ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

এরশাদ-রওশন দুজনই প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতপ্রার্থী

জাপায় ক্ষমতার লড়াই তুঙ্গে, এপ্রিলেই কাউন্সিলের প্রস্তুতি

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৪ জানুয়ারি ২০১৬

জাপায় ক্ষমতার লড়াই তুঙ্গে, এপ্রিলেই কাউন্সিলের প্রস্তুতি

রাজন ভট্টাচার্য ॥ দল দখলের লড়াই থামেনি জাতীয় পার্টিতে। নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার চেষ্টা এখনও অব্যাহত। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে চাপ সৃষ্টি করে দলের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছেন বিরোধী নেতা রওশন। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাত চেয়েছেন তিনি। অপরদিকে এরশাদও ক্ষমতা ধরে রাখতে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাত চান। অর্থাৎ নতুন করে দল ভাঙ্গনের বিষয়টি নির্ভর করছে ক্ষমতাসীন দলের ওপর। বসে নেই সদ্য পদচ্যুত মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলুও। দলের চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতাবলে মহাসচিবের পদ থেকে তাকে বাদ দেয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে রিট আবেদন করার প্রস্তুতি নিয়েছেন তিনি। জাপা সূত্র জানায়, দল ও নিজের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদ ও মন্ত্রিপরিষদ থেকে এখনই পদত্যাগ করছে না জাপা। তবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে এসব বিষয় আলোচনা করবেন পার্টিপ্রধান। পাশাপাশি সারাদেশে সাংগঠনিক কার্যক্রম চাঙ্গা করতে ছোট ভাইকে নিয়ে জেলায় জেলায় সফরে বের হবেন এরশাদ। আগামী এপ্রিলে কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের আগেই ৬৪ জেলায় সম্মেলনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী দেয়ারও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে বিরোধী দল। শনিবার এক অনুষ্ঠানে জাপা চেয়ারম্যান এরশাদ বলেছেন, বিশেষ দূতের পদ থেকে পদত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রীকে অসম্মানিত করতে পারি না। গত রবিবার রংপুরে দলের কো-চেয়ারম্যান হিসেবে ভাই জিএম কাদেরের নাম ঘোষণা করেন সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ। আগামী এপ্রিলে দলের জাতীয় কাউন্সিলের জন্য ভাই জিএম কাদের ও রুহুল আমিন হাওলাদারকে দায়িত্ব দেন। এরশাদের এ সিদ্ধান্ত সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন রওশন। পরদিন সোমবার দিনভর অনুসারীদের নিয়ে বৈঠক করেন তিনি। রাতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে রওশনের নাম ঘোষণা করেন মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু। এতে আরও ক্ষিপ্ত হন সাবেক সেনাপ্রধান এরশাদ। মঙ্গলবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতাবলে বাবলুকে মহাসচিবের পদ থেকে বাদ দেয়া হয়। তাঁর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও দায়িত্বে ব্যর্থতার অভিযোগ এনে অব্যাহতি দেন এরশাদ। একই দিন বিকেলে পার্টির সংসদীয় দলের বৈঠকে রওশনপন্থীরা এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান এরশাদের কাছে। যদিও দলের চীফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী এ নিয়ে দু’ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। এর মধ্যেই দলে ভাঙ্গনের সুর ওঠে। জাপার সাংগঠনিক অবস্থা যখন বেহাল তখন আরেক দফা ভাঙ্গনের মুখে পড়লে অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ার বিষয়টি আঁচ করতে পারেন এরশাদ। এ জন্য রওশনকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু জাপার প্রভাবশালী দুই নেতা রওশনের পক্ষে এ নিয়ে আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গে কয়েক দফা কথা বলেন। এরশাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে সব সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের প্রস্তাব দেয়া হয় তাদের। এদিকে