ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচজনকে একাই হত্যার কথা আদালতে স্বীকার করল মাহফুজ

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২২ জানুয়ারি ২০১৬

পাঁচজনকে একাই হত্যার কথা আদালতে স্বীকার করল মাহফুজ

মোঃ খলিলুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ থেকে ॥ অবশেষে নারায়ণগঞ্জ শহরের দুই নং বাবুরাইল এলাকায় আলোচিত মা, মেয়ে, ছেলেসহ পাঁচজনকে খুনের রহস্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। পাঁচ খুনের ঘটনায় হত্যার দায় স্বীকার করে ও হত্যাকা-ের লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়ে আদালতে নিহত তাসলিমার স্বামী ও এ মামলার বাদী শফিকুল ইসলামের ভাগ্নে মাহফুজ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সাইদুজ্জামান শরীফের আদালতে এই স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দী প্রদান করে মাহফুজ। এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুর সোয়া ১টার দিকে প্রেস ব্রিফিংয়ে পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন জানিয়েছেন, ছোট মামির প্রতি আসক্তি থেকে গত শুক্রবার মাহফুজ একে একে বড় মামি তাসলিমা (৩০) ও ছোট মেয়ে সুমাইয়া (৫), তার খালাত ভাই মোশারফ হোসেন ওরফে মোর্শেদ (২২) ও ছোট মামি লামিয়াকে (২২) পুতো দিয়ে মাথায় আঘাত করে এবং মামাত ভাই শিশু আব্দুর রহমান ওরফে শান্তর (১০) মাথা দেয়ালে আঘাত করে এবং গলাটিপে একাই হত্যা করেছে। মামির সঙ্গে ভাগ্নের অনৈতিক আসক্তির কারণে পারিবারিক সালিশে জুতাপেটা হওয়ার কারণেই এই হত্যাকা-ের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। মাহফুজের স্বীকারোক্তির বিষয়ে আদালত, পুলিশ ও আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে, গত শুক্রবার (১৫ জানুয়ারি) নিহত তাসলিমার স্বামী মামলার বাদী শফিকুল ইসলামের ভাগ্নে মাহফুজ (২১) নিশ্চিত হয় ওই দিন রাতে তার দুই মামা বাড়িতে থাকবে না। বড় মামা শফিকুল ইসলাম ঢাকায় এবং ছোট মামা শরীফুল ইসলাম ময়মনসিংহের নান্দাইলে একটি কাজে যাবে। এই সুযোগে সে ছোট মামির সঙ্গে রাতে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করবে- এমন মনোভাব পোষণ করে শুক্রবার সন্ধ্যায় মামাদের বাড়িতে যায়। গিয়ে দরজা নক করে এবং এ সময় দরজা খুলে দেয় মামাত ভাই শিশু শান্ত। সে শান্তকে সঙ্গে নিয়ে ছোট মামি লামিয়ার ঘরে অবস্থান নেয় এবং সে যে ঘরে ঢুকেছে সেটা না বলতে শান্তকে ১০ টাকা দেয়। পরে মাহফুজ লামিয়ার ঘরে খাটের নিচে লুকায়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে তাসলিমার খালাত ভাই মোশারফ ওরফে মোর্শেদ বাড়িতে আসে এবং তাসলিমারা যে রুমে বসে টেলিভিশন দেখছিল সেই রুমে ঢুকে তাদের সঙ্গে বসে টেলিভিশন দেখে। ওই রুমেই তারা রাতের খাওয়া-দাওয়া করেঅ এই দৃশ্য সে খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে দরজার আড়ালে দাড়িয়ে দেখে। পরে খাওয়া-দাওয়া শেষে রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত তারা আবার টেলিভিশন দেখে। টেলিভিশন দেখার