ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রসিক নির্বাচন ॥ আ.লীগের একক প্রার্থী, বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে সংকটে বিএনপি, জাপায় অস্বস্তি

প্রকাশিত: ০৩:১২, ২৪ নভেম্বর ২০১৭

রসিক নির্বাচন ॥ আ.লীগের একক প্রার্থী, বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে সংকটে বিএনপি, জাপায় অস্বস্তি

নিজস্ব সংবাদদাতা, রংপুর ॥ গত ২২ নবেম্বর রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মনোনয়ন দাখিল শেষ হয়েছে। সেই সাথে শেষ হয়েছে মেয়র প্রার্থী হওয়া নিয়ে জল্পনা-কল্পনা। মেয়র পদের জন্য শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন দাখিল করেছেন মোট ১৩ জন। দিন যত এগোচ্ছে ততই প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকদের তৎপরতা বেড়ে যাচ্ছে। নির্ধারিত সময় না আসায় এখনও মিছিল-মিটিং, পোষ্টার বা মাইকিং এর মাধ্যমে প্রচার চালানো যাচ্ছে না। তবে, থেমে নেই প্রচার ও জনসংযোগ। স্বল্প সংখ্যক কর্মী সমর্থক নিয়ে প্রার্থীরা চষে বেড়াচ্ছেন মহানগরের পাড়া-মহল্লা, অলি-গলি। রংপুরে বেশ কয়েকদিন থেকে শীত পুরোপুরী নেমে পড়েছে। শীত উপেক্ষা করে চাদর জড়িয়ে প্রার্থীরা জনসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন কাক ডাকা ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। হাট-বাজার, অফিস-কাছারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও চায়ের দোকান সর্বত্র এখন প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে রংপুর সিটি নির্বাচন। সিটি নির্বাচন ছাড়া, রোহিঙ্গা সংকট বা ঠাকুরপাড়ার সন্ত্রাসী হামলা বা অন্য কোন বিষয়ই এখন আর রংপুর সিটির নাগরিকদের আলোচনায় তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। চায়ের আড্ডায় বসে ভোটার-সমর্থকরা নিজের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে নানা যুক্তি দেখাচ্ছেন। পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে প্রতিপক্ষের কাছে নিজের পছন্দের প্রার্থীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করার প্রয়াস পাচ্ছেন কেউ কেউ। নির্বাচনকে ঘিরে নগর জুড়ে যেন শুরু হয়েছে উন্মুক্ত টক-শো। উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয়েছে ভোটারদের মাঝে। সিটির বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা গেছে, ১৩ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে আলোচনার শীর্ষে আছেন আ.লীগ মনোনীত প্রার্থী জেলা কমিটির উপদেষ্টা সদ্য সাবেক মেয়র সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু, জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থী মহানগর কমিটির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা, বিএনপির মনোনীত প্রার্থী দলের মহানগর সহ-সভাপতি কাওছার জামান বাবলা, সাবেক পৌর মেয়র এবং জাপার সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রউফ মানিক। এছাড়া, জেলা যুবদলের সভাপতি নাজমুল আলম নাজু ও জাপার সাবেক এমপি এবং কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব হুসেইন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় আছেন। দেখা যাচ্ছে, আ.লীগে কোন বিদ্্েরাহী প্রার্থী নেই। তাই এক প্রকার স্বস্তিতে আছেন নৌকার প্রতিনিধি সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু। তিনি বলেছেন, নমিনেশন দাখিলের আগেই দলের জেলা ও মহানগর কমিটির নেতা-কর্মীদের সাথে আমার কথা হয়েছে। দলের সকল স্তরের নেতা-কর্মীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি সম্মান জানিয়ে নৌকা মার্কার জয়ের লক্ষ্যে আমার পক্ষে কাজ করছে। আপাতত দলের ভিতরে তেমন মতপার্থক্য বা মনোমালিন্য নেই। তিনি বলেন, সরকার চালাচ্ছে আ.