ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

নির্মূল কমিটির আলোচনা সভায় আশা পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের

ভারত এমন কিছু করবে না যা এদেশের মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলে

প্রকাশিত: ১০:৩৮, ৭ ডিসেম্বর ২০১৯

ভারত এমন কিছু করবে না যা এদেশের মানুষকে  আতঙ্কিত করে তোলে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গত এক দশকে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে তারা আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে নানাভাবে আমাদের সহযোগিতা করেছে। যুদ্ধে অংশ নিয়েছে সে দেশের জওয়ানরা। অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করেছে। শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। ভারতের এই সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অসম্পূর্ণ। মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন। তিনি আশা করেন সম্পর্কের এই অবস্থায় ভারত এমন কিছু করবে না, যা এদেশের মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলে। শুক্রবার রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরে এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এই মন্তব্য করেন। বাংলাদেশকে ভারতের কূটনৈতিক স্বীকৃতির ৪৮তম বার্ষিকী উপলক্ষে ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান ও ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক’ শীর্ষক ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি এই আলোচনা সভার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। যুদ্ধে তাদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে যে সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছে, দু’দেশের সেই সম্পর্ক এখন অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। দু’দেশের এই সোনালি সম্পর্কের মধ্যে যেন কোন ধরনের দুশ্চিন্তা ও আতঙ্ক তৈরি না হয়, এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ‘নিবিড় সম্পর্কের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন বলেন, পারস্পরিক বন্ধুত্বের মাধ্যমে ভারত ও বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। দুই দেশের জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে। সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে নিবিড় থেকে নিবিড়তর হবে। দুই দেশের বন্ধুত্ব, পারস্পরিক বিশ্বাস, আস্থা ও বোঝাপড়া বর্তমানে দৃঢ়তর হওয়ায় পারস্পরিক সহযোগিতা ও উন্নয়নের নতুন নতুন ক্ষেত্র উন্মোচিত হচ্ছে। গত এক দশকে আমাদের দুই দেশের বন্ধুত্ব অনন্য উচ্চতায় আসীন হয়েছে। যাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘সোনালি অধ্যায়’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। আমাদের দুই দেশের সরকার প্রধানদের এই যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করেছে তা ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে অনেক বেশি শক্ত ভিতে পরিণত করেছে। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তৃতায় ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলী দাশ বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালে ভারত যেভাবে বাংলাদেশের পাশে ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দু’দেশের মধ্যে যে বন্ধন শুরু হয়েছিল তা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে। বর্তমানে দুই দেশের মধ্যেকার এই বন্ধুত্ব ‘সোনালি অধ্যায়ে’ পৌঁছেছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের মধ্যে যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, তা চিরকালীন ও সময়ের পরীক্ষায় সবসময় উত্তীর্ণ হবে। ডিসেম্বর মাস ভারতের কাছেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ মাসেই দু’দেশের বন্ধুত্বের সূচনা হয়েছে। ৪৮ বছরে বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করেছে। বাংলাদেশের ‘উন্নতি’ আজ অনেক দেশের ঈর্ষার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আমরা বাংলাদেশের উন্নতিতে নিজেদের জন্য বড় রকমের অর্থনৈতিক সুযোগ দেখি। আমরা দুইয়ে মিলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন ও দুই সরকারের গৃহীত বহু পদক্ষেপের ক্ষেত্রে একসঙ্গে এগিয়ে যেতে পারি। আমাদের দু’দেশের সম্পর্ক মানবিক উন্নয়নের উচ্চতর স্থানে পৌঁছে গেছে, যা বিশ্বের অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয়। বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে ওঠা প্রজন্ম। তাদের বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ধারণ করতে হবে। রীভা গাঙ্গুলি বলেন, ভারত প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ককে অনেক গুরুত্ব দিয়ে দেখে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কও যে কোন সময়ের চেয়ে অধিক ভাল। দুই