ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

লালমনিরহাট জেলা

তিনটি আসনেই ঈগল আতঙ্কে নৌকার প্রার্থী

তাহমিন হক ববী, লালমনিরহাট থেকে ফিরে

প্রকাশিত: ০০:৪৪, ২ জানুয়ারি ২০২৪

তিনটি আসনেই ঈগল আতঙ্কে নৌকার প্রার্থী

উত্তরাঞ্চলের তিস্তা নদী বিধৌত জেলা লালমনিরহাট

উত্তরাঞ্চলের তিস্তা নদী বিধৌত জেলা লালমনিরহাট। তিস্তা  ছাড়াও ধরলা-রতনাই-স্বর্ণমতি-সানিয়াজান-সাঁকোয়া-মালদহ-ত্রিমোহনী-সতি-গিরিধারী-ছিনাকাটা-ধলাই ও ভোটেশ্বরী নদী ঘেরা এ জেলার মানুষজনের জীবন-জীবিকায় নৌকা জড়িয়ে আছে। এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে জেলার তিনটি আসনে নতুন সমীকরণ যুক্ত করেছেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এতে নৌকার হেভিওয়েট তিন প্রার্থী- সাবেক গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন, সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমান যেন কঠিন সময় অতিক্রম করছেন।
লালমনিরহাটের তিনটি সংসদীয় আসনে ১৯ জন লড়ছেন। মাঠ পর্যায়ের হিসাব অনুযায়ী, ৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়বে নৌকা।  আওয়ামীপন্থি স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ঈগল ঝড়ে জয়ের সম্ভাবনা দেখছেন।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিভাজন হয়ে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষ নিয়েছে। অনেকে বলছেন স্থানীয়ভাবে নতুন নেতৃত্ব প্রয়োজন।  ফলে নৌকার সঙ্গে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্রেরই মূল লড়াই হবে আসন তিনটির ঈগল প্রতীকের। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রচারে বাধা ও হামলা করতে গিয়ে নৌকার প্রার্থীর লোকজন নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে ফেলছেন। ফলে জরিমানা ও জবাবদিহিতার কবলেও পড়তে হচ্ছে তাদের। এতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
স্থানীয়রা বলছেন, হেভিওয়েট প্রার্থীদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ভোটের লড়াই যেন মারাত্মক হয়ে উঠছে। পুরো রাজনীতির মাঠে আজকে যাদের আমরা জনপ্রিয় হিসেবে দেখছি, তারা কিন্তু দীর্ঘ  রাজনৈতিক পথপরিক্রমার মধ্য দিয়ে গেছেন। জনগণের সঙ্গে তাদের স¤পর্কও নিবিড়। গণতন্ত্রে জনগণের মনের ভাষা বুঝতে পারাটা গুরুত্বপূর্ণ।
লালমনিরহাট-১ (হাতীবান্ধা-পাটগ্রাম) ॥ এই আসনে টানা চারবারের সংসদ সদস্য সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা মোতাহার হোসেন। এবার তিনি পঞ্চমবারের জন্য নৌকার প্রার্থী হয়েছেন। তিনি ২০০৬ সাল থেকে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে আসছেন।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, লালমনিরহাট-১ আসনে প্রথম, অষ্টম, নবম, দশম, একাদশ সংসদে আওয়ামী লীগ, দ্বিতীয় এবং ১১ দিন মেয়াদের ষষ্ট সংসদে বিএনপি, তৃতীয় সংসদে স্বতন্ত্র, চতুর্থ, পঞ্চম ও সপ্তম সংসদে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা বিজয়ী হন।

মোতাহার হোসেন ২০০১, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্য। এই আসনে রয়েছেন ৫ প্রার্থী। অন্যরা হলেনÑ  জাসদের হাবিব মোহাম্মদ  ফারুক (মশাল), ইসলামী ফ্রন্টের আ জ ম আজাহার হোসেন  (মোমবাতি),  স্বতন্ত্র প্রার্থী আতাউর রহমান প্রধান (ঈগল) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী কেএম আমজাদ হোসেন তাজু (ট্রাক)। এই আসনে জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী নেই। যাকে দল মনোনয়ন দিয়েছিল তিনি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। ফলে নৌকার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী (ঈগল)।

সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি ও আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য আতাউর রহমান প্রধান। আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন চেয়ে পাননি। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। নৌকার প্রার্থী টানা চারবারের সংসদ সদস্য মোতাহার হোসেনকে রিতিমত ঘোল খাওয়াতে শুরু করেছেন ঈগল। তার প্রতিটি নির্বাচনী সভায় উপচেপড়া লোকসমাগম চোখে পড়ার মতো। তিনি বিভিন্ন সভায় বলেছেন, আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন দলের নৌকা প্রার্থীদের সঙ্গে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা লড়ছেন। এখানেই জনপ্রিয়তা যাচাই হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বর্তমানে সারাবিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছেন। সেই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা দরকার। সে কারণে আবার এই সরকারকে ক্ষমতায় আনতে হবে। আমি এ আসনের নৌকার মনোনয়ন না পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছি। যা শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এলাকার ভোটাররা আমাকে তাদের রায় দেবেন। 
এদিকে গত ২১ ডিসেম্বর রাতে গড্ডিমারী মেডিক্যাল মোড় এলাকায় গণসংযোগ করতে গেলে আওয়ামী লীগের এই স্বতন্ত্র প্রার্থীর গাড়ি বহরে হামলা ও তার নির্বাচনী অফিস ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।

এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নৌকার প্রার্থীর ব্যক্তিগত সহকারী হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক স¤পাদক আবু বক্কর সিদ্দিক শ্যামলকে তলব করে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি ২৩ ডিসেম্বর। নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির কাছে সশরীরে উপস্থিত হয়ে লিখিত ব্যাখ্যাও দেন শ্যামল। কিন্তু সেখান থেকে ফিরে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোতাহার হোসেনের নির্বাচনী জনসভায় যোগ দিয়ে নৌকা প্রতীক ছাড়া অন্য কোনো প্রতীকের লোককে তার গড্ডিমারী ইউনিয়নে ঢুকতে না দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। শ্যামলের এমন বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিয়ে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

তারা বলছেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে যেখানে নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্টরা নিরলসভাবে কাজ করছেন সেখানে এমন হুমকিতে ভোটের স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। রাতে নৌকা প্রতীকের ওই নির্বাচনী জনসভায় শ্যামলের বক্তব্যের একটি ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ে। ওই ভিডিও বক্তব্যে শ্যামল বলছেন, আমি গড্ডিমারীর মানুষকে আজকের (গত শনিবার) তারিখ থেকে ৭ তারিখ পর্যন্ত প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় পাহারা বসাতে অনুরোধ করছি। জননেতা মোতাহার হোসেনের নৌকা ছাড়া অন্য কোনো মার্কার লোক যেন এই এলাকায় ঢুকতে না পারে।  
 এ ব্যাপারে আবু বক্কর সিদ্দিক শ্যামলের বক্তব্য চাইতে তার মোবাইলে একাধিকবার কল করা হলে বন্ধ পাওয়া যায়। সাধারণ ভোটাররা বলছেন, পুত্র সোহাগ ও এপিএস শ্যামল লালমনিরহাট ১ আসনের নৌকার প্রার্থীকে ডুবাচ্ছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা মোতাহার হোসেন তার নির্বাচনী এলাকায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন; দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অপ্রত্যাশিতভাবে শক্ত প্রতিপক্ষ আতাউর রহমান প্রধানের ঈগলের মুখোমুখি হতে  হচ্ছে তাকে।
লালমনিরহাট-২ (আদিতমারী-কালীগঞ্জ) ॥ এই আসনের নৌকার প্রার্থী টানা দুইবারের সংসদ সদস্য কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সমাজকল্যাণমন্ত্রী  নুরুজ্জামান আহমেদ। তিনি চাপা ক্ষোপের দলটির নেতাকর্মীদের পাশাপাশি আপন ভাইরাও তার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে। ফলে তারা  জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী সিরাজুল হককে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন।

এ ছাড়া সমাজকল্যাণমন্ত্রীর অনিয়ম-দুর্নীতির গোপন তথ্য প্রকাশ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনের জনসভায় ফাঁস করে দিচ্ছেন ভাই। যা ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে মন্ত্রী ও মন্ত্রীর সমর্থকরা  শামাল দিতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছেন।  সাধারণ ভোটারদের মধ্যে অনেকে বলেছেন ঈগল প্রতীকের সঙ্গেই নৌকার মূল লড়াই হবে। সিরাজুল হক জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও  আদিতমারী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। এ ছাড়া তিনি এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক ও ছিলেন সিআইপি,লালমনিরহাট চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি, জেলা  মোটর মালিক সমিতির সভাপতি।
এই আসনে ৭ প্রার্থী লড়াই করছেন। অন্য ৫ প্রার্থী হলেন-জাতীয় পার্টির দেলোয়ার হোসেন (লাঙ্গল), বাংলাদেশ কংগ্রেসের  দেলাব্বর হোসেন (ডাব), জাকের পার্টির রজব আলী (গোলাপ ফুল), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির শরিফুল ইসলাম (আম), স্বতন্ত্র প্রার্থী দুুইজন মমতাজ আলী (ট্রাক)। 
গত ১৯ ডিসেম্বর বিকেলে আসনটির কালীগঞ্জের কাকিনা উত্তর বাংলা কলেজ মিলনায়তনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী সিরাজুল হকের কর্মীসভা হয়। সভায় নৌকার প্রার্থী সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ তুলেন তারই ছোট ভাই সভার বিশেষ অতিথি লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুবুজ্জামান।

বক্তব্যের একপর্যায়ে মাহবুবুজ্জামান আহমেদ আরও বলেন, গোপন (কথা) ফাঁস করে দেই। আপনি (সমাজকল্যাণমন্ত্রী) নৌকা নিয়েছেন না? নৌকায় ভিড়তে (জিততে) পারবেন না। কারণ ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আপনি নৌকা পুড়িয়েছেন। নৌকা আপনাকে মান (সম্মান) করবে না। এ সময় মঞ্চে উপস্থিত এক নেতা পাশ থেকে চিৎকার করে বলেন, গোপন কথা ফাঁস।
কালীগঞ্জের ভোটমারী থেকে মহিষখোচা পর্যন্ত তিস্তা নদীতে মন্ত্রী বাঁধ দিতে দেননি বলে সভায় অভিযোগ করেন মন্ত্রীর ছোট ভাই মাহবুবুজ্জামান আহমেদ। এর একটাই জবাব উল্লেখ করে তিনি বড়ভাইয়ের  উদ্দেশে বলেন, আপনি (মন্ত্রী) বাঁধ দেননি, আমরা আপনাকে বাদ (বয়কট) দিলাম। পরে মঞ্চে থাকা স্বতন্ত্র প্রার্থী সিরাজুল হককে দেখিয়ে তার ঈগল প্রতীকে ভোট দেওয়া ও কর্মী হিসেবে কাজ করার আহ্বান জানান মাহবুবুজ্জামান আহমেদ। ওই কর্মীসভায়  আরও উপস্থিত ছিলেন আদিতমারী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক ইমরুল কায়েস, ভাদাই ইউপি চেয়ারম্যান কৃষ্ণকান্ত রায় বিদুর, কমলাবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদ ওমর চিশতি, সারপুকুর ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির প্রমুখ।
এদিকে এলাকাবাসীও বলছেন নানান কথা। নৌকার লোকজন ঈগলের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলছে। এমন এক ঘটনায় গত ২৩ ডিসেম্বর বিকেলে আদিতমারী উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ স¤পাদক নিয়ামুল আলম নাঈমকে এক হাজার টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ জরিমানা আদায় করেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রওজাতুন জান্নাত।
অপরদিকে ২৩ ডিসেম্বর রাতে কালীগঞ্জ উপজেলার মদাতী ইউনিয়নের চামটারহাট স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে আয়োজিত নির্বাচনী জনসভায় নৌকার প্রার্থী সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান বক্তব্য দেন। 
 সেই বক্তব্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মর্তুজা হানিফ নামে  ঈগলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীর ঘাড় মটকে দেওয়ার কথা বলেন তিনি। মন্ত্রীর এই বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে। মন্ত্রী বক্তব্যে বলেন, সেদিন ভুল্লারহাট মিটিংয়ে মর্তুজা হানিফ যে বাজে কথা বলেছে তাকে সতর্ক করে দিচ্ছি; এই ধরনের বাজে কথা যদি আর কোনোদিন বলো তাহলে তোমার ঘাড় মটকে দেব। তুমি এখনো লোক চেন না। এ সময় মন্ত্রীর সমর্থকরা চিৎকার করে ওঠে। ওই বক্তব্যের ভিডিও মুহূর্তের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

