পড়েন সাধারণ মানুষ। অপেক্ষায় না থেকে ধনী-দরিদ্র, কিশোর, যুবক, জনপ্রতিনিধি- সবাই আনন্দের সঙ্গে স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে রাস্তা নির্মাণের এ মহৎ কাজ শুরু করে একজ জাগরণের তত্ত্বাবধানে। ২০১৪ সালে তারুণ্যের এই সংগঠন একজ জাগরণ এর আগে সম্পন্ন করে তালের বীজ বপন কর্মসূচী ’১৪। এ কর্মসূচীতে ১০ দিনে প্রায় ৮.৫ কি.মি. জুড়ে ১৫০০ তালের বীজ বপন করা হয়েছিল। ‘একজ’ নামক তারুণ্যের এই জয়যাত্রা নশ্বর, ক্ষণস্থায়ী নয়। তাদের হাতেই সম্ভাবনার এই বাংলাদেশ।
×