এরশাদও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত চেয়েছেন। দলীয় সূত্রগুলো বলছে, এই মুহূর্তে বিরোধী দলের কর্মকা- পর্যবেক্ষণে রেখেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। জাপা নেতারা জানিয়েছেন, রওশন বিরোধী দল নেতা হলেও মাঠের সমর্থন এরশাদের দিকে। এমপিরা ছাড়া রওশনের সঙ্গে আর কেউ নেই। আগামী নির্বাচনে এরশাদের প্রয়োজন হবে। তাই নতুন করে দলে ভাঙ্গন সৃষ্টি হলে মূলত ক্ষমতাসীন দলেরই ক্ষতি হবে। দলের অবস্থা বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে এরশাদ বলেন, অতীত কর্মকা-ের জন্য বিএনপিকে মানুষ পছন্দ করে না। আমাদেরও মানুষ বলে, জাতীয় পার্টি সরকারে আছে। ফলে তারা বলেন লাঙ্গলে কেন, নৌকা মার্কাতেই ভোট দেব। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা বিএনপির বিকল্প হিসেবে একটা সত্যিকার বিরোধী দল হিসেবে দাঁড়াতে চাই। তবে সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে আসতে সময়ের প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এরশাদ বলেন, আমাকে সম্মান দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বিশেষ দূত করেছেন। ওনার সঙ্গে আমার কথা বলতে হবে। উনি যদি রাজি হন, তাহলে আমি বেরিয়ে আসব। আর আমি বেরিয়ে এলে তখন আমার দলের মন্ত্রীদেরও বেরিয়ে আসতে বলতে পারব। আশা করি, এটা হবে। তবে এখনই নয়। সময় লাগবে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়া প্রশ্নে তখন এরশাদ তার বক্তব্য বার বার পরিবর্তন করায় জাতীয় পার্টির বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়ে। সেই নির্বাচনে গঠিত সংসদে জাতীয় পার্টি বিরোধী দলের আসনে বসলেও দলটির তিন নেতা মন্ত্রিসভায় রয়েছেন। এরশাদ নিজেও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে আছেন। তিনি যখন সরকার থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলছেন, তখনই দলের ভেতরে বিদ্রোহের মুখে পড়েছেন তিনি। মূলত ক্ষমতা ধরে রাখা না রাখার প্রশ্নে উভয় পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে উঠেছে। ৪০ সংসদ সদস্য নিয়ে বিরোধী দলে জাপা। এর মধ্যে অনেকেই প্রথমবারের মতো এমপি হয়েছেন। সংসদ থেকে পদত্যাগ না করা ও ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে এমপিরা চাপ দিচ্ছেন রওশনকে। রওশনও বিরোধী দলের নেতার পদ ছাড়তে মোটেও সম্মত নন। বিগত দুই বছরে মহাসচিব বাবলু এমটি বর্ধিত সভা ও প্রেসিডিয়ামের বৈঠক ডাকেননি। এ কারণে ক্ষুব্ধ এরশাদ নিজেও। উপজেলা নির্বাচন থেকে শুরু করে সর্বশেষ পৌর নির্বাচনের জাপা প্রার্থীদের ভরাডুবি হয়েছে। দেশের অর্ধেক জেলাতেও সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই। সময় পেরিয়ে গেলেও দলের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সম্ভব হচ্ছে না। দুই বছরের বেশি সময়ে সব জেলায় সম্মেলন করাও সম্ভব হয়নি। তাই জাতীয় পার্টিকে তৃণমূল পর্যায়ে চাঙ্গা করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। দ্রুতই সাংগঠনিক সফরে বের হবেন এরশাদ-জিএম কাদেরসহ নতুন মহাসচিব। তাছাড়া চলতি মাসের শেষ দিকে দলের বর্ধিত সভার আয়োজন করা হচ্ছে। দলীয় সূত্রগুলো বলছে, জাতীয় পার্টির আরেক দফা ভাঙ্গন নির্ভর করছে সরকারের ওপর। অভ্যন্তরীণ কোন্দল বাড়লেও সরকার না চাইলে দল ভাঙ্গার আশঙ্কা নেই। জাপার সার্বিক বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের জনকণ্ঠকে বলেন, আমার প্রথম কাজ হবে জাতীয় পার্টিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া। এ জন্য সবাইকে ডেকে কথা বলব। মতামত নেব। দলের সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও করণীয় ঠিক করা হবে। আমরা কোন্ পথে রাজনৈতিকভাবে অগ্রসর হব তা চূড়ান্ত করা হচ্ছে দ্রুতই। তাছাড়া সবার ভাষা হবে এক। দ্বিধাবিভক্তি থাকবে না। এ জন্য অনৈক্য দূর করতে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাব। বেশিরভাগ নেতার মতামত সবাই মেনে নেবে এমন রেওয়াজ চালু করতে চাই। মন্ত্রীদের