নৌকা মার্কার ওই নির্বাচনী জনসভায় অন্যদের মধ্যে কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ স¤পাদক মিজানুর রহমান মিজু, উপজেলা যুবলীগের সভাপতি রেফাজ রাঙ্গা ও সমাজকল্যাণমন্ত্রীর এপিএস মিজানুর রহমান মিজান বক্তব্য রাখেন। 
 ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সিরাজুল হকের নির্বাচনী কর্মী মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মর্তুজা হানিফ রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য।  তিনি  কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, সমাজকল্যাণমন্ত্রী আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ঈগল  মার্কার জনসমর্থন দেখে উন্মাদ হয়ে গেছেন। তাই ক্ষোভে মন্ত্রী বিভিন্ন নির্বাচনী জনসভায় নানান কথাবার্তা বলছেন। আমি তার বিরুদ্ধে মামলা করব।

এদিকে সমাজকল্যাণমন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারই আপন  ছোট ভাই লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মাহবুবুজ্জামান আহমেদ। তিনি ২৪ ডিসেম্বর রাতে আদিতমারী উপজেলার কমলাবাড়ি এলাকায় আওয়ামী  লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী সিরাজুল হকের এক নির্বাচনী জনসভায় বলেন, আপনি লেখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা? কোনদিন আপনি বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন? যুদ্ধের সময় আমি ক্লাস ফোরে পড়ি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিল আমার বাবা আর এক ভাই অধ্যক্ষ রশিদুজ্জামান। আপনি (মন্ত্রী) তো ইন্ডিয়ায় বসে পাটের ব্যবসা করেছেন। ১৯৯৬ সালে যখন নমিনেশন পেলেন তখন পোস্টারে লেখে দিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তখন বিব্রত হয়ে মানিক কমান্ডার ডেকে বলেছিলেন, তুই এটা দিসিস কেন? তখন তিনি (মন্ত্রী) বলেছেন, আমি সার্টিফিকেট বানায় নিছি, আমার কাছে কাগজ আছে। 
 কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ স¤পাদক মিজানুর রহমান বলেন, ওই সভায় আমিও উপস্থিত ছিলাম। সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম মর্তুজা হানিফ স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী জনসভায় বক্তব্যে সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদকে অপমানজনক কথা বলেছেন। তাই মন্ত্রী তাকে সতর্ক করার জন্য কথাগুলো বলেছেন। তাকে মন্ত্রী হুমকি দেননি। মন্ত্রীর ছোট ভাইয়ের বক্তব্য সম্পর্কে তিনি বলেন, পারিবারিক বিবাদে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ছোট ভাই সাজানো কথা বলেছে। যা মন্ত্রীর নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে না। 
লালমনিরহাট ৩ (সদর) আসনে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হেভিওয়েট নেতা মতিয়ার রহমান নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করছেন। স্থানীয়রা বলছেন, তিনি ইমেজ নিয়ে চলা মানুষ। এই আসনে তিনি সহ ৭ প্রার্থী থাকলেও এখানেও নৌকার সঙ্গে মূল লড়াই হবে সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে সংসদ সদস্য পদের স্বতন্ত্র প্রার্থী জাবেদ হোসেন ঈগল প্রতীকের। তিনি জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। এই আসনের অনান্য প্রার্থী হলেন- জাতীয় পার্টির জাহিদ হাসান (লাঙ্গল), তৃণমূল বিএনপির শামীম আহম্মেদ চৌধুরী (সোনালী আঁশ),বাংলাদেশ সাম্যবাদী দলের আশরাফুল আলম (চাকা), জাসদের আবু তৈয়র মো. আজমুল হক পাটোয়ারী (মশাল) ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির  শ্রী হরিশ চন্দ্র রায় (আম)।
পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এই  আসনে প্রথম, দশম সংসদে আওয়ামী লীগ, দ্বিতীয় এবং ১১ দিন মেয়াদের ষষ্ট ও অষ্টম সংসদে বিএনপি, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, সপ্তম, নবম ও একাদশ সংসদে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা বিজয়ী হন। এই আসনে দীর্ঘদিন মহাজোটের জাপার প্রার্থীর কারণে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দেয়নি। এবার এখানে নৌকা প্রার্থিতা পেয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, ওই আসনে বড় কোনো রাজনৈতিক দলের এমনকি সুপরিচিত কোনো প্রার্থীও নেই। যে কারণে জয়ের ব্যাপারে অনেকটা নির্ভাবনায় থাকার চেষ্টা করছেন নৌকার মাঝি।
নবম ও একাদশ সংসদে এই আসনে মহাজোটের জাপার প্রার্থী ছিল পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। দুই দফায় তিনি আসনটির সংসদ সদস্য। এবার তিনি লালমনিরহাট ৩ আসন ছেড়ে  রংপুর ৩ আসনের প্রার্থী হয়েছেন। তার স্থলে এই আসনে লাঙ্গলের প্রার্থী দেওয়া হয় জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক  নতুন মুখ জাহিদ হাসান। তাকে খোদ দলটির নেতাকর্মীরা পছন্দ করেন না।

