ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মীম নোশিন নাওয়াল খান

দাবানলে বিপন্ন বন্যপ্রাণী

প্রকাশিত: ০৯:৪১, ১৭ জানুয়ারি ২০২০

দাবানলে বিপন্ন বন্যপ্রাণী

মাইলের পর মেইল আগুন জ্বলছে। যেদিকে চোখ যায় শুধু আগুন আর আগুন। আগুনের শিখায় অস্ট্রেলিয়ার নীল আকাশ ঢেকে গেছে কমলা রঙে। ঘূর্ণিঝড়ের পর ধোঁয়ার কুণ্ডলি উঠছে বন থেকে। আগুনের শুরুটা বনে হলেও শুধু অরণ্য নয়, এই আগুন গ্রাস করছে লোকালয়ও। বনে আগুন লাগাটা অস্ট্রেলিয়ায় নতুন কোন ঘটনা নয়। প্রচ- গরম আর শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে প্রতি বছরই এ ধরনের দাবানল ঘটে থাকে দেশটায়। আগুনের সূত্রপাত সাধারণত ঘটায় মানুষ। সিগারেটের আগুন বা অসাবধানতায় যে কোনভাবে লেগে যাওয়া সামান্য আগুনই বনজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। তবে কখনও কখনও এই দাবানল শুরু হয় বিদ্যুত চমকানো থেকেও, যদিও তা খুব কম ক্ষেত্রেই ঘটে। কারণ যাই হোক না কেন, শুষ্ক মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ায় দাবানল যেন সাধারণ ঘটনা। তবে দাবানল খুব সাধারণ ঘটনা হলেও এ বছর এই ঘটনাটা একদমই ব্যতিক্রম। দাবানল মৌসুম এবার বেশ আগেই শুরু হয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়। প্রতিবছর সাধারণত জানুয়ারির শেষ থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত দাবানল মৌসুম থাকলেও এবার নিউ সাউথ ওয়েলসের বিভিন্ন রাজ্যে আগুন লাগতে শুরু করে সেপ্টেম্বর মাস থেকেই। ডিসেম্বরে নিউ সাউথ ওয়েলস সরকার জরুরী অবস্থা জারি করে। গত চার মাসে এই দাবানল নিয়ন্ত্রণে না এসে আরও বেশি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। ২০১৯-২০২০ দাবানল মৌসুমে অস্ট্রেলিয়া এবং গোটা বিশ্ব অভিহিত করেছে স্মরণকালের ভয়াবহ দাবানল হিসেবে। এ বছরের দাবানলে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬.৩ মিলিয়ন হেক্টর (১৬ মিলিয়ন একর; ৬৩ হাজার বর্গকিলোমিটার) এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত ৫ জানুয়ারির হিসাব অনুযায়ী এই আগুনে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে ২৫ জন মানুষ এবং ধ্বংস হয়েছে ২৫০০ ভবন, যার মধ্যে প্রায় ১৩০০ বসতবাড়ি রয়েছে। এছাড়া ভয়ানক এই দাবানলে মারা গেছে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন বন্যপ্রাণী। এখন পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন জায়গায় জ্বলছে একশ’রও বেশি আগুন। সারাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত দমকল কর্মী পাঠানো হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোতে। কিন্তু এই ভয়ঙ্কর আগুনের কাছে সবাই যেন অসহায়। আগুন নেভানো প্রায় অসম্ভব হলেও সে চেষ্টা করে যাচ্ছেন দমকল কর্মীরা। এছাড়াও চেষ্টা করা হচ্ছে বনের প্রাণীদের উদ্ধার করার। দমকল বাহিনীর সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ান সেনাবাহিনী এবং স্বেচ্ছাসেবকরাও যোগ দিয়েছেন এ কাজে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডাও পাঠিয়েছে তাদের দমকল বাহিনী। অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে বৃষ্টি হওয়ায় দাবানলে পোড়া এলাকার তাপমাত্রা কিছুটা কমেছে। রবিবার ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে কমে তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রীতে এসেছে। তবে এই বৃষ্টি বিশাল দাবানল নেভানোর জন্য যথেষ্ট নয়। দাবানল থাকতে পারে আরও কয়েক মাস। এই দাবানল এতটাই ভয়াবহ যে, অস্ট্রেলিয়া থেকে এক হাজার মাইল দূরে নিউজিল্যান্ডের আকাশও ঢেকে গেছে আগুনের ধোঁয়ায়। সারা অস্ট্রেলিয়ায় আগুনের ধোঁয়া এখন নতুন এক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জানুয়ারির ১ তারিখে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে সর্বোচ্চ দূষণ রেকর্ড করা হয়। সেদিন ‘এয়ার কোয়ালিটি ইন্ডেক্স’ ছিল বিপদসীমার ২৩ গুণ বেশি। অস্ট্রেলিয়ার দাবানলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশটির বন্যপ্রাণীরা। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কোয়ালা ও ক্যাঙ্গারু। আট হাজার কোয়ালা, যা নিউ সাউথ ওয়েলসের কোয়ালা সংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ, মারা গেছে এ বছরের দাবানলে। এছাড়া এক-তৃতীয়াংশ কোয়ালার আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে গেছে আগুনে। এছাড়াও আরও অনেক প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি এবং সরীসৃপ আক্রান্ত হয়েছে আগুনে। এদের মধ্যে অনেক প্রাণী মারা গেছে, অনেককে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে পশু হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। চিকিৎসাধীন অবস্থায়ও প্রতিদিন অনেক প্রাণী মারা যাচ্ছে। কোয়ালা এবং ক্যাঙ্গারুর মতো প্রাণীরা আগুনের ভয়াবহতায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ছোট ছোট প্রাণী মারা যাচ্ছে পরোক্ষ প্রভাবে। ছোট প্রাণীরা গর্তে বা পাথরে লুকিয়ে আগুনের শিখা থেকে বেঁচে গেলেও মারা যাচ্ছে খাদ্য, বাসস্থান এবং পানির অভাবে। ধারণা করা হচ্ছে, এই দাবানলে অস্ট্রেলিয়ার বন্যপ্রাণীর বেশ কিছু প্রজাতি বিলুপ্তির মুখে পড়তে পারে। এই ঝুঁকিতে থাকা প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে ইস্টার্ন ব্রিসলবার্ড, মাউন্টেইন পিগমি পজাম এবং করোবরি ফ্রগ। এ বছর দাবানলের এমন ভয়াবহতার জন্য বিশেষজ্ঞরা দায়ী করছেন জলবায়ু পরিবর্তনকে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ভুক্তভোগী অস্ট্রেলিয়াও। ১৮ ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে উষ্ণতম দিন ছিল, যেদিন দেশটির তাপমাত্রা ছিল ৪১.৯ ডিগ্রী সেলসিয়াসÑ যা দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এই প্রচ- তাপ ও অনাবৃষ্টি দাবানলের অন্যতম প্রধান কারণ। এই দাবানলকে বিজ্ঞানীরা দেখছেন ভবিষ্যতের জন্য এক বিপদ সংকেত হিসেবে। জলবায়ু পরিবর্তনের এমন প্রভাবে অনেক পশুপাখি ও উদ্ভিদ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার তীব্র সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও মানবসভ্যতাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই সময় এ বিষয়ে সচেতন পদক্ষেপ গ্রহণ করার। নাহলে অস্ট্রেলিয়ার মতো এমন করুণ দৃশ্য দেখতে হবে গোটা বিশ্বকেই।
×