ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

১৯৮৭ সালে বাংলাভাষা প্রচলন আইনও প্রণীত হয়েছে ;###;সংবিধানে ১৫৩ অনুচ্ছেদে কার্যকর করার তাগিদও আছে ;###;তবে প্রায় ২শ’ রায় বাংলায় লিখে ইতিহাস গড়েছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক

ভাষা আন্দোলনের ছয় দশকেও সুপ্রীমকোর্টে বাংলা উপেক্ষিত

প্রকাশিত: ০৪:৪৪, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

ভাষা আন্দোলনের ছয় দশকেও সুপ্রীমকোর্টে বাংলা উপেক্ষিত

আরাফাত মুন্না ॥ সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের ভাষা হবে বাংলা। এই বাংলা ভাষা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃতিও পেয়েছে। অথচ এর ব্যবহার নেই খোদ উচ্চ আদালতেই। সুপ্রীমকোর্ট রুলসে ভাষা হিসেবে প্রথমে বাংলা এবং পরবর্তী সময়ে আদালতের ভাষা ব্যবহারের কথা উল্লেখ থাকলেও ভাষা আন্দোলনের ছয় দশক পরও বাংলা ভাষা সুপ্রীমকোর্টে উপেক্ষিত। উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার না থাকায় বেশিরভাগ বিচারপ্রার্থী উচ্চ আদালতের রায় বা আদেশ বুঝতে পারেন না। ফলে তাদের পড়তে হয় বিড়ম্বনায়। দেশের উচ্চ আদালতসহ সব আদালতের বিচারকাজে বাংলাভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭ প্রয়োগের বিষয়ে ২০০১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আইন কমিশন একটি সুপারিশ পাঠায় আইন মন্ত্রণালয়ে। আইন কমিশনের ওই সুপারিশে ইংরেজীতে রচিত বিদ্যমান আইনগুলো বাংলায় অনুবাদ করার কথাও বলা হয়। এজন্য মন্ত্রণালয়গুলোর সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুবাদ কাজ বেগবান করা এবং সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষকে অধিকতর শক্তিশালী, গতিশীল এবং উদ্যোগী করে গড়ে তোলার বিষয়ে বলা হয়েছে ওই সুপারিশে। আইন কমিশনের সেই সুপারিশও উপেক্ষিত। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহার করার ক্ষেত্রে কিছু বাধাও রয়েছে। এর মধ্যে বিচার সংক্রান্ত আইনগুলো ইংরেজীতে থাকাই বড় বাধা। জানা গেছে, উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলিত না থাকার কয়েকটি কারণ রয়েছে, প্রথমত, বেঞ্চ কর্মকর্তারা বিচারকদের ডিক্টেশন বাংলা সহজে লিখতে পারে না। দ্বিতীয়ত, বাংলা ভাষায় আইনের তেমন প্রতিশব্দ না থাকা। তৃতীয়ত, ইংরেজী ভাষায় রায় লেখা দীর্ঘদিনের প্রচলন ও চতুর্থত, আইনের সব ভাষ্যই ইংরেজীতে। রাষ্ট্রের আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও সচিবালয়সহ শাসন বিভাগের সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলিত আছে, আইন বিভাগে জাতীয় সংসদের অধিবেশনসহ সব কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে বাংলা ভাষাতেই চলছে অথচ উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার প্রচলন নেই। উচ্চ আদালতে ইংরেজী ভাষায় বিচার পরিচালনা হচ্ছে। ১৯৭২ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ২৬ বছর স্বাধীন বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে আদালতের ভাষা হিসেবে বাংলা ব্যবহারের নজির দেখা যায় না। তবে ১৯৯৯ সালে উচ্চ আদালতের কয়েক বিচারক বাংলায় রায় লেখার উদ্যোগ গ্রহণ ও কার্যকর করেছিলেন। এরপর ২০০৬ সাল পর্যন্ত হাইকোর্ট বিভাগে কোন মামলায় বাংলা ভাষায় রায় প্রদান করা হয়নি। ২০০৭ সাল থেকে পুনরায় হাইকোর্ট বিভাগে দেওয়ানি, ফৌজদারি ও রিট মামলায় বাংলায় কয়েকটি রায় দেয়া হয়। স্বাধীনতার এতগুলো বছর অতিবাহিত হলেও উচ্চ আদালতে হাতেগোনা কয়েকটি রায় বাংলায় দেয়া হয়েছে। বাংলায় রায় লেখার যে সূত্রপাত তাঁরা করেছিলেন, তা আজও সর্বত্র অনুসৃত হতে পারেনি। বাংলা না থাকায় বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি ॥ বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায়, একজন নাগরিকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আইনজীবীরা উচ্চ আদালতে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেন, বিচারপতিরা পক্ষে-বিপক্ষে রায় দেন অথচ সেই রায় বোঝার শক্তি সেই নাগরিকের নেই। এ রায় বোঝার জন্য ফি দিয়ে কোন আইনজীবীর কাছে অনুবাদ করে মর্ম উদ্ধার করতে হয়। এছাড়া হাইকোর্ট দায়রা আদালতের প্রদত্ত রায়ের পর্যালোচনায় যখন মৃত্যুদ- নিশ্চিত করেন, তখন ক্ষতিগ্রস্ত বা লাভবান পক্ষ, আসামি বা বাদী যে-ই হোন, তিনি ইংরেজী ভাষার কারণে প্রকাশিত রায় বুঝতে পারেন না, জানতে পারেন না কী কারণে এবং কিসের ভিত্তিতে তাঁর দ-াদেশ বহাল থাকল বা খালাস হলো। একজন নাগরিক হিসেবে অবশ্যই মামলার ফলাফল জানার ও বোঝার অধিকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আছে। সাংবিধানিক ও আইনী বাধ্যবাধকতা ॥ সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। এই অতিগুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদটি জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলনের নির্দেশ দিয়েছে। কারণ এতে ‘দাপ্তরিক ভাষা’ বা ‘জাতীয় ভাষা’ ব্যবহার না করে ‘রাষ্ট্রভাষা’ ব্যবহার করা হয়েছে। সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদকে কার্যকর করতে ৭ অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়েছে- ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সে ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে। জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।’ সংবিধানে এটি একটি উল্লেখযোগ্য বিধান। এই বিধানটির সন্নিবেশের ফলে সংবিধানই সংবিধানের প্রাধান্যের নিশ্চয়তা রক্ষা করেছে। যেহেতু সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন, সেহেতু সংবিধানে যে ভাষার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, তা অবশ্যই সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। বাংলা ভাষার এই নিশ্চয়তা কার্যকর করা হয়েছে ১৫৩ অনুচ্ছেদে। তাই বাংলাদেশের সংবিধান বাংলা ভাষায় প্রণীত হলেও ইংরেজীতে অনূদিত একটি নির্ভরযোগ্য অনুমোদিত পাঠেরও বিধান আছে। অবশ্য বাংলা ভাষায় রচিত পাঠটি থেকে ইংরেজী পাঠটি প্রাধান্য পায়নি। ১৫৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বাংলায় এই সংবিধানের একটি নির্ভরযোগ্য পাঠ ও ইংরেজীতে অনূদিত একটি নির্ভরযোগ্য অনুমোদিত পাঠ থাকবে, তবে শর্ত থাকে যে বাংলা ও ইংরেজী পাঠের মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাবে।’ জানা গেছে, সাংবিধানিক বিধানাবলি পূর্ণরূপে কার্যকর করে বাংলাদেশের অফিস-আদালতে বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইনও প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের ৪ ধারায় আইনটি কার্যকর করার জন্য সরকারের ক্ষমতা সম্পর্কে উল্লেখ আছে। কিন্তু সরকার এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো বিধি প্রণয়ন করেনি, যা বাংলা ভাষা ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে। আইনের এসব সীমাবদ্ধতার কারণে আইনটি যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। এ আইনের ১৯৮৭ সালের আইনটির ২ ও ৩ (১) ধারায় বলা আছে, কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন, তাহলে তা বেআইনী ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে। ৩ ধারায় বলা আছে, কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী এ আইন অমান্য করলে তা সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপীল বিধির অধীনে অসদাচরণ বলে গণ্য হবে এবং তার বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। অসদাচরণের সর্বোচ্চ শাস্তি চাকরিচ্যুতি। দেওয়ানি কার্যবিধির একটি ধারা ॥ আদালতে ভাষার ব্যবহার চলছে যথেচ্ছভাবে। উচ্চ আদালতে ইংরেজীর ব্যবহার বলা যায় বাধ্যতামূলক। তবে নিম্ন আদালতে ইচ্ছেমতো বাংলা-ইংরেজী ব্যবহৃত হয়। আইনজ্ঞদের মতে, দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭ ধারা সংশোধন না হওয়ায় উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। বেশ কিছু দেওয়ানি বিষয়ের আবেদনপত্র নিষ্পত্তি করতে গিয়ে ১৯৯১ সালের ৮ নবেম্বর হাইকোর্ট একটি রায় দেন। ওই রায়ে বলা হয়, দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭ ধারার ১ উপধারা মতে, আদালতে ইংরেজীর ব্যবহার- যথা রায়, আরজি, সওয়াল-জবাব ইত্যাদি লেখা হলে তা বেআইনী হবে না। কাজেই বাংলা ভাষা প্রচলন আইন প্রণীত হওয়ার আগে আদালতে যেমন ইংরেজী ভাষায় আরজি, সওয়াল-জবাব, দরখাস্ত, রায় লেখা হতো, তেমনটি চলতে পারে। ভাষার ব্যবহারের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে ওই রায়ে বলা হয়, ভাষার তিনটি ব্যবহার। এগুলো হচ্ছে- রাষ্ট্রভাষা, সরকারের ভাষা ও আদালতের ভাষা। রাষ্ট্রভাষার অর্থ, যে ভাষা রাষ্ট্রের সব কাজে ব্যবহৃত হয়। সরকারের ভাষা হলো, নির্বাহী কার্যক্রমে ব্যবহৃত ভাষা ও আদালতের ভাষা বিচারিক কার্যক্রমে ব্যবহৃত ভাষা। হাইকোর্টের এ রায়ের পর আর নিম্ন আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলত করা হয়নি। আইনজ্ঞদের মতে, আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারে দেওয়ানি কার্যবিধি সংশোধন করা যেমন জরুরী। তেমনি উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারে নতুন আইন প্রণয়ন করা দরকার। উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় ও বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ॥ ১৯৮৯ সালের দিকে উচ্চ আদালতে ইংরেজীতে রায় লেখার প্রথা ভেঙে সর্বপ্রথম বাংলায় রায় দেন বিচারপতি আমীরুল ইসলাম চৌধুরী। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, বিচারপতি হামিদুল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানও বাংলা ভাষায় রায় প্রদান করেছেন। সর্বশেষ সাবেক প্রধান বিচারপতি (বর্তমানে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান) এ বি এম খায়রুল হকও বাংলায় রায় দেন। তিনি ২০০৭ সাল থেকে অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় ২০০ রায় বাংলা ভাষায় দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল, স্বাধীনতার ঘোষণাসংক্রান্ত, স্বাধীনতাযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ, স্থানীয় নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নেয়া সংক্রান্ত ও প্রতিবছরের ডিসেম্বর মাসে নিম্ন আদালতে অবকাশ চলাকালীন প্রতি আদালতে একজন করে বিচারক বিচারকাজ পরিচালনাসংক্রান্ত রায়সহ প্রায় ২০০ রায় বাংলা ভাষায় দেন বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। এ বিষয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বলেন, আমি বিচারপতি হওয়ার পর বাংলা ভাষায় রায় প্রদান করার চিন্তাভাবনা করি। কারণ আমার কাছে মনে হয়েছে, আদালতে যে ভাষায় সাধারণত রায় দেয়া হয় তা বেশিরভাগ জনগণ বোঝে না। জনগণের স্বার্থে ও প্রয়োজেনে এই সুপ্রীমকোর্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই জনগণের বড় অংশ এ রায় বুঝতে না পারলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। তিনি বলেন, এই চিন্তাটাই আমার মাথায় বারবার ঘুরতে থাকে। কিন্তু বাংলায় রায় লেখার সাহস পাচ্ছিলাম না। ২০০৭ সালের জানুয়ারির শেষদিকে বা ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে একটি জাতীয় দৈনিকে মরহুম বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের লেখা আদালতে বাংলা ভাষার ওপর তিনটি অর্টিকেল আমি মনোযোগসহ পড়ি। ওই তিনটি আর্টিকেলই আমার চিন্তাধারা বাস্তবায়নে সাহস জোগায়। আমি মনস্থির করি তখন থেকেই বাংলা ভাষায় রায় প্রদানের। সে সূত্রেই ২০০৭ সাল থেকে আমি প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় দুশ’ রায় বাংলা ভাষায় প্রদান করি।
×