পদত্যাগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিরোধী দলের নেতা ও আমাদের চেয়ারম্যান দু’জনের বলেছেন সরকারের মন্ত্রিপরিষদে আমাদের অংশগ্রহণ থাকায় জাতীয় পার্টির পরিচিতি সমস্যা হচ্ছে। জনমনে বিভ্রান্তি হচ্ছে। নেতাকর্মীরা আমাদের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেই এসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা জানান তিনি। সারাদেশে সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথাও জানান তিনি। নতুন দায়িত্ব গ্রহণের পর জবাবদিহিতা বেড়েছে এ কথা উল্লেখ করে পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার জনকণ্ঠকে বলেন, জাতীয় পার্টিকে এগিয়ে নিতে সকলের প্রত্যাশা অনেক বেশি। এ জন্য সবার সহযোগিতা চেয়ে তিনি বলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে পার্টির বর্ধিত যৌথ সভার আয়োজন করা হবে। জেলা কাউন্সিল শেষ করার পর এপ্রিলে কেন্দ্রীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে। দলের মধ্যে মতবিরোধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চলার পথে ছোটখাট দুর্ঘটনা হয়েই থাকে। এটা দায়িত্ব পালনের কোন প্রভাব ফেলবে না বলেও মনে করেন তিনি। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জাপা প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আব্দুস সবুর আসুদ জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা চাই সকল বাঁধা অতিক্রম করে জাতীয় পার্টি শক্তিশালী হোক। মানুষের কাছে বিশ্বাস ও আস্থার জায়গা তৈরি করুক। তিনি বলেন, উপমহাদেশের সব দেশেই পারিবারিক রাজনীতির চর্চা আছে। জাতীয় পার্টিও এর বাইরে নয়। জনসমর্থনও পরিবারমুখী। আমি মনে করি এরশাদের পরিবারের মধ্যে ঐক্য থাকবে। কোন ষড়যন্ত্রেই নিজেদের মধ্যে ঐক্য নষ্ট হবে না। পার্টির রাজনীতিকে জনগণের কাছে স্পষ্ট করতে হবে- এরশাদ ॥ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা না করে ‘বিশেষ দূতের’ পদ ছাড়তে চান না জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ। তিনি বলেছেন, নিজে থেকে পদ ছেড়ে দেয়া হলে প্রধানমন্ত্রীকে অসম্মানিত করা হবে। তিনি সেটি করতে পারেন না। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন। শনিবার এরশাদ তার বনানী কার্যালয়ের মিলনায়তনে নেতাকর্মীদের সঙ্গে এক অনির্ধারিত সভায় এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, জাতীয় পার্টির রাজনীতিকে জনগণের কাছে স্পষ্ট করতে হবে। আমরা এদেশে ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী জাতীয়তাবাদী শক্তি। স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ সব জাতীয়তাবাদী শক্তিকে জাতীয় পার্টির পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের, পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, এমএ সাত্তার, গোলাম হাবিব দুলাল, গোলাম কিবরিয়া টিপু, আলহাজ সাহিদুর রহমান টেপা, এ্যাডভোকেট শেখ মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, মাসুদ পারভেজ (সোহেল রানা), হাবিবুর রহমান, সুনীল শুভরায়, এস এম ফয়সল চিশতী, মীর আব্দুস সবুর আসুদ, হাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন প্রমুখ। এরশাদ বলেন, দলের প্রয়োজনেই আমি কো-চেয়ারম্যান নিয়োগ এবং মহাসচিব পদে পরিবর্তন এনেছি। এই পরিবর্তনে সারাদেশে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। দল আবার জেগে উঠেছে। আমরা পার্টিকে এবার আরও সুসংগঠিত করতে পারব। আমরা অবশ্যই এই সংসদের বিরোধী দল। আশা করি, আমাদের সংসদ সদস্যরা সংসদে এমন কোন বক্তব্য রাখবেন না যাতে করে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার বিশেষ দূত করে আমাকে সম্মানিত করেছেন। তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে এই পথ ছেড়ে দিয়ে তাকে অসম্মানিত করতে পারি না। অবশ্যই এ বিষয়ে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করব। জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী করা হলে সংসদ আরও কার্যকর হবে এবং সরকারও লাভবান হবে।
×