ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়তে সংস্কৃতির বিকাশ জরুরী

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়তে সংস্কৃতির বিকাশ জরুরী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে নারী-পুরুষের সমান সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বিকাশের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের সার্বিক উন্নয়নের নারী-পুরুষের সমান সুযোগ সৃষ্টির প্রয়োজন রয়েছে। একই সঙ্গে উন্নত, সমৃদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়তে সংস্কৃতির যথাযথ বিকাশও অত্যন্ত জরুরী।’ প্রধানমন্ত্রী শনিবার বিকেলে রাজধানীর বেইলি রোডে বাংলাদেশ মহিলা সমিতির নবনির্মিত ভবন উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এসব কথা বলেন। খবর বাসসর। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. চৌধুরী মোহাম্মদ বাবুল হোসেন। বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ডাঃ মোঃ মোজাম্মেল হোসেন। সমিতির সভাপতি সিতারা আহসান উল্লাহ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদিকা তানিয়া হক প্রধানমন্ত্রীকে মহিলা সমিতির পক্ষে ক্রেস্ট উপহার দেন এবং অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। অনুষ্ঠানে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবর্গ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তাবৃন্দ, কূটনৈতিক মিশনের সদস্যবৃন্দ এবং উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। নাট্য আন্দোলনের ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার দেশে বিশ্বমানের একটি অত্যাধুনিক ডিজিটাল থিয়েটার নির্মাণের উদ্যোগ নেবে। তিনি বলেন, ‘দেশে একটাও বিশ্বমানের অত্যাধুনিক ডিজিটাল থিয়েটার নেই। আমরা তা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেব।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, অর্থমন্ত্রী এ বিষয়ে আগ্রহী। কাজেই টাকা-পয়সার সমস্যা হবে না। এই অত্যাধুনিক থিয়েটার হলটি এখানে অথবা পদ্মা সেতুর কাছে যে কনভেনশন সেন্টার নির্মাণ করা হচ্ছে সেখানেও নির্মাণ করা যেতে পারে। দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিকাশে নাট্যচর্চার বিরাট ভূমিকার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর যখন মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা ছিল, তখন নাটকের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল।’ এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে নাটক নীল দর্পণের ঐতিহাসিক ভূমিকাসহ ভোট ও ভাতের আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ দেশের সকল গণআন্দোলনে নাট্য আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, থিয়েটারের প্রতি আমার আগ্রহ আছে। আগে আমি প্রায়ই থিয়েটারে নাটক দেখতাম। এখনও দেশের বাইরে গেলে থিয়েটারে নাটক দেখি। দেশের বাইরে থিয়েটারে দেখেছি মঞ্চে হেলিকপ্টার নামে, গাড়ি আসে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশে সেই মানের থিয়েটার নেই। তিনি এ সময় স্মৃতিচারণ করে বলেন, আগে কম-বেশি সব সময়ই লুকিয়ে হলেও নাটক দেখতে আসতাম। বেইলি রোডে থাকতে বেশি আসা হতো। তিনি বলেন, আমি তো শুধু নাটকই দেখতাম না গ্রীন রুমে গিয়ে শিল্পীদের সঙ্গে কথা হতো। কাজেই নাট্যাঙ্গনের সুবিধা-অসুবিধার সবই আমার জানা আছে। জাতির পিতার সাড়ে তিন বছরের শাসনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তার পরিচালিত তিনটি সরকারের সময়ে দেশে নারী জাগরণে বিপ্লব ঘটেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জাতীয় সংসদ, স্কুল-কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিমানবাহিনীর পাইলট থেকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, তথ্যপ্রযুক্তি, সশস্ত্রবাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী, গণমাধ্যম, ক্রীড়াজগত কিংবা এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণসহ সকল চ্যালেঞ্জিং কাজে তাদের পেশাদারিত্ব প্রশংসনীয়। তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর আমার সরকার ইউনিয়ন পর্যায়ে সংরক্ষিত আসনে মহিলা কাউন্সিলর এবং পরবর্তীতে উপজেলা পর্যায়ে ভাইস চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি করে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখন ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীদের সংখ্যা বেশি। মহিলা শিক্ষিকার সংখ্যাও বেশি। দেশে নারী অগ্রগতির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের স্পীকার একজন নারী এবং তিনি কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। জাতীয় সংসদ নেতা, উপনেতা ও বিরোধীদলীয় নেতাও একজন নারী। সংসদের মূল চারটি পদেই নারী নেতৃত্ব বর্তমান। জানি না এমন অবস্থা আর কোথাও কোন দিন হবে কি না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারের নারী নীতিমালা প্রণয়ন, নারী উন্নয়ন, নারীর কর্মক্ষেত্র সম্প্রসারণ, দরিদ্র-অবহেলিত নারীদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় নিয়ে আসা এবং সর্বোপরি তৃণমূলের প্রান্তিক জনপদ থেকে শুরু করে সকল স্তরে নারীর ক্ষমতায়ন বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে ‘রোল মডেল’-এর খ্যাতি এনে দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘পুলিশের এসপি পর্যায়ে ’৯৬ পরবর্তী সময়ে যখন একজন নারীকে পদায়ন করা হয় তখন ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। পরে ওই পুলিশ কর্মকর্তা এক ডাকাত সর্দারসহ বড় একটি গ্যাংকে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়েছিলেন।’ সমাজের প্রান্তিক, অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিত, দরিদ্র নারীদের উন্নয়নে সরকার বিশেষ নজর দিয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ স্ববেতনে ৪ মাস থেকে ৬ মাসে বর্ধিত করা হয়েছে। জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্যের আসন সংখ্যা ৪৫ থেকে ৫০-এ উন্নীত করা হয়েছে। মহিলা উদ্যোক্তারা পুরুষ উদ্যোক্তাদের থেকে ৫ থেকে ৬ শতাংশ কম সুদে ঋণ পাচ্ছেন। দেশে ৫ হাজার ১৭৮টি ডিজিটাল সেন্টার করে দেয়া হয়েছে। যেখানে একজন পুরুষের পাশাপাশি একজন নারী উদ্যোক্তা রাখারও বিধান করা হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে শতকরা ৬০ ভাগ নারী শিক্ষিকা নেয়ার বিধান করা হয়েছে। বক্তৃতার শুরুতেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই ফেব্রুয়ারি মাসে জীবন দিয়ে রক্ষা করা হয় আমাদের মাতৃভাষার অধিকার। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ জাতির পিতার নির্দেশনায় শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। যা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে ’৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারিতে। ভাষা সংগ্রামের পথ ধরে স্বাধিকার আন্দোলন থেকে আসে স্বাধীনতা।’ প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ মহিলা সমিতিকে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের পুরোধা উল্লেখ করে এই সংগঠনের শীর্ষ দুই নেত্রী প্রয়াত ড. নীলিমা ইব্রাহিম এবং প্রয়াত আইভী রহমানের সঙ্গে কাটানো কিছু সময়ের খ- স্মৃতি রোমন্থন করেন। তিনি বলেন, ‘এই নির্মাণ কাজটি নিয়ে আমি অপেক্ষায় ছিলাম কবে শেষ হয়। আজ আমাকে উদ্বোধনের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ গর্বের সঙ্গে বলতে পারছিÑ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছিল। আজ তারাই আমাদের মাতৃভূমিকে বিশ্ব ফোরামে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন-অগ্রযাত্রার ‘রোল মডেল’ হিসেবে স্বীকার করছেন। বিশেষ করে নারীর অগ্রগতিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে রোল মডেল। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন। বর্তমানে ১ কোটি ৩০ লাখ শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে এখন সাক্ষরতার হার ৭১%। প্রাথমিক পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার ৫০.৫% (২০০৭ সালে) থেকে বর্তমানে ২০.৪% নামিয়ে এনেছি। মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৩১৬ মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। নারী ও পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা ২০২১ সালের আগেই বাংলাদেশকে একটি উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলব- এটিই হোক আমাদের অঙ্গীকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী-পুরুষ সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জাতির পিতার ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলতে সকলকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান।
×