এক পর্যায়ে লামিয়া তার জা তাসলিমার রুমেই ঘুমিয়ে পড়ে। লামিয়া ওই রুমে ঘুমিয়ে পড়ার কারণে মোশারফ লামিয়ার রুমে ঘুমাতে যায়। এ সময় লামিয়ার রুমে তাসলিমা বিছানা করে দেয়- এই দৃশ্য তাদের পা দেখে সে বুঝতে পারে। পরবর্তীতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে হিন্দী সিনেমা দেখছিল মোশারফ। এভাবে রাত আড়াইটা পর্যন্ত সে সিনেমা দেখে। একপর্যায়ে খুনী মাহফুজের প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিলে খাটের নিচ থেকে বেরোনোর সময় মাথা খাটের সঙ্গে লেগে শব্দ হয়। পরে মোশারফ খাটের নিচে দেখতে পেয়ে তাকে বের করে আনে। পরে তাকে বকাঝকা করে তাসলিমাকে বিষয়টি জানায়। পরবর্তীতে রাত গভীর হওয়ার কারণে মোশারফ তাকে ঘর থেকে বের করে না দিয়ে একই খাটে তার সঙ্গে থাকতে দেন। পরবর্তীতে মোশারফ ঘুমিয়ে পড়লে মাহফুজ শোয়া থেকে উঠে হাঁটাহাঁটি করতে থাকে এবং সিগারেট নিয়ে বাথরুমে যায় ও সেখানে সিগারেট খায়। পরবর্তীতে সে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর রান্নাঘরে যায়। রাত সাড়ে তিনটার দিকে সেখান থেকে শিলপাটার পুতো নিয়ে এসে মোশারফের সঙ্গে শুয়ে পড়ে। তখন মোশারফ ঘুমে বিভোর ছিল। পরে সে শোয়া থেকে উঠে মোশারফের পাশে বসে পুতো দিয়ে মোশারফের মাথায় আঘাত করে। এ সময় মোশারফ চিৎকার দিয়ে উঠলে বিছানার পাশে থাকা মোশারফের শার্ট দিয়ে গলার মধ্যে পেঁচিয়ে ধরে। পরে মোশারফের দেহ নিস্তেজ হয়ে মৃত্যু নিশ্চিত হলে তাকে ছেড়ে দেয়। তখন মাহফুজ লাশের পাশে বসেছিল। ওই রুমের মধ্যে আবারও সে হাঁটাহাঁটি করতে থাকে। তখন মাথা গরম হয়ে গেলে রান্নাঘর থেকে তেলের বোতল নিয়ে এসে মাথায় দেয়। মাথায় তেল দেয়ার পর সে বুঝতে পারে এটি সয়াবিন তেল এবং তা বিছানায় পড়ে যায়। এ সময় ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে তেলের মধ্যে দিয়ে আগুন ধরানোর চেষ্টা করে এবং আগুন ধরে যায়। পরে সকাল সাড়ে ৬টার দিকে বড় মামি তাসলিমার মোবাইল ফোনে এ্যালার্ম বেজে ওঠে। তখন মামি শিশু শান্তকে স্কুলে পাঠানোর জন্য ডেকে রেডি করে এবং স্কুলে পাঠায়। এই দৃশ্য সে (মাহফুজ) দরজার আড়াল থেকে দেখে। শান্তকে স্কুলে পাঠিয়ে মামি তাসলিমা আবার শুয়ে পড়েন। পুলিশ আরও জানায়, সেই পরিকল্পনা মোতাবেক মামি তাসলিমাকে ডেকে বলে, মোশারফ মামা আপনাকে ডাকছে। মামি তাসলিমা ঘুম চোখে মোশারফের ঘরের দরজার সামনে এসে মোশারফ মোশারফ বলে ডাকতে থাকেন। এ সময় দরজার আড়াল থেকেই পুতো দিয়ে মামি তাসলিমার মাথায় সজোরে আঘাত করে। মামি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে মোশারফের রুমে থাকা একটি কাপড়ের টুকরা এনে তাসলিমার গলায় পেঁচিয়ে ধরে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। পরে সে লামিয়ার উদ্দেশ্যে তাসলিমার ঘরে যায়। এ সময় সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে পায় লামিয়া বিছানায় নড়াচড়া করছেন। লামিয়ার চোখ তার ওপর পড়তেই বিছানার ওপর দাঁড়িয়ে যায়। এ সময় লামিয়াকে উদ্দেশ্য করে পুতো ছুড়ে মারলে তার মাথায় আঘাত লাগে। এ সময় মাহফুজ জামা-কাপড় শুকানোর জন্য টানানো একটি দড়িজাতীয় কিছু টেনে নেয়ার চেষ্টা করলে লামিয়া তাকে ছুড়ে মারা পুতো পাল্টা মাহফুজের দিকে ছুড়ে মারার চেষ্টা করলে পুতো হাত থেকে সুমাইয়ার মাথায় গিয়ে পড়ে। এ সময় সুমাইয়া চিৎকার শুরু করে। পরে মাহফুজ আবার পুতো নিয়ে লামিয়ার মাথায় সজোরে আঘাত করলে লামিয়া খাটের ওপর পড়ে যায়। তখন লামিয়ার গলার ওপর পা দিয়ে চেপে ধরলে সে মারা যায়। পরে সে ওই রশি দিয়ে সুমাইয়ার গলায় পেঁচ দিয়ে ধরলে সুমাইয়া মারা যায়। সকাল সোয়া ৭টার দিকে শান্ত স্কুল থেকে ফেরত এসে দরজায় নক করতে থাকে। এদের হত্যাকা-ের পর সে তাসলিমার রুম থেকে বেরিয়ে এসে দরজা খোলার জন্য আসার সময় তাসলিমার লাশ দু’পা ধরে টেনে মোশারফের রুমে নিয়ে যায়। ঘরের মেঝেতে থাকা রক্ত মোশারফের ঘর থেকে একটি সাদা রঙ্গের কাপড় এনে ঢেকে দেয়। পরে দরজা খুলে শান্তকে ভেতরে নেয়। এ সময় শান্ত তাসলিমার ঘরে ঢুকলে সেও পেছনে পেছনে যায়। পরে শান্ত তার মা তাসলিমাকে খোঁজার চেষ্টা করলে মাহফুজ পেছন থেকে ঘাড় ধরে ধাক্কা দিলে দেয়ালে মাথায় আঘাত লেগে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। পরে কাপড়ের টুকরাজাতীয় কাপড় দিয়ে গলা পেঁচিয়ে তার হত্যা নিশ্চিত করে। পরে সে বাথরুমে গিয়ে পুতোয় লেগে থাকা রক্ত বালতির পানিতে ধুইয়ে আবার রান্নাঘরে পুতো পাটার ওপর রেখে আসে। পরে সে আবার বাথরুমে গিয়ে তার গায়ে লেগে থাকা রক্ত ও হাতমুখ ধুয়ে ঘরে এসে শুকনা কাপড় দিয়ে হাত-পা মোছে। পরে টেলিভিশনের পাশে রাখা তালা নিয়ে দরজা তালাবদ্ধ করে চাবিটি রিজার্ভ ট্যাঙ্কির পাশে ছুড়ে ফেলে দেয়। পরে সে মোশারফের কারখানায় গিয়ে গোসল করে বেরিয়ে যায়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আবুল খায়ের জানান, গাজীপুরের টঙ্গীর বোর্ডবাজার এলাকায় শফিকুল ও শরীফের পরিবার থাকত। মামার বাসায় বেড়াতে গিয়ে ছোট মামি লামিয়ার প্রতি আসক্ত হয় মাহফুজ। বিষয়টি জানাজানি হলে একপর্যায়ে দুই মামা পরিবার নিয়ে ঢাকার কলাবাগানে চলে আসেন। কলাবাগানে মাহফুজের বড় মামি তাসলিমা বেগম বিভিন্নজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ১৫-২০ লাখ টাকা ঋণগ্রহণ করেন। ঋণের টাকা শোধ করতে না পেরে পাওনাদারদের চাপের মুখে বছরখানেক আগে তারা নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন। প্রথমে তারা নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় এবং সর্বশেষ শহরের দুই নং বাবুরাইল এলাকায় আমেরিকান প্রবাসী ইসমাইল হোসেনের ছয়তলা বাড়ির নিচতলা ভাড়া নেন। এই বাসায় তারা আসার পর মাহফুজ বড় মামি তাসলিমার খালাত ভাই নিহত মোশারফ হোসেন ওরফে মোর্শেদের কারখানায় কাজ নেয় এবং ওই কারখানায় রাতে ঘুমাত। কারখানার পাশেই বাসা হওয়ার সুবাদে মাহফুজ প্রায়ই ওই বাসায় যাতায়াত করত। ছোট মামি লামিয়ার প্রতি অনৈতিক আসক্তির কারণে হত্যাকা-ের প্রায় দুই সপ্তাহ আগে পারিবারিক সালিশে মাহফুজকে জুতাপেটা করা হয়। এতে মাহফুজ ক্ষিপ্ত হয় এবং প্রতিশোধ না নেয়া পর্যন্ত ভাত খায়নি। গত দুই সপ্তাহ যাবত সে বিস্কুট, রুটি কলা