ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

অভিভাবকদের আজ থেকে লাগাতার অবস্থানের হুমকি ॥ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের বিরুদ্ধেও আন্দোলন চলছে

উইলস লিটলে ভর্তি ফি বেতন ৪৩ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রমাণ

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১৭ জানুয়ারি ২০১৬

উইলস লিটলে ভর্তি ফি বেতন ৪৩ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রমাণ

বিভাষ বাড়ৈ ॥ অভিভাবকদের আন্দোলনের মধ্যেই উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এ্যান্ড কলেজে লাগামহীন বেতন-ফি বাড়ানোর প্রমাণ মিলেছে। অভিভাবকদের তোলা অভিযোগের তদন্তে নতুন পে স্কেলের অজুহাতে প্রতিষ্ঠানটিতে সকল শ্রেণীর শিক্ষার্থীর ভর্তি ফি, বেতনসহ সকল শিক্ষা ব্যয় প্রায় ৪৩ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রমাণ পেয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের তদন্ত কমিটি। এদিকে একই অজুহাত দেখিয়ে রাজধানীসহ সারাদেশে বেসরকারী স্কুল-কলেজে পাল্লা দিয়ে বাড়ানো হচ্ছে শিক্ষার্থীদের বেতন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের কোন নিয়ম-নীতিরও তোয়াক্কা করছেন না স্কুল-কলেজের কর্তাব্যক্তিরা। প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন অভিভাবকরা। গত একসপ্তাহ ধরে প্রতিদিনই চলছে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মানববন্ধন, শিক্ষামন্ত্রীকে স্মারকলিপি প্রদান, অবস্থান ধর্মঘটের মতো কর্মসূচী। গত কয়েক দিনের অনুসন্ধানে ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজ, বিয়াম স্কুল এ্যান্ড কলেজ, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এ্যান্ড কলেজ, সেন্ট জোসেফ স্কুল, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল, উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, অগ্রণী স্কুল এ্যান্ড কলেজ, জুনিয়র ল্যাবরেটরি হাই স্কুলসহ নামী-দামী সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বেতন-ফিসহ সকল শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া গেছে। অভিভাবকদের অভিযোগের তালিকায় আছে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারাদেশের আরও বহু প্রতিষ্ঠানের নাম। যেখানে পে স্কেলকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে প্রায় দ্বিগুণ পর্যন্ত বেতন ফি বাড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ তুলেছেন ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা। জানা গেছে, প্রতিবছরই শিক্ষাবর্ষের শুরুতে শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি কম-বেশি বাড়ানোর অভিযোগ ওঠে। তবে এসব অভিযোগ প্রধানত রাজধানীতে অবস্থিত নামী-দামী কিছু প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। সাধারণত ভর্তি ফি বাড়ানোর অভিযোগ উঠলেও এবার ভর্তি ফি’র সঙ্গে সকল শ্রেণীর মাসিক বেতন, সেশন চার্জসহ অন্যান্য ফি বাড়ানো হচ্ছে পাল্লা দিয়ে। আবার এর কারণ হিসেবে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে নতুন পে স্কেলকে। অর্থাৎ নতুন পে স্কেলে সরকারী চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানোয় এবার গ্যাঁড়াকলে পড়েছে বেসরকারী স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্র্তৃপক্ষ বলছে, পে স্কেলে সরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন বেড়েছে, তাই বেসরকারী স্কুল-কলেজের শিক্ষক-কর্মকর্তারা দাবি করছেন তাদের বেতনও বাড়াতে হবে। কিন্তু এটা করার কোন সুযোগ নেই বলে সতর্ক করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর। পরিস্থিতি সম্পর্কে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন বলছিলেন, সরকার নতুন পে স্কেল দিয়ে তো বলেনি সরকারী-বেসরকারী সবাইকেই তা কার্যকর করতে হবে। আর স্কুলগুলো যে পরিমাণ বেতন বাড়ায় এর চার ভাগের এক ভাগও শিক্ষকদের পেছনে ব্যয় করে না। তিনি বলেন, আমাদের আওতায় যতটুকু সম্ভব ততটুকু ব্যবস্থা আমরা নেব। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ব্যাপারটা আমরা দেখছি। অভিভাবকদের অভিযোগের পরই আমি সরাসরি নির্দেশ দিয়ে তদন্ত কমিটি করিয়ে তদন্ত শেষ করেছি। ইতোমধ্যেই তদন্ত রিপোর্ট আমার হাতে এসেছে। এখন রিপোর্টের ভিত্তিতে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিস ও অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তদন্ত কমিটি ওই প্রতিষ্ঠানটিতে সকল শ্রেণীর শিক্ষার্থীর ভর্তি ফি, বেতনসহ সকল শিক্ষা ব্যয় প্রায় ৪৩ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রমাণ পেয়েছে। আইন অনুসারে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবুল হোসেনকে কারণ দর্শানো নোটিস দিয়েছে অধিদফতর। অধ্যক্ষের জবাবের পর নেয়া হবে ব্যবস্থা। শাস্তি কী হতে পারে? এর জবাবে কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রথমত বর্ধিত টাকা ফেরত দিতে হবে। সরকার চাইলে অধ্যক্ষের এমপিও বন্ধÑ এমনকি উনি বরখাস্তও হতে পারেন। অধিদফতর ইতোমধ্যেই তদন্ত রিপোর্ট অনুসারে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ফাইল পাঠিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। একই সঙ্গে অন্যান্য যেসব প্রতিষ্ঠানে বেতন-ফি বাড়ানো হয়েছে তাদের বিষয়েও ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী হয়েছে মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর। হঠাৎ করে বেতন-ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে একসপ্তাহ ধরে আন্দোলন করছেন উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এ্যান্ড কলেজের অভিভাবকরা। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় শনিবারও ‘উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এ্যান্ড কলেজ অভিভাবক ফোরামের’ ব্যানারে প্রতিষ্ঠানটির সামনে কর্মসূচী পালন করেছেন অভিভাবকরা। দাবি আদায়ে এর আগে বুধবার শিক্ষামন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিয়েছেন তারা। আজ থেকে স্কুল প্রাঙ্গণে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচী পালন করার হুমকি দিয়েছেন অভিভাবকরা। এছাড়া অধ্যক্ষ নিয়োগ, গবর্নিং বডির নির্বাচন, শিক্ষক নিয়োগ এবং কলেজের বিভিন্ন অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধেও আইনী ব্যবস্থা নিতে দুই মাসের সময় দিয়েছেন তারা। বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন একধাপে ৬০০ থেকে বেড়ে ১১০০ টাকা এবং ইংরেজী মাধ্যমে ১৯০০ থেকে ২৭৫০ টাকা হয়েছে বলে জানান এক অভিভাবক। এদিকে শিক্ষার্থীদের বেতন-ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে প্রতিষ্ঠানের সামনে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করছেন রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের অভিভাবকরা। তারা বলছেন, অস্বাভাবিক বেতন বৃদ্ধি মানি না, মানব না। অভিভাবকদের দাবি, হঠাৎ করে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি ফি ও মাসিক বেতন প্রায় দ্বিগুণ নেয়া শুরু করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এমনকি দ্বিতীয় থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত দ্বিগুণ হারে বেতন বৃদ্ধির পরিকল্পনাও করা হয়েছে বলে জানতে পেরেছেন তারা। এর প্রতিবাদেই তারা এ বিক্ষোভ কর্মসূচী পালন করছেন। রাশেদা খানম নামের এক অভিভাবক বলেন, বাংলা মাধ্যমে প্রথম শ্রেণীতে গত বছর বেতন ছিল ৮০০ টাকা, সেটা এ বছর এক হাজার ৬০০ টাকা করা হয়েছে। আর ইংরেজী মাধ্যমের বেতন ৯০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ৭০০ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া আগে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি ফি আট হাজার টাকা নেয়া হলেও এবার তা নেয়া হচ্ছে ১৫ হাজার টাকা। ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ সুফিয়া খাতুন বলেছেন, অভিভাবকরা আমাকে বেতন না বাড়াতে যতটুকু চাপ দিচ্ছেন, শিক্ষকরা তাদের বেতন বাড়াতে দিচ্ছেন তার চেয়েও দ্বিগুণ চাপ। আমাদের মাত্র ৭ শতাংশ শিক্ষক এমপিওভুক্ত। তাদের যদি বেতন বাড়ে, বাকিদেরও বাড়াতে হবে। সরকার যেহেতু নতুন স্কেল দিয়েছে, বেতন না বাড়ালে চলাই যাবে না। আমরা প্রথম শ্রেণীর বেতন বাড়িয়েছি। দ্বিতীয় থেকে দশম শ্রেণীর বেতন বাড়ানোর ব্যাপারেও আলোচনা চলছে। পরিচালনা কমিটি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। পে স্কেলকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ওপর অর্থের বোঝা চাপানো নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বিয়াম স্কুলের কর্মকা-ের বিরুদ্ধেও। সরকারী সুযোগ-সুবিধা নিয়ে পরিচালিত এ স্কুলের পে স্কেলের সঙ্গে বেতন কেন বাড়ানো হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অভিভাবকরা। জানা গেছে, এখানে মাসিক বেতন দুই শত টাকা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এখানে আছে বেতন বৈষম্য। অন্য অভিভাবকদের সন্তানদের বেতনের তুলনায় অর্ধেক বেতন দিতে হয় সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর সন্তানদের। এতে সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের সন্তানদের সঙ্গে অন্যান্য অভিভাবকদের সন্তানের বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে বলে প্রতিবাদ জানিয়েছেন অভিভাবকরা। বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ড. উম্মে সালেমা বেগম বলেছেন, আমাদের ১২ জন শিক্ষক মাত্র এমপিওভুক্ত। বাকি শিক্ষকদের বেতন প্রতিষ্ঠান থেকে দিতে হয়। আবার আমাদের প্রতিষ্ঠানে বিষয় বেড়েছে চারটা। এজন্য শিক্ষক বাড়ানো প্রয়োজন। ৬৫টি কম্পিউটার প্রয়োজন। আছে মাত্র ১৫টি। মাল্টিমিডিয়া শ্রেণীকক্ষ প্রয়োজন ৫৬টি। আছে মাত্র চারটি। তাহলে এত ঘাটতি আমরা কিভাবে পূরণ করব? সে কারণেই শিক্ষার্থীদের বেতন বাড়ানো হয়েছে। এ স্কুলের এক শিক্ষক তাদের নিজেদের দাবির বিষয়ে বলছিলেন, দেখেন সরকারী শিক্ষকদের বেতন বেড়েছে। বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। তাই আমরা বলছি আমাদের বেতন বাড়াতে হবে। তবে আমরা শিক্ষার্থীদের বেতন বাড়াতে বলিনি। ধানম-ির জুনিয়র ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী কমলের অভিভাবক অভিযোগ করেছেন, এ স্কুলে বাড়ানো হয়েছে পাঁচ শ’ টাকা। এখন দেখার বিষয়, কোন কোন মানুষ পে স্কেলের অধীনে বেতন পাচ্ছেন। আমি তো ব্যবসা করি। আমার তো টাকা বাড়েনি। এ অভিভাবক বলেন, আমরা কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত প্রতিবাদ দিয়েছি। কিন্তু তারা কোন কথা শুনতে রাজি নন। এভাবে চলতে পারে না। মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল এ্যান্ড কলেজে মাসিক বেতন প্রতিটি শ্রেণীতে বাড়ানো হয়েছে ৯০ শতাংশ থেকে ১০০ ভাগ পর্যন্ত। একইভাবে বাড়ানো হয়েছে ভর্তি ফি, সেশন চার্জসহ সব ধরনের ফি। অভিভাবকরা কয়েক দফা অভিযোগ করলেও কর্তৃপক্ষ তাতে কর্ণপাত করছে না বলে অভিযোগ করেছেন অভিভাবকরা। তারা বলেছেন, স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের অভিভাবকরা বৈঠক করেছেন। শীঘ্রই তারা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে নামবেন। তবে তারা আগে কর্তৃপক্ষকে বর্ধিত টাকা ফেরত দিতে আল্টিমেটাম দেবেন। মিরপুরের শহীদ পুলিশ স্মৃতি স্কুল, শহীদ লেফটেন্যান্ট আনোয়ার গার্লস স্কুল, বাংলাদেশ ব্যাংক আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়, মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এ্যান্ড কলেজ, রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজ, ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল, সিদ্ধেশ্বরী উচ্চবালিকা বিদ্যালয়সহ আরও বেশ কয়েকটি স্কুলে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেতন-ফি বাড়ানোর অভিযোগ তুলেছেন অভিভাবকরা। প্রতিবাদ সমাবেশ সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের ॥ বিভিন্ন স্কুলে ভর্তি, বেতন ও টিউশনে বর্ধিত ফি প্রত্যাহারের দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট। শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এ প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
×