ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিবিএস জরিপ ॥ এসব মানুষের জন্য আসছে দেড় শ’ কোটি টাকার প্রকল্প

খোলা আকাশের নিচে মলত্যাগ ৩৩ লাখের

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২৯ জানুয়ারি ২০১৬

খোলা আকাশের নিচে মলত্যাগ ৩৩ লাখের

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ এখনও খোলা আকাশের নিচে মল ত্যাগ করে ২ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ। বর্তমানে ১৬ কোটি মানুষ ধরলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৩৩ লাখে। তবে এ হার কমে আসছে। কেননা ২০১০ সালে এ হার ছিল দুই দশমিক দুই শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৪ সালের জরিপে উঠে এসেছে এ চিত্র। অন্যদিকে ২০১৩ সালে পরিচালিত জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগ্রামের (জেএমপি) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী এ হার চার শতাংশ। উন্মুক্ত স্থানে মল ত্যাগ করা হয় সাধারণত পার্বত্য অঞ্চল, চরাঞ্চল, হাওড়-বাঁওড় এবং ক্রমবর্ধমান শহরতলির বস্তিগুলোতে। এসব দুর্গম ও অবহেলিত অঞ্চলের মানুষের জন্য স্যানিটেশন সুবিধা পৌঁছে দিতে ১৪৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিচ্ছে সরকার। দেশের ৬৪ জেলায় জাতীয় স্যানিটেশন (তৃতীয় পর্যায়) নামের এ প্রকল্পটি ২০১৯ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর (ডিপিএইচই)। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য এসএম গোলাম ফারুক পরিকল্পনা কমিশনের মতামত দিতে গিয়ে বলেন, এ উদ্যোগটি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দুর্গম এলাকা হিসেবে চিহ্নিত জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নত ও স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন স্থাপন, হাওড়-বাঁওড়, উপকূলীয়, বন্যাপ্রবণ এবং পাহাড়ী এলাকায় টেকসই স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের সহায়তায় কমিউনিটি ল্যাট্রিন স্থাপনের মাধ্যমে কমিউনিটির সাধারণ জনগণের জন্য স্যানিটেশন সুবিধা তৈরি, সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য বিধি পালনের অভ্যাস গড়ে তোলা এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা হবে। এসব বিবেচনায় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) প্রকল্পটির অনুমোদন বিবেচনাযোগ্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মনিটরিং দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস অব বাংলাদেশ শীর্ষক প্রকল্পের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে উন্মুক্ত স্থানে মল ত্যাগ করে দুই দশমিক এক শতাংশ মানুষ। ২০১৩ সালে এ হার ছিল দুই দশমিক দুই শতাংশ, ২০১২ সালে ছিল দুই দশমিক ছয় শতাংশ, ২০১১ সালে ছিল দুই দশমিক সাত শতাংশ এবং ২০১০ সালে ছিল দুই দশমিক দুই শতাংশ। এ বিষয়ে প্রকল্পটির পরিচালক বলেন, এ প্রকল্পটির কার্যক্রম বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর একটি নিয়মিত ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ১৯৮০ সাল হতে আন্তঃশুমারি সময়ের জনতাত্ত্বিক তথ্য সংগ্রহের জন্য এ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এ কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে শুমারি মধ্যবর্তী বছরগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির উপাদানসমূহ যথা-জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, আগমন, বহির্গমন এবং আর্থ-সামাজিক তথ্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ এবং নিয়মিতভাবে প্রকাশের মাধ্যমে পরিকল্পনাবিদ ও নীতিনির্ধারকগণকে সুষ্ঠু ও তথ্যভিত্তিক জনসংখ্যা পরিকল্পনায় সহায়তা করা। