ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আরাফাত মুন্না

সাকা-মুজাহিদ-নিজামির দায় স্বীকার ॥ যুদ্ধাপরাধ বিচারের টার্নিং পয়েন্ট

প্রকাশিত: ০৭:৪৪, ১ জানুয়ারি ২০১৬

সাকা-মুজাহিদ-নিজামির দায় স্বীকার ॥ যুদ্ধাপরাধ বিচারের টার্নিং পয়েন্ট

২০১৫ সাল। আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু ঘটনার কারণে বছরজুড়েই মানুষের আগ্রহ ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রীমকোর্ট। বিশেষ করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী সরকারের প্রতিশ্রুতির রক্ষার সঙ্গে ইতিহাসের দায়মুক্তির বিচার শেষ করার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বছর ছিল ২০১৫ সাল। বছরের শুরু থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত আলোচনায় ছিল কুখ্যাত মানবতাবিরোধী অপরাধী জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান। বছরের শেষ দিকে জামায়াতের আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনালের আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিচার কার্যক্রম ও ফাঁসির রায় কার্যকরও ছিল সুপ্রীমকোর্ট তথা দেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। ফাঁসির দড়ি গলায় পরার আগে সাকা-মুজাহিদ নিজেদের দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুকে আলোচনার শীর্ষে তুলে দেন। এরপর আপীল শুনানিতে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর দোষও স্বীকার করেন তার আইনজীবী। দেশে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তিন যুদ্ধাপরাধী দায় স্বীকার করার বিষয়টি যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য টার্নিং পয়েন্ট। সাকা-মুজাহিদের ফাঁসি চলতি বছরের ১৮ নবেম্বর জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রিভিউ আবেদন খারিজ করেন সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ সমাজকল্যাণমন্ত্রী ছিলেন। তার বিরুদ্ধে দেয়া রায়ে মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষের জনগণকে দমাতে গঠিত আলবদর বাহিনীর মানবতাবিরোধী কর্মকা-ে নেতৃত্ব দেয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হয়। বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সাবেক শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। বিভিন্ন মন্তব্যের কারণে বিতর্কিত সাকা চৌধুরী। তাকে চারটি অভিযোগে মৃত্যুদ-ে দ-িত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সাকা চৌধুরী ঠা-া মাথায় হত্যা ও গুমের অপরাধ সংঘটিত করেছেন বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। ক্যালকুলেটিভ ও সুচিন্তিতভাবে সাকা চৌধুরী মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। এ দুই আসামি (সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদ) কিভাবে ৭১ এ মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন তা পূর্ণাঙ্গ রায়ে উঠে এসেছে। এর আগে ১৪ অক্টোবর খালাস চেয়ে রিভিউ করেন রাজনৈতিক দুই দলের এই নেতারা। ৩০ সেপ্টেম্বর তাদের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পায়। তার ১৩ দিন পরে রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করেন সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদ। ২০ অক্টোবর অবকাশকালীন চেম্বার আদালত রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন দুটি শুনানির জন্য ২ নবেম্বর তারিখ ধার্য করেন। পরে সাকা ও মুজাহিদের আইনজীবীর আবেদনের প্রেক্ষিতে শুনানির দিন ১৭ নবেম্বর পুনর্নির্ধারণ করেন আপীল বিভাগ। ১৭ তারিখ রিভিউ আবেদনের শুনানি শেষে রায়ের জন্য ১৮ নবেম্বর দিন ঠিক করেন আপীল বিভাগ। ওইদিন সাকা ও মুজাহিদের রিভিউ খারিজ করে আদেশ দেয়া হয়। পরে প্রশ্ন ওঠে এই দুই কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী দায় স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি-না? পরে ২১ নবেম্বর সকালে সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে দুই যুদ্ধাপরাধীই নিজেদের দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন। যা নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে। সন্ধ্যার পর তাদের আবেদন রাষ্ট্রপতি খারিজ করে দিলে রাতেই ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হয় এই দুই কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীকে। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই মুজাহিদকে ও ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর সাকা চৌধুরীর মৃত্যুদ- দিয়ে রায় দেন ট্রাইব্যুনাল। এর আগে নাশকতার মামলায় সাকাকে ২০১০ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাতে গ্রেফতার করা হয়। ওই বছরই ১৯ ডিসেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের এক মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার হন জামায়াত নেতা মুজাহিদ। প্রাণভিক্ষার আবেদন এই দুই যুদ্ধাপরাধী প্রাণভিক্ষা চাইলেও তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হতে থাকে তারা প্রাণভিক্ষা চাননি। এ নিয়ে নানা বিতর্ক সৃষ্টি হয় ২১ নবেম্বর সন্ধা থেকেই। পরে ২২ নবেম্বর আইন মন্ত্রণালয় থেকে প্রাণভিক্ষার সত্যতা পায় জনকণ্ঠ। মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করে সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদ নিজেদের দোষ স্বীকার করে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছিলেন। তাদের দুইজনের আবেদনেই সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের অনুসারে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন। সাকা চৌধুরী ‘বাংলা খাতার (ছক কাটা)’ কাগজে চার পাতায় নিজ হাতে ইংরেজীতে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন। অন্যদিকে মুজাহিদ সাধারণ সাদা কাগজে দুই পৃষ্ঠায় বাংলায় প্রাণভিক্ষার আবেদনটি করেন। মন্ত্রণালয় সূত্র অনুযায়ী, সাকা ও মুজাহিদ সরাসরি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন এমন কথা স্বীকার করেননি। অত্যন্ত কৌশলে দুজনই প্রাণভিক্ষা চেয়েছেন। তবে তারা জড়িত ছিলেন না এমন কথাও বলেননি। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে তারা অপরাধ স্বীকার করেছেন। পরে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর আপীল শুনানিতেও তার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন নিজামীর যুদ্ধাপরাধ স্বীকার করে শুধু মৃত্যুদ- মওকুফ করার আর্জি জানান। কামারুজ্জামানের ফাঁসির চলতি বছরের ৬ এপ্রিল মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের মামলায় আপীলের রিভিউ খারিজ করে মৃত্যুদ- বহাল রাখেন সুপ্রীমকোর্টের বিভাগ। তারপর ১১ এপ্রিল রাতে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। এর আগে ৫ এপ্রিল কামারুজ্জামানের করা রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি করেন উভয়পক্ষ। তার আগে ৯ মার্চ রিভিউ শুনানির জন্য কার্যতালিকায় আসে, পরে ১ এপ্রিল দিন ধার্য করেন আপীল বিভাগ। ৫ মার্চ রিভিউ আবেদন করেন কামারুজ্জামানের আইনজীবীরা। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারপতির বেঞ্চ কামারুজ্জামানের আপীলের পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণা করেন। ২০১৩ সালের ৩ নবেম্বর কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মৃত্যুদ- দিয়েছিলেন আপীল বিভাগ। তারও আগে তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদ-াদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। নিজামীর আপীলের রায় ৬ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদ-ের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর আনা আপীল মামলার রায় ঘোষণা করা হবে আগামী ৬ জানুয়ারি। গত ৮ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপীল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চে নিজামীর আপীলের শুনানি শেষে রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন। নিজামীর পক্ষে তার প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তির বিপরীতে বক্তব্য পেশ করার পরে নিজামীর আপীল মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষে রায় ঘোষণার দিন ঠিক করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের প্রাক্কালে জাতির মেধাবী সন্তান বুদ্ধিজীবী হত্যাকা- এবং হত্যা-গণহত্যাসহ সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির (উর্ধতন নেতৃত্বের দায়) মোট চারটি অপরাধের দায়ে নিজামীর ফাঁসির আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। নিজামীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন আনীত মোট ১৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধের মধ্যে ৮টি অর্থাৎ ১, ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৮ ও ১৬ নম্বর অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে চারটি অর্থাৎ (২, ৪, ৬ নম্বর) এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাকা- ও সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটির (১৬ নম্বর) দায়ে নিজামীকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। অন্য চার অভিযোগে (১, ৩, ৭ এবং ৮ নম্বর) তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়। ৫ ও ৯ থেকে ১৫ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এসব অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেন ট্রাইব্যুনাল। নিজামীকে মৃত্যুদ- দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর রায় ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ২৩ নবেম্বর আপীল দায়ের করেন তিনি। অন্যান্য আলোচিত মামলা ২০১৫ সালে উচ্চ আদালতের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ এবং আলোচিত অন্যান্য মামলার মধ্যে ছিল, স্বাধীনতাবিরোধী ‘খান এ সবুর’ এবং ‘শাহ আজিজুর রহমান’-এর নামীয় স্থাপনার নাম পরিবর্তনে কয়েক দফায় নির্দেশ, দুই দফায় সরকারদলীয় সংস সদস্য বদির রিট খারিজ, রাজন-রাকিব হত্যা মামলার আপীল শুনানি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্রহণ করতে প্রধান বিচারপতির নির্দেশ, অপারেশন ক্লিনহার্ট নামে পরিচালিত অভিযানের কার্যক্রমকে দায়মুক্তি দিয়ে করা আইনকে বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা, প্রথম আলোর আদালত অবমাননার মামলা, বিচারপতিদের কথোপকথন প্রকাশ করায় জনকণ্ঠের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা, প্যানেলভুক্ত প্রাইমারী শিক্ষদের নিয়োগে কয়েকদফায় আদেশ, শীর্ষ সন্ত্রাসী তোফায়েল আহমেদ জোসেফের শাস্তি হ্রাস, পচা গম বিষয়ে রিটের আদেশ, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে রুল, ৩৪ বিসিএস নিয়ে রুল এবং বন সংরক্ষক ওসমান গনির মামলা, বিডিআর বিদ্রোহের মামলার শুনানি এবং চাঞ্চল্যকর সাত খুনের মামলা।
×