আজাদ সুলায়মান ॥ অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে চলতি বছর দেশে চোরাই সোনা উদ্ধার হয়েছে এক হাজার কেজি। দেশের দুটো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে আনা হয় এ সোনা। এ পরিমাণ সোনা আনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছে শতাধিক। যাতে রয়েছেন বিমানের পাইলট, ডিজিএম, বিমানবালা। বছরের শেষ সপ্তাহে ধরা পড়ে এ যাবতকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী গডফাদার। রাজধানীর পল্টনের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে চল্লিশ কোটি টাকা মূল্যের সোনা ও মুদ্রাসহ ধরা হয় তাকে। আলোচিত এসব সোনার আশি শতাংশই ধরেছে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। বিমানবন্দরে কর্মরত কর্মচারীদের ভাষায়, ‘এটা গোল্ডেন ইয়ার’। এক বছরে এত সোনা জীবনে আর কেউ কোনদিন দেখেনি। নিত্যনতুন কৌশলে আনা হয় সোনা। পায়ের মোজা, জুতো, গুঁড়োদুধের কৌটা, ল্যাপটপ, মোবাইলের খোলস, বিস্কুটের টিন, পান সুপারির কৌটা, বৈয়াম, শার্টের কলার, কলম, বেল্ট, হুইল চেয়ার, আন্ডারওয়ারে আনা হয় সোনা। এমনকি বাদ যায়নি নারীর গুপ্তাঙ্গ ও পুরুষের গুহ্যদ্বার।
বিমানবন্দরের প্রবীণ এক কর্মচারী এসব চালান সম্পর্কে বলেন, চাকরি প্রায় শেষ পর্যায়ে। এর আগে জীবনে কোনদিন দেখিনি এ রকম সোনার চালান। শুল্ক গোয়েন্দার নাম শুনলেই এখন চোরাচালানি আঁতকে ওঠে। বিমানবন্দরকেন্দ্রিক স্মাগলারদের কাছে শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক ডক্টর মইনুল খান, উপপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান ও কবীরের নাম শুনলেই আঁতকে ওঠে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এরা দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে গত দেড় বছরে বিমানবন্দরে চোরাচালানের ভিত কাঁপিয়ে দেন। এদের সাঁড়াশি অভিযানে চোরাচালানিরা দিশাহারা হয়ে বড় বড় চালান আনার জন্য বেছে নেয় চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, চলতি বছর শুরুতেই ধরা পড়ে সোনার একটি চালান। তারপর বড় থেকে বড় হয়ে ওঠে সে চালান। বছরের শেষ ২৫ ডিসেম্বর বড়দিনে পল্টনে ধরা পড়ে এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় মুদ্রার চালান ও সোনা। সঙ্গে প্রভাবশালী গডফাদার মোহাম্মদ আলী। তিনি এখন ছয়দিনের রিমান্ডে। এ ছাড়া আধা কেজি, এক কেজির চালান আসে বছরজুড়েই। গড়ে প্রায় প্রতিসপ্তাহেই সোনার ছোট ছোট চালান ধরা পড়েছে। বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত শুধু শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানন্দরেই ধরা পড়ে। তারপর চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরেও সোনা আসতে থাকে। ওখানেও ধরা পড়ে বড় বড় চারটি চালান। ছোট চালান আসে এগারোটি।
শুল্ক গোয়েন্দার পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি বছর অতীতের সর্ব রেকর্ড ছাড়ানো চালান ধরা হয়েছে। শুধু শুল্ক গোয়েন্দার অভিযানেই ধরা পড়েছে ৭৯২ কেজি। বাকিটুকু ধরেছে কাস্টমস। পাশাপাশি র্যাব ও থানা পুলিশের অভিযানেও ধরা পড়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সোনা। বাদ যায়নি রেল পুলিশও। কমলাপুর রেল থানার পুলিশও আটক করেছে কয়েকটি চালান।