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা মানুষের মৌলিক প্রয়োজন। অপর্যাপ্ত পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে পানিবাহিত ও মলবাহিত রোগ, সংক্রামক রোগ, স্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং পরিবেশ দূষণের সঙ্গে জড়িত। ইউএনডিপি পরিচালিত এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, উন্নত স্যানিটেশনের ক্ষেত্রে ১৯৯০-৯১ সালে এ খাতে অর্জন ৩৯ শতাংশ, যা বর্তমানে ৬২ দশমিক ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সরকারের এই অর্জন ধরে রাখার জন্য এ খাতে বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। বলা হয়েছে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও বর্তমান স্যানিটেশন কভারেজ অর্জন সারা বিশ্বে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে স্যানিটেশন আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। ২০০৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম স্যাকোসান সম্মেলনের মাধ্যমে স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়নে সরকার, এনজিও, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাসহ সাধারণ মানুষদের অন্তর্ভুক্তি করা হয়। তারপর থেকেই স্যানিটশন কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আসে। কিন্তু বলা হচ্ছে স্যানিটেশন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনই যথেষ্ট নয়। এর সুফল পাওয়ার জন্য টেকসই হওয়া প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে বাংলাদেশ অতি ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। ইতোমধ্যেই বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড়ের কারণে দেশে বেশকিছু ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় স্যানিটেশন ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে পানিতে ভেসে যাওয়ায় ওই সব এলাকার স্যানিটেশন কভারেজ কমে গেছে। তা ছাড়া অন-সাইড স্যানিটেশন ব্যবস্থার সেপটিক সøাজের যথাযথ অপসারণ ব্যবস্থা না থাকায় বাংলাদেশের স্যানিটেশন ব্যবস্থাও মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে দেশের জনসাধারণের টেকসই স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য জাতীয় স্যানিটেশন প্রকল্প (তৃতীয় পর্যায় ) প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। প্রকল্পের আওতায় প্রধান কার্যক্রম হচ্ছে স্বল্পমূল্যে দেড় লাখ স্যানিটারি ল্যাট্রিন সরবরাহ, দুর্গম এলাকার হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ৪৩ হাজার ৬৫০ উন্নত ল্যাট্রিন স্থাপন, গ্রোথ সেন্টার, বাজার, পৌরসভা বা শহরের বস্তিতে ৯৭০টি কমিউনিটি টয়লেট স্থাপন, বিভিন্ন জেলায় ৫০টি পাবলিক টয়লেট স্থাপন এবং সারাদেশে ৬০টি ইকো-স্যান টয়লেট স্থাপন করা হবে। অন্যদিকে পরিসংখ্যান ব্যুরোর এমএসভিএসবি প্রকল্পে বলা হয়েছে, স্যানিটারি পায়খানা ব্যবহারের হার ২০১৪ সালে বেড়েছে। এ সময় ব্যবহার কারী বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৩ দশমিক পাঁচ শতাংশে, যা ২০১৩ সালে ছিল ৬৩ দশমিক তিন শতাংশ এবং অন্যান্য স্থান ব্যবহার করে ৩৪ দশমিক চার শতাংশ মানুষ, যা ২০১৩ সালে ছিল ৩৪ দশমিক পাঁচ শতাংশ। পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব কানিজ ফাতেমা জনকণ্ঠকে বলেন, স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় মানুষের স্বাস্থ্য খাতে উন্নতি হয়েছে। এটি গড় আয়ু বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। তিনি জানান, গড় আয়ু ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগতির চিত্র উঠে এসেছে এমএসভিএসবি প্রতিবেদনে। এগুলো হচ্ছে বিদ্যুতের ব্যবহার, টয়লেট সুবিধা, নির্ভরশীলতার অনুপাত, শিক্ষার হার, শিশু মৃত্যুর হার, মাতৃমৃত্যুর হার, জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার এবং স্থূল প্রতিবন্ধিতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে। তিনি বলেন, দারিদ্র্য বিমোচনসহ গুরুত্বপূর্ণ আর্থ-সামাজিক অর্জনের ক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায় প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আমরা নিম্ন আয়ের থেকে এখন নিম্ন-মধ্য আয়ে উন্নীত হয়েছি। এরপর মধ্য আয় এবং উন্নত দেশে যাব। এ জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। সেসব কার্যক্রমের অর্জিত ফল বিবিএসের এই প্রকল্পের মাধ্যমে উঠে আসে। এভাবে সঠিক চিত্র পেলে সরকারের পক্ষে সমন্বিত পরিকল্পনা করা সহজ হবে। এ প্রকল্পটি আগামীতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) মূল্যায়নসহ গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক মূল্যায়নে ভূমিকা রাখছে।
×