প্রায় ১০ বছর পর চলতি বছরের ১৬ নভেম্বর লালমনিরহাট জেলা জাতীয় পার্টির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে পুরানো নেতাদের কোনো মূল্যায়ন করা হয়নি। যার জেরে সম্মেলনের আগেই জেলা জাতীয় পার্টির অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী পদত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ধরে নেতাকর্মীদের সঠিক মূল্যায়ন না করা, সরকারি প্রজেক্ট বরাদ্দে জেলা জাতীয় পার্টির সদস্য সচিবের একক আধিপত্যে নেতাকর্মীরা আলমগীর হোসেনের প্রতি ক্ষুব্ধ হন।

এ কারণেই সম্মেলনের আগে তারা পদত্যাগ করছেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে নেতাকর্মীদের গণপদত্যাগ ভোটের মাঠে জাতীয় পার্টিতে প্রভাব ফেলে এখন। ফলে লাঙ্গল প্রার্থীকে সাধারণ ভোটারাও প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছেন না। 
গত বছরের ১৭ অক্টোবর লালমনিরহাট জেলা পরিষদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমান। তিনি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সদর আসনে নৌকার মাঝি হন। উল্লেখ, তিনি ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর লালমনিরহাট জেলা পরিষদ নির্বাচনে  নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ২০০১-২০০৬ আমলে প্রায় ৫৭টি রাজনৈতিক হয়রানি ও মিথ্যা মামলা তার মাথায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মতিয়ার রহমান বর্তমানে জনগণের কাছে জনপ্রিয়।

নৌকার এই প্রার্থীর প্রধান প্রতিপক্ষ সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে সংসদ সদস্য পদের স্বতন্ত্র প্রার্থী জাবেদ হোসেন বক্করের ঈগল প্রতীক। তিনি জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। তবে সাধারণ ভোটারদের মন্তব্য করতে শোনা যায়, জাবেদ হোসেন বক্কর এখন তরুণ। তার আগামীতে অনেক সময় আছে। সে হয়ত ভোটের মূল লড়াইয়ে যেতে পারবে। তবে মতিয়ার রহমানকে পরাজিত করা তার পক্ষে কঠিন হতে পারে।  তবুও এই আসনে নৌকার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী তিনি।

×