পক্ষ ইতোমধ্যে আলোচনা করে অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারত সরকার একসঙ্গে সবার উন্নয়নে বিশ্বাস করে। প্রতিবেশীর উন্নয়নকেও গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। এই সম্পর্ক বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নততর হচ্ছে। ভারত এই অঞ্চলের উন্নয়নে পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতা করছে। বাংলাদেশের উন্নয়নেও সহযোগিতা করছে। তিনি বলেন, কূটনৈতিক সম্পর্ক তারা নতুন স্তরে নিয়ে যেতে চায়। তিনি বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, প্রতিবেশী প্রথম। আর প্রতিবেশীদের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম। আমাদের প্রত্যাশা মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে যেন এ দেশের তরুণ প্রজন্ম বেড়ে ওঠে। আর কোন অশুভ শক্তি যেন এখানে মাথাচাড়া না দেয়। আর যেন ‘অপারেশন সার্চলাইট’ না আসে। আর যেন ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’Ñ এমন বই না লেখা হয়। একটা উদারনৈতিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখতে বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ কাজ করছে, করে চলেছে। ভারত তাদের পাশে আছে। রীভা বলেন, আজ আমাদের সম্পর্ক বহুমুখী। আমাদের সম্পর্ক কেবল ব্যবসা-বাণিজ্য, নিরাপত্তা ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনার মতো ট্রাডিশনাল খাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আমরা তথ্যপ্রযুক্তি, মহাকাশ, পারমাণবিক বিজ্ঞানের মতো নতুন নতুন ক্ষেত্রেও আমাদের সম্পর্ক বাড়াচ্ছি। বাংলাদেশকে ঋণচুক্তির আওতায় (এলওসি) ৮ বিলিয়ন ডলার দেয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন মোটামুটি এর আশি ভাগের বেশি অবকাঠামো ও কানেক্টিভিটি প্রকল্পে ব্যবহৃত হয়েছে। অবকাঠামো ও কানেক্টিভিটি উন্নয়ন প্রবৃদ্ধির একটা ইঞ্জিন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে যৌথ উদ্যোগগুলো প্রমাণ করে আমাদের এই সহযোগিতা দুই দেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য। অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ব্রিটিশ মানবাধিকারকর্মী জুলিয়ান ফ্রান্সিস বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের সীমান্ত এলাকায় শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করেছি। সে সময় মানুষের দুঃখ-দুদর্শা দেখেছি। ’৭১ সালে ত্রিপুরার সাব্রুম শহরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। সাব্রুমের স্থানীয় নাগরিক ছিল মাত্র ৮/১০ হাজার। ওই শহরের দ্বিগুণেরও বেশি নাগরিক আশ্রয় নিয়েছিল। ফেনী নদী থেকে সম্প্রতি সাব্রুম শহরে পানি সরবরাহ করা হয়েছে। এ নিয়ে অনেকেই সমালোচনা করছেন। ঢাকার একটি পত্রিকায়ও এর সমালোচনা হয়েছে। তবে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে এই পানি দেয়ার বিরোধিতা অন্যায্য। একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, মুক্তিযুদ্ধে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অবদান আমরা ভুলিনি। ভারতে বঙ্গবন্ধুর নামে দুটি সড়ক রয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে ইন্ধিরা গান্ধী সক্রিয় সহযোগিতা করলেও আজও বাংলাদেশে তার নামে কোন সড়ক নেই। তিনি তার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গুলশান এ্যাভিনিউকে ইন্দিরা গান্ধী সড়ক করার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ সমস্যা বাংলাদেশ শুধু নয় গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তা হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। এ কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে ভারতের সক্রিয় সহযোগিতা দেখতে চাই। শুধু চীনের ওপর ভরসা করলে এ সমস্যার সমাধান হবে না। বিএনপি রোহিঙ্গাদের ভেতরে পাকিস্তানী নীতি আদর্শ প্রোথিত করছে। ফলে পাহাড় রয়ে গেছে ঝুঁকিতে। এরা বেশিদিন থাকলে আমাদের জন্য নিরাপত্তা হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ভারত বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। রক্ত দিয়ে লেখা। কিন্তু পরাজিত পাকি শক্তি এই সম্পর্ককে ঈর্ষাকাতর চোখে দেখে। অথচ একাত্তরে ভারতের সহযোগিতা না পেলে স্বাধীনতা অর্জনে আরও বেশি সময় লাগত। রক্ত আরও বেশি ঝরত। ভারতের এই ঋণ শোধ হওয়ার নয়। পঁচাত্তরের পর দেশে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি জনগণকে ভারত বিরোধী মনোভাবে উস্কে দিয়েছিল। কিন্তু জনগণ আজ এই অপশক্তি ত্যাজ্য করেছে। ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব কেউ কোন দিন ক্ষুণœ করতে পারবে না। স্বাধীনতাবিরোধী আর কোনদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। তিনি বলেন, ভারতের অবদান ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস অসম্পূর্ণ। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন মানবাধিকার নেত্রী এ্যারমা দত্ত।
×