এ বছরের সবচেয়ে বড় চালান ধরা পড়ে গত সপ্তাহে পল্টনের ২৯/১ বাড়িতে। বৃহস্পতিবার রাতে শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক ডক্টর মইনুল খান ডিবি পুিলশ নিয়ে দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী অভিযান চালান ওই বাসায়। এ সময় বাড়ির মালিক মোহাম্মদ আলী ও তার স্ত্রী-পুত্রের সামনে উদ্ধার করা হয় পাঁচ বস্তা টাকা ও ৬১ কেজি সোনা। পরে বিমানবন্দরে সারারাত সারাদিন ধরে গোনা হয় টাকা। তাতে দেখা যায়, সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা ও তিন কোটি টাকা মূল্যের রিয়াল। তাৎক্ষণিক আটক করা হয় তাকে। একদিন পর পল্টন থানায় মামলা হয়।
চাঞ্চল্যকর এ চালানের মূল হোতা মোহাম্মদ আলী ঘটনাস্থলেই সাংবাদিকদের জানান, এ সোনা তার নয়। সিরাজগঞ্জের রিয়াজ উদ্দিন তাকে এগুলো বাসায় লুকিয়ে রাখতে দেয়।
ডক্টর মইনুল খান জানান, মোহাম্মদ আলী দেশের সোনা চোরাচালানের শীর্ষ গডফাদার। এর আগে এত বড় গডফাদার কখনই ধরা পড়েনি। সে দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যবসায় জড়িত। সে চোরাচালানের মাধ্যমে আনা সোনা কিনত এবং পরে তা বড় বড় চালানে দেশের বাইরে পাচার করত। তার বিপুল পরিমাণ সম্পদেরও তথ্য বের হয়ে আসছে। মূলত তিনি মিষ্টির দোকান ও আবাসন ব্যবসার আড়ালে স্মাগলিং করতেন। তার মতো এমন আরও কয়েকজন রয়েছে গোয়েন্দা ফাঁদে। যে কোন সময় ধরা পড়তে পারে ওরা।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বছরের শুরুতে ছোট ছোট বেশ কটা চালান ধরার পড় ২৫ মার্চ আসে ১০৬ কেজি সোনার চালান। চট্টগ্রামের হজরত শাহ আমানত বিমানবন্দরের ৭ যাত্রীর সিটের নিচ থেকে এ সোনা আটক করা হয়। তাদের স্েঙ্গ ছিলেন আরও তিনজন। তারা হলেন শফিক ইসলাম, মনসুর ইসলাম, নাহিত তালুকদার, পিয়ারুল ইসলাম, ইমতিয়াজ, ইয়াকুব,মাইন উদ্দিন, রহিম শিকদার, ফয়সাল ও ফজলুল হক।
তার পরের মাসেই ধরা পড়ে প্রথমবারের মতো পারিবারভিত্তিক চোরাচালান। একটি পরিবারের চার সদস্যকে শাহজালাল বিমানবন্দরে আটক করা হয় বিশ কেজি সোনাসহ। তারা হলেন শাহনাজ হোসেন, আনজিলা হোসেন, আগা নাভিল ইবনে ইকরাম ও নাফ। তারা একই পরিবারের সদস্য। প্রত্যেকের শরীরের বিভিন্নস্থানে লুকিয়ে আনে এ সোনা। তাদের বিমানবন্দর থানায় এনে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তারা স্বীকার করেন পারিবারিকভাবে চোরাচালান করলে ধরা পড়ার সন্দেহ বা ঝুঁকি থাকে কম। তারা এর আগেও বেশ ক’বার একই কায়দায় সোনা আনে।
এ বছরের আরও একটি আলোচিত চালান ধরা পড়ে ২৬ এপ্রিল। বিমানের নতুন বোয়িং অরুণ আলোতে করে আনা হয় ১০৫ কেজি সোনার চালান। এ চালানে জড়িত হিসেবে চিহ্নিত করা হয় বিমানের বেশ ক’জন উর্ধতন কর্মকর্তাসহ ১৪ কর্মচারী। এ ঘ্টনায় হাতেনাতে ধরা পড়ে বিমানের দ্ইু কর্মকর্তা আনিস উ্িদ্দন ও মাসুদ। অবৈধ সোনা চালান বহনের দায়ে ্জব্দ করা হয় বিমানের নতুন উড়োজাহাজ অরুণ আলো। এটিকে বিমানের ইতিহাসে সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক ডক্টর মইনুল খান এ বিষয়ে বলেন,্এর আগে কখনও কোন উড়োজাহাজ আটক করা হয়নি। হাতেনাতে প্রমাণ পাওয়ায় ্জব্দ করা হয় এ ফ্লাইট। মামলার রায়ে চোরাচালানের অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাতে আসামিদের যেমন শাস্তি হবে তেমনি দোষী এয়ারলাইন্স হিসেবে বিমানকে দশগুণ জর্মিানা করা হবে। যদি অরুণ আলোর দাম বার শত কোটি টাকা হয়, সে ক্ষেত্রে বিমানকে জরিমানা দিতে হবে বারো হাজার কোটি টাকা। এ মামলা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ শুল্ক বিভাগের কাছে রয়েছে।