খেয়ে থাকত। অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর কেএম ফজলুর রহমান জানান, গ্রেফতারকৃত মাহফুজ নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সাইদুজ্জামান শরীফের আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে এবং হত্যাকা-ের বর্ণনা দিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। চিকিৎসকের ময়নাতদন্তেও বলা হয়েছে, ভারি কোন বস্তু দিয়ে আঘাত করে তাদের হত্যা করা হয়েছে। আসামি তার জবানবন্দীতে পরকীয়া ও আর্থিক লেনদেনের কারণে এই হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে বলে স্বীকার করেছে। এদিকে দুপুর সোয়া একটায় জেলা পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন তার কার্যালয়ে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে গণমাধ্যমকে জানান, দেশব্যাপী চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী পাঁচ খুনের ঘটনা তদন্তে পুলিশের পাঁচটি টিম একটানা কাজ করে রহস্য উদ্ঘাটন করেছে। দু’জনকে গ্রেফতার ও উল্লেখ্যযোগ্যসংখ্যক মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট দ্বারা ঘটনাস্থল ও আলামত সংরক্ষণ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য একাধিকবার যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। তদন্তে ভাগ্নে মাহফুজ ১৫ তারিখ শুক্রবার মাগরিবের নামাজের আগে উক্ত বাসায় ঢুকলেও রাত তিনটা থেকে পরদিন সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত অবস্থান করে পর্যায়ক্রমে পাঁচজনকে একাই হত্যা করে। পারিবারিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব এবং সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে এই নৃশংস হত্যাকা- ঘটেছে। তবে গ্রেফতার নারী আসামি নাজমার হত্যাকা-ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। উল্লেখ্য, গত শনিবার শহরের দুই নং বাবুরাইল এলাকায় ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে দরজার তালা ভেঙ্গে দুই শিশুসহ পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ময়নাতদন্ত শেষে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তাদের শ্বাসরোধ ও মাথায় আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনায় পুলিশ নিহত তাসলিমার স্বামী শফিকুল ইসলামের ভাগ্নে মাহফুজ ও মোরশেদের খালাত ভাইকে আটক করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় আটজনকে। এদিকে পাঁচজনকে খুনের ঘটনায় নিহত তাসলিমার স্বামী শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলার অবিযোগে তিনি স্ত্রী তাসলিমার কাছে সুদের পাওনা টাকা নিয়ে আর্থিক বিরোধ ও ছোট ভাইয়ের স্ত্রী লামিয়ার প্রতি ভাগ্নে মাহফুজের যৌন আসক্তির বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। মামলাটি বর্তমানে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়েছে। এই ঘটনায় গ্রেফতারকৃত নিহত তাসলিমার স্বামী শফিকুল ইসলামের ভাগ্নে মাহফুজকে গ্রেফতার করে সাত দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।
×