ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাস্থ্যসেবার চিকিৎসা পেতে সামান্য প্রিমিয়াম দিতে হবে

স্বাস্থ্যবীমা এ মাসেই শুরু, ৫০ রোগে বিনামূল্যে চিকিৎসা ॥ টাঙ্গাইলের তিন উপজেলায় পাইলট প্রকল্প

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৪ জানুয়ারি ২০১৬

স্বাস্থ্যবীমা এ মাসেই শুরু, ৫০ রোগে বিনামূল্যে চিকিৎসা ॥ টাঙ্গাইলের তিন উপজেলায় পাইলট প্রকল্প

নিখিল মানখিন ॥ মধ্য আয়ের দেশের অন্যতম শর্ত স্বাস্থ্য বীমা। আর তাই এ মাসেই স্বাস্থ্য বীমা কর্মসূচী শুরু করতে যাচ্ছে সরকার। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচী’ নামে একটি পাইলট প্রকল্পের মধ্যে স্বাস্থ্য বীমার পরিধি সীমাবদ্ধ থাকছে। এ প্রকল্পের আওতায় দরিদ্র মানুষ জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ৫০ রোগের চিকিৎসা বিনামূল্যে পাবেন। এই চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহের জন্য পরিবারপ্রতি বছরে ১ হাজার টাকা প্রিমিয়াম হিসাবে প্রদান করবে সরকার। আর পরিবারপ্রতি বছরে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা সুবিধা লাভ করবে। এই কর্মসূচীর অধীনে নির্দিষ্ট সূচক ব্যবহার করে পাইল এলাকায় দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী প্রায় ১ লাখ পরিবার চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এসব পরিবারকে একটি হেলথ কার্ড প্রদান করা হবে। প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছে গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। গত বছরের ডিসেম্বরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের উপস্থিতিতে গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সঙ্গে এসংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই পাইলট প্রকল্পের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরবর্তীতে সারাদেশে স্বাস্থ্য বীমা কর্মসূচীর পরিধি বৃদ্ধি করা হবে। এছাড়া সকল সরকারী কর্মচারীকে স্বাস্থ্য বীমার আওতায় আনার চিন্তাভাবনাও করছে সরকার। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি, জটিল ও ব্যয়বহুল রোগের প্রাদুর্ভাব, নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি ইত্যাদি নানা কারণে চিকিৎসা সেবার খরচ বেড়েছে। এতে নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষদের আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার নতুন এ উদ্যোগ। এ ছাড়া সর্বজনীন চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার জন্য ‘হেলথ কেয়ার ফাইন্যান্সিং স্ট্র্যাটেজি ২০১২-২০৩২’-এ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রতিশ্রুতিও রয়েছে সরকারের। প্রাথমিকভাবে এ প্রকল্পটি টাঙ্গাইল জেলার তিন উপজেলায় (কালিহাতী, মধুপুর, ঘাটাইল) পাইলট কার্যক্রম শুরু করবে। পরবর্তী সময়ে পাইলট কার্যক্রম থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজের পরিধি বাড়াবে সরকার। পাইলট প্রকল্প চলাকালে এই প্রিমিয়ামের অর্থসহ প্রকল্পের যাবতীয় ব্যয় স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি উন্নয়ন সেক্টরের উন্নয়ন কর্মসূচী হতে সংস্থান করা হবে। পরবর্তীতে সরকারী বরাদ্দ এবং সচ্ছল পরিবার থেকে প্রিমিয়াম সংগ্রহের মাধ্যমে কর্মসূচীটির অর্থায়ন করা হবে। চিকিৎসা ব্যয়, দরিদ্র নির্বাচন, স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজন ইত্যাদি বিষয়ে কয়েকটি গবেষণা পরিচালনা করে পাইলটের রূপরেখা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিদ্যমান রোগের ধরন বিশ্লেষণ করে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে চিকিৎসাযোগ্য ৫০ রোগ চিকিৎসার একটি প্যাকেজ তৈরি করা হয়েছে। প্রত্যেকটি রোগ চিকিৎসার ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে এই চিকিৎসার জন্য বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় ‘ট্রিটমেন্ট প্রটোকল’ তৈরি করা হয়েছে। হাসপাতালগুলো চিকিৎসা প্রদানের জন্য রোগীপ্রতি এই নির্ধারিত হারে অর্থ লাভ করবে। এই কর্মসূচী পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় ম্যানুয়ালসমূহ প্রস্তুত করা হয়েছে। এই কর্মসূচী বাস্তবায়ন সার্বিকভাবে তত্ত্বাবধানের জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় স্টিয়ারিং এবং সচিবের নেতৃত্বে একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠিত হয়েছে। কর্মসূচী বাস্তবায়ন সার্বিকভাবে তত্ত্বাবধানের জন্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটে একটি সেল (এসএসকে) গঠন করা হয়েছে। এই সেলকে সহায়তার জন্য এবং মাঠপর্যায়ে এই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি নির্বাচন করা হয়েছে। এই এজেন্সির মূল কাজ হলো চিহ্নিত দরিদ্র পরিবারগুলোকে নিবন্ধন, এসএস কার্ড ইস্যু করা, কার্ডধারী রোগীদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে সাহায্য করা এবং চিকিৎসা পরবর্তী হাসপাতালের অর্থ পরিশোধে সহায়তা করা। ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি হিসেবে নির্বাচিত গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সঙ্গে এ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, সারাদেশে সরকারী হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে যাচ্ছে সরকার। স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন ঘটিয়ে দেশে-বিদেশে সুনাম কুড়িয়েছে বাংলাদেশ। জনবলবৃদ্ধিসহ স্বাস্থ্য সেক্টরের অবকাঠামো সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন কর্মকা- অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে দেশের গরিব মানুষের সহায়তা প্রদানে সর্বদা তৎপর রয়েছে সরকার। তারই ধারাবাহিকতায় সরকার গরিব মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচী’ নামে নতুন একটি প্রকল্প (পাইলট) যাচাই করতে যাচ্ছে বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। বিশেষজ্ঞরা বলেন, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারলে তা দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চয়তা দিতে পারে স্বাস্থ্য বীমা। দারিদ্র্য বিমোচন এবং স্বাস্থ্য পরিচর্যার ফল পারস্পরিক সম্পর্কিত। উন্নত স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রাখে এবং বিপরীত ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবায় কাক্সিক্ষত উদ্যোগের অভাবে দারিদ্র্য বিমোচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলেন, স্বাস্থ্য পরিচর্যা খাতে ব্যয় দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচীতে ব্যয়ের চেয়ে বেশি কার্যকর। কারণ দরিদ্রতার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে অসুস্থতা বা মৃত্যুর কারণে আর্থিক ক্ষতি থেকে পরিবারগুলোকে রক্ষার অভাব। পরিবারের কোন সদস্যের বড় ধরনের অসুস্থতা পরিবারটিকে দারিদ্র্যের মধ্যে ফেলতে পারে। যদি তিনি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম হন তাহলে পরিবারটি চরম দারিদ্র্যে পড়বে। গরিব মানুষের সমস্যা হচ্ছে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত পরিকল্পনা থাকে না এবং চিকিৎসায় এককালীন বড় ব্যয়ের ধাক্কা সামলে উঠতে পারে না। স্বাস্থ্য নিরাপত্তাকে শুধু লক্ষ্য হিসেবে দেখা উচিত নয় বরং দারিদ্র্য বিমোচনের ব্যাপক উদ্দেশ্য অর্জনের কৌশল হিসেবে দেখা উচিত। স্বাস্থ্যপরিচর্যার কর্মকা-ের অভাবে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় গরিব মানুষ। ধনীদের চেয়ে এদের মৃত্যুহার এবং অপুষ্টিতে আক্রান্তের হার বেশি। স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় মেটানোর জন্য এখন বিকল্প তহবিল ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য বীমাই হতে পারে সেই বিকল্প কৌশল। এতে দরিদ্র জনগণ অল্প পরিমাণ প্রিমিয়াম দিয়ে স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা পেতে পারেন। স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনানুযায়ী তহবিল সংগ্রহ সহজ নয়। কারণ ভবিষ্যতের জন্য এবং অনিশ্চিত সুবিধার জন্য সঞ্চয় করা গরিবদের জন্য একটি বিলাসিতা। অন্যদিকে বৃদ্ধ এবং দরিদ্রতম ব্যক্তিও সঞ্চয় করতে পারে না। তাদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে হয় সরকারীভাবে বিনামূল্যে। আর্থিক সামর্থ্যরে দিক দিয়ে বিবেচনা করলে এটা খুব কঠিন কাজ। এ অবস্থায় স্বাস্থ্য বীমা তখনই কার্যকর হবে যখন খরচের একটি অংশ সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে নেয়া যাবে বলেও মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা। উচ্চ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে অনেক পরিবার ॥ হু হু করে বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়। দেশের মানুষের মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় বেড়ে ২৭ মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ব্যয়ের ৬৪ শতাংশ ব্যক্তি নিজের পকেট থেকে খরচ করে। ২৬ শতাংশ ব্যয় বহন করে সরকার। বাকি ১০ শতাংশ ব্যয় বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও ব্যবসায়িক বীমা কোম্পানি বহন করে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে বছরে ৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। দেশের উন্নত স্বাস্থ্যসেবা এখনও অনেকটাই জেলা ও বিভাগকেন্দ্রিক। জটিল অসংক্রামক রোগে আক্রান্তের মাত্রাও অনেকগুণ বেড়েছে। চিকিৎসা ব্যয় ও ওষুধের দামও অনেক বেড়েছে। ব্যয়বহুল হওয়ায় দরিদ্র মানুষ জটিল ধরনের অসংক্রামক রোগের চিকিৎসা করাতে পারে না। স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি ও ভোগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। কিছু কিছু অসমতা এতটাই তীব্র ও প্রতিকূল যে, সমষ্টিগতভাবে তা দেশের অগ্রগতির অন্তরায়। কোন কোন ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাতে অর্জিত সাফল্য টিকিয়ে রাখাই কষ্টকর। আবার কিছু ক্ষেত্রে স্থবিরতার লক্ষণ দৃশ্যমান। সুস্বাস্থ্য এখনও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিশেষ করে বস্তিবাসীদের নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হেলথ ইকোনমিকস ইউনিট, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান জিআইজেড সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) হেলথ ইকোনমিকস এ্যান্ড ফিন্যান্সিং রিসার্চ দলের প্রধান জাহাঙ্গীর এএম খান বলেন, স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৪ শতাংশ ব্যক্তি নিজে বহন করে। ২৬ শতাংশ ব্যয় বহন করে সরকার। বাকি ১০ শতাংশ ব্যয় বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও ব্যবসায়িক বীমা কোম্পানি বহন করে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে চার শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়।
×