ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ জুন ২০২৫, ১ আষাঢ় ১৪৩২

ভরা মৌসুমেও চোখে জল: পঞ্চগড়ে চায়ের পাতায় কৃষকের হাহাকার

মেহেদী হাসান সেতু, কনট্রিবিউটিং রিপোর্টার, পঞ্চগড়

প্রকাশিত: ০১:৩৬, ১৫ জুন ২০২৫; আপডেট: ০৪:১২, ১৫ জুন ২০২৫

ভরা মৌসুমেও চোখে জল: পঞ্চগড়ে চায়ের পাতায় কৃষকের হাহাকার

ছবি: সংগৃহীত

সবুজ পাতায় একদিন ছিল স্বপ্ন, আজ সেখানে হতাশার ছায়া। পঞ্চগড়ের চা চাষিদের জীবনে নেমে এসেছে তীব্র সংকট। এক সময় যেসব বাগান কৃষকের মুখে হাসি এনেছিল, আজ সেসবই হয়ে উঠেছে জীবনের বোঝা। ভরা মৌসুমে ন্যায্য দাম না পেয়ে কেউ পাতাগাছ কেটে ফেলছেন, কেউ পাতা ফেলে দিচ্ছেন রাস্তার ধারে। অনেকেই আর চা তুলতে রাজি নন, কারণ শ্রমের বিনিময়ে মিলছে শুধু হতাশা।

স্বপ্নের ফসল, আজ বোঝা

পঞ্চগড় দেশের একমাত্র সমতল ভূমির চা অঞ্চল। এখান থেকেই আসে দেশের মোট চা উৎপাদনের প্রায় ১৯ শতাংশ। ২০২৩ সালে জেলার চা উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৭৭ লাখ কেজি, যার বাজারমূল্য দাঁড়ায় প্রায় ২৬০ কোটি টাকা। চলতি বছর উৎপাদন ২ কোটির কাছাকাছি হলেও কৃষকের মুখে নেই একটুও হাসি।

জেলায় রয়েছে নিবন্ধিত ২ হাজার ৫৩টি চা বাগান এবং অনিবন্ধিতসহ ৮ হাজারের বেশি ক্ষুদ্র বাগান। এসব বাগানে কাজ করেন হাজার হাজার শ্রমিক ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। কিন্তু এখন তারা সবাই হাহাকার করছেন বিক্রির কোনো ঠিকানা না পেয়ে।

চায়ের বদলে ফিরতে চান গম বা বাদামে, তবুও পারছেন না

চা একটি দীর্ঘমেয়াদি ফসল। গাছ কাটলেও সঙ্গে সঙ্গে জমি চাষের উপযোগী হয় না। যারা গম, ভুট্টা কিংবা বাদামের মতো মৌসুমি ফসল ছেড়ে চায়ে বিনিয়োগ করেছিলেন, তাদের এখন ফেরার কোনো পথ নেই। পুঁজি হারিয়ে তারা আজ কর্মহীন।

সিন্ডিকেটই মূল বাধা

চাষিদের অভিযোগ দামের এই ধ্বসের পেছনে রয়েছে কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেট। মৌসুমের শুরুতে প্রতি কেজি পাতা যেখানে বিক্রি হতো ৩০-৩৮ টাকায়, সেখানে এখন মিলছে মাত্র ১৩-১৪ টাকায়। তারও অর্ধেক বাদ পড়ছে ওজনের নামে। ফলে কার্যত প্রতি কেজি পাতা বিক্রি করে চাষির হাতে উঠছে মাত্র ৬-৭ টাকা। অথচ উৎপাদন খরচই ১৫-১৮ টাকা!

কারখানার কৌশলে মাঠে জমছে পাতা

বছরের মে থেকে জুলাই—এই সময় চায়ের ভরা মৌসুম। কিন্তু ঠিক এই সময়েই কারখানাগুলো একেকদিন করে বন্ধ থাকে। একদিন এই কারখানা, পরদিন অন্যটি। এতে চাষিদের বিক্রির সুযোগ সংকুচিত হয়। অনেক পাতাই সময়মতো না কাটার ফলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে মাঠে, বাগানেই শুকিয়ে যাচ্ছে সবুজ স্বপ্ন।

চাষির কষ্ট, কারখানার উৎসব

কম দামে চাষিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা পাতাগুলোতেই তৈরি হচ্ছে কোটি কোটি টাকার বাজার। প্রতিদিনই চলছে চা প্রস্তুত, প্যাকেটজাত ও বাজারজাতকরণ। কিন্তু এই লাভের কোনো অংশই পাচ্ছেন না মূল উৎপাদকরা। তারা শুধু দেখছেন—নিজের ঘামে ভেজা পাতার পেছনে কত কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে, অথচ ঘরে নেই চাল কেনার টাকাও।

কারখানার যুক্তি ধারণক্ষমতার সীমা

তেঁতুলিয়ার বিসমিল্লাহ টি ফ্যাক্টরি লিমিটেডের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘খরার কারণে মৌসুমের শুরুতে পাতা কম ছিল। এখন হঠাৎ সব বাগানে একসঙ্গে পাতা উঠছে। আমাদের সক্ষমতার বাইরে গিয়ে দ্বিগুণ পাতা নিচ্ছি, শুধু চাষিদের অনুরোধে।’

সমাধান কোথায়?

পঞ্চগড়ের চা ছিল স্বনির্ভরতার প্রতীক। এই শিল্পে বিপ্লব ঘটিয়েছিল জেলার হাজারো কৃষক। কিন্তু বর্তমানে এই শিল্প ধসে পড়ার মুখে। কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেট ভাঙা, ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ, সরকারি হস্তক্ষেপ ও পর্যাপ্ত কারখানা অনুমোদনের মতো উদ্যোগ ছাড়া এই সংকটের সমাধান নেই।

প্রয়োজনীয় সহায়তা না পেলে একদিন হয়তো পঞ্চগড়ের সম্ভাবনাময় চা শিল্প হারিয়ে যাবে হতাশার ধোঁয়ায়। চাষিরা আর বিশ্বাস করবেন না সবুজ পাতার স্বপ্নে। তখন শুধু থাকবে ফেলে যাওয়া বাগান আর শুকিয়ে যাওয়া ইতিহাস।

মেহেদী হাসান সেতু/রাকিব

×