বছরের শেষভাগে এসে ১০ ডিসেম্বর ধরা পড়েছে ৪৩ কেজি সোনার একটি চালান। এটি ধরে শুল্ক গোয়েন্দা। আগে থেকেই গোপন তথ্য আসে, সিঙ্গাপুর থেকে চট্টগ্রামের একটি গার্র্মেন্টসের বোতামের চালানের বাক্সে ভরে সোনা ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। ওই চালান আনে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের যাত্রীবাহী একটি ফ্লাইট এসকিউ ৪৪৬। চট্টগ্রামের কর্ণফুলি ইপিজ্ডে’র একটি কোম্পানি ইউনিটেক্সের নামে পাঠানো হয়। মালগুলো হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো এলাকার খোলা জায়গায় ৩টি কার্টনে রাখা ছিল। বিমানের এক নিরাপত্তা মহাব্যবস্থাপক মমিনুল ইসলামের নির্দেশে কয়েক নিরাপত্তাকর্মী এসব সোনা খালাসের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। গোয়েন্দা পুিলশ জানিয়েছে, মমিনুল ইসলামসহ ইদ্রিস আলী, নুরুজ্জামান ম-ল, কামরুল ইসলামসহ ৮ নিরাপত্তা কর্মীর গতিবিধি নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
বিদায়ী বছরের সোনা চোরাচালানের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল নিত্যনতুন সব কৌশল। পায়ের মুজা,জুতো,গুঁড়ো দুধের কৌটা, ল্যাপটপ, মোবাইলের খোলস, বিস্কুটের টিন, পান-সুপারির কৌটা, বৈয়াম, শার্টের কলার, কলম, বেল্ট, হুইল চেয়ার, আন্ডারওয়ারে করে আনা হয় সোনা। এমনকি বাদ যায়নি নারীর গুপ্তাঙ্গ ও পুরুষের গুহ্যদ্বার।
রাজ্জাক নামের এক কিডনি রোগী হুইল চেয়ারে বসে যখন গ্রীন চ্যানেল অতিক্রম করছিল তখন তাকে বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই আটকে দেয় শুল্ক গোয়েন্দার সদস্যরা। এমন একজন রোগীকে আটক করায় অনেকেই তখন অবাক হয়। কিন্তু শত শত যাত্রীর সামনেই তার শরীর তল্লাশি করে ৬ কেজি সোনার বার উদ্ধার করা হয় তখন সবাই হতবাক। আর বাকি থাকে কি ? পরে তাকে মামলায় জড়িয়ে রিমান্ডে নেয় বিমানবন্দর পুলিশ। তখন পুলিশ জানতে পারে তিনি পেশাদার স্মাগলার। একই কায়দায় তিনি রোগী সেজে মালয়েশিয়া থেকে বেশ কবার সোনা আনেন। বার বার সফল হবার পর ধরা পড়েন শেষবার। এ নিয়ে একটি মানবাধিকার সংগঠন তার পক্ষ নিয়ে তখন হাউকাউ করে। তার জামিনের জন্য শ’খানেক উকিল আদালতে দাঁড়ায়।
বছরের শেষভাগে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর অভিযানে সোনা চোরাচালানের অভিযোগে ধরা পড়েন বিমানের পাইলট আবু শহীদ, ডিজিএম এমদাদ, ম্যানেজার এমদাদ, মাহবুব পলাশ, হারুন রশীদ। তাদের ডিবিতে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সময় বেরিয়ে আসে আরও দুুই পাইলটের নাম। এদের একজন ক্যাপ্টেন ইশরাতকে যে কোন সময় জিজ্ঞাসাবাদের সময় ডিবিতে তলব করা হতে পারে বলে জানান এক কর্মকর্তা। গ্রেফতারকৃত বিমান কর্তারা এখন সবাই কারাগারে। তাদের রক্ষা করা ও জামিনের জন্য কোটি টাকার বাজেট নিয়ে মাঠে নেমেছে ডিজিএম এমদাদের ঘনিষ্ঠ চোরাচালানিরা।