লীগ। কাজেই সিটির উন্নয়নের স্বার্থে আ.লীগের মেয়র দরকার। রংপুরের মানুষ নিশ্চয়ই এই সহজ হিসাব বুঝতে ভুল করবে না। প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতায় গত আমলে আমি রংপুরের অনেক উন্নয়ন করেছি। আমার অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে প্রধানমন্ত্রী আবারো আমাকে দায়িত্ব নেয়ার সুযোগ দিয়েছেন। আ.লীগের জেলা ও মহানগর কমিটির নেতা কর্মীরা বলেছেন, রংপুর সিটি কর্পোাশনের ভোটের ফলাফল আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। এর সাথে দলে ইমেজ জড়িত। তাই এই নির্বাচনটিকে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে নিচ্ছেন তারা। সে কারণে, কে মেয়র প্রার্থী সেটা বিবেচনা না করে নৌকাকে বিজয়ী করতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন তারা। অপরদিকে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীকে মহাসংকটে ফেলেছেন জেলা যুবদলের সভাপতি স্বতন্ত্র বিদ্রোহী প্রার্থী নাজমুল আলম নাজু। কারণ বিএনপি’র তরুণ কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে নাজমুল আলম নাজু’র যথেষ্ট গ্রহনযোগ্যতা আছে। এমনিতেই রংপুরে বিএনপির অবস্থান খুব একটা মজবুত নয়। তার উপর ভোট ভাগ হয়ে গেলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা মুশকিল হবে। অন্যদিকে, জাপা চেয়ারম্যান এরশাদের ভাতিজা, সাবেক এমপি হুসেইন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় স্বস্তিতে নেই জাপা মনোনীত প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা। আবার, জাপায় না থাকলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে মোস্তফার অস্বস্তি বাড়িয়ে দিয়েছেন সাবেক পৌর মেয়র এবং জাপার সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রউফ মানিক। কারণ এরশাদ পরিবারের সদস্য হিসেবে জাপার ভোটারদের মাঝে আসিফের গ্রহনযোগ্যতা আছে। তেমনি একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী এবং সাবেক পৌর মেয়র হিসেবে যথেষ্ট ভোট টানার সম্ভবনা আছে আব্দুর রউফ মানিকের। আসিফ এবং মানিক যে ভোট পাবেন তার অধিকাংশই জাপার ভোট বলে ধারনা করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্থ হবেন জাপা মনোনীত প্রার্থী মোস্তফা। এ বিষয়ে মোস্তফা বলেন, আসিফ এবং মানিক নির্বাচন করাতে তার কোন ক্ষতি হবে না। তারা জাপার লোক হলেও দলীয় প্রার্থী আমি। রংপুরের মানুষ এরশাদকে ভালবাসে। এরশাদ যাকে মনোনয়ন দিয়েছে তার বাইরে অন্ততঃ জাপার লোকেরা ভোট দিবে না। তিনি দাবি করেন, দলের সব নেতা-কর্মী তার সাথে আছে। এবার তার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। কোন ভাবেই এ জোয়ার থামানো যাবে না। তিনি বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এ প্রসঙ্গে জাপার মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক এস.এম ইয়াসির বলেন, মোস্তফার সাথে দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতা-কর্মী সবাই আছেন। এ নির্বাচনে আসিফ এবং মানিক জাতীয় পার্টির জন্য কোন ফ্যাক্টর নন। নব গঠিত রংপুর সিটির প্রথম নির্বাচন হয় ২০১২ সালে। সে নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না থাকলেও নির্বাচনে ভোটের ফলাফলে দলীয় পরিচয় প্রধান ভ’মিকা পালন করেছে। গত নির্বাচনে সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু ১ লাখ ৬ হাজার ২৫৫ ভোট মেয়র নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা পেিেছলেন ৭৭ হাজার ৮০৫ ভোট। তৃতীয় অবস্থানে ছিলেন অপর জাপা নেতা আব্দুর রউফ মানিক। তিনি পেয়েছিলেন ৩৭হাজার ২০৮ ভোট। অর্থাৎ জাপার দুই প্রার্থী মোস্তফা এবং মানিকের মোট ভোট ঝন্টুর প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে বেশী। সেক্ষেত্রে জাপার একক প্রার্থী থাকলে জয়ের সম্ভবনা ছিল। কাওছার জামান বাবলা গত নির্বাচনে পেয়েছিলেন ২১হাজার ২৫৩ ভোট এবং ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের রংপুরের আমীর এটিএম গোলাম মোস্তফা ১৫ হাজার ৬১৮ ভোট। গতবারের পরিসংখ্যান এবং নির্বাচনী মাঠের সরেজমিন তথ্য অনুযায়ী এটি স্পষ্ট যে এবারেও আসল লড়াই হবে নৌকার প্রতিনিধি সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু এবং লাঙ্গলের প্রতিনিধি মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফার মধ্যে। সাবেক রংপুর পৌরসভার সাথে ৭টি পূর্ণাঙ্গ এবং দুটি আংশিক ইউনিয়নকে সংযুক্ত করে ২০৩.৬ বর্গ কিলোমিটারের রংপুর সিটি কর্পোরেশনের অধিকাংশই গ্রাম এলাকা। বলা যায় এটি একটি গ্রামীণ নগর। এখানকার মানুষগুলোও অতটা শহুরে হয়ে ওঠেনি। তাই তাদের চাওয়া পাওয়াও খুব সামান্য। বিগত মেয়রের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে এখন চুলচেড়া বিশ্লেষন করছেন সাধারণ ভোটাররা। আলোচনায় উঠে আসছে শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, প্রার্থীদের মধ্যে কে তাদের আশা-আকাঙ্খার বাস্তব প্রতিফলন ঘটাতে পারবে তাকেই ভোট দিতে হবে। ধাপ লালকুঠি এলাকার একজন ব্যবসায়ী আমিনুর রহমান বলেন, দল নয়, যোগ্য ব্যক্তি বিবেচনা করে ভোট দিব। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে দল নয় ব্যক্তি ইমেজ বেশী গ্রহনযোগ্য। কামার পাড়া এলাকার শিক্ষক সৈয়দ সাইফুল ইসলাম এবং রেজাউল করিম বলেন, গত মেয়রের আমলে কাঙ্খিত উন্নয়ন হয় নি । তাই এবারে আমরা পরিবর্তন চাই। লালবাগ এলাকার কলেজ শিক্ষক রওশানুল কাওছার সংগ্রাম বলেন, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে গেলে বিগত মেয়রকেই নির্বাচিত করা উচিৎ। শালবন এলাকার ব্যাংক কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম তুহিন বলেন, ভোট যেন নিরপেক্ষ হয় সেদিকে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ চাই। জনগণ তাদের নেতা নির্বাচন করতে নিশ্চয়ই ভুল করবে না। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী গত ২২ নভেম্বর পর্যন্ত মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল। প্রার্থিতা বাছাই করে বৈধ প্রার্থী ঘোষণার তারিখ ২৩ ও ২৪ নভেম্বর। প্রার্থীতা বাতিল হলে আপিল করা যাবে ২৫ ও ২৬ নভেম্বর। ৩০ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর আপিল নিষ্পত্তি হবে। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ৩ ডিসেম্বর। প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হবে ৪ ডিসেম্বর। ২১ ডিসেম্বর ভোট অনুষ্ঠিত হবে। রংপুর সিটি করপোরেশনে ওয়ার্ড আছে ৩৩টি। সংরক্ষিত ওয়ার্ড ১১টি। তিন লাখ ৯৩ হাজার ৯৯৪ জন ভোটারের মধ্যে ১ লাখ ৯৬ হাজার ৩৫৬ পুরুষ এবং ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬৩৮ জন নারী। গত ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর রংপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর এবারই প্রথম দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সম্ভাব্য ভোট কেন্দ্র ১৯৩টি, ভোটকক্ষ ১ হাজার ১১১২টি। ৩ হাজার ৬৫২ জন নির্বাচন কর্মকর্তা এ নির্বাচনে কাজ করবে। পাঁচ বছর আগে রংপুর সিটির ভোটার ছিল ